ভুলেও কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা জিজ্ঞেস করো না;
আমি তা মূহূর্তেও সহ্য করতে পারি না-তার অনেক কারণ রয়েছে।
তোমাকে মিনতি করি কখনো আমাকে তুমি বাঙলাদেশের কথা তুলে কষ্ট দিয়ো না।
জানতে চেয়ো না তুমি নষ্টভ্রষ্ট ছাপ্পান্নো হাজার বর্গমাইলের কথা, তার রাজনীতি,
অর্থনীতি, ধর্ম, পাপ, মিথ্যাচার, পালে পালে মনুষ্যমন্ডলি, জীবনযাপন, হত্যা, ধর্ষণ,
মধ্যযুগের দিকে অন্ধের মতোন যাত্রা সম্পর্কে প্রশ্ন ক’রে আমাকে পীড়ন কোরো না;
আমি তা মুহূর্তেও সহ্য করতে পারি না–তার অনেক কারণ রয়েছে।”
——বাঙলাদেশের কথা; হুমায়ূন আজাদ।
আসলেই আমার দেশে সহ্য করতে না পারার মত রয়েছে অনেক কারন। বাংলাদেশ-যে দেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজারের মতো মানুষের কিডনি বিকল হয়। প্রতিবছর কমপক্ষে ৯ হাজার রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে, অথচ বছরে মাত্র ১৫০ টির মতো কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়।
দেশে এক কোটির বেশি মানুষ হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত যার অন্তত ১০ শতাংশের লিভার বিকল হয়ে যায়।
কর্নিয়া জনিত সমস্যার কারণে দেশে অন্ধের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। অথচ,বছরে মাত্র ৪০ থেকে ৫০টি কর্নিয়া সংগ্রহ করা সম্ভব হয়।
এই যে প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের অনুপাত এত কম, এর মূল কারণ- অঙ্গ দান সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা, অহেতুক ভীতি আর সেই সাথে ধর্মীয় গোড়ামি তো আছেই। দ্বিতীয়ত, অঙ্গ দানের মতো একটি মহৎ কাজে নাগরিকদের উৎসাহিত করার জন্য সরকারীভাবে কোনো প্রচারণা নেই। অথচ একজন ব্যক্তি মরণোত্তর অঙ্গ দানের মাধ্যমে অন্তত পাঁচজন অঙ্গ বিকল হয়ে যাওয়া মানুষকে বাঁচিয়ে দিতে পারেন। তাহলে ভাবুন, আমরা দশজন মানুষ যদি অঙ্গ দানের ক্ষেত্রে এগিয়ে আসি তাহলে অন্তত পঞ্চাশ জন মানুষ নতুন জীবন লাভ করতে সক্ষম হবেন। হায় আফসোস, আমাদের দেশের মানুষ এই ব্যাপারে যথেষ্ট উদাসীন!! মৃত্যুর পর কি হবে আমাদের শরীরের? মিশেই তো যাবে মাটির সাথে। মৃত্যুর আগে কারো উপকারে না আসতে পারলেও অন্তত মৃত্যুর পর না হয় কারো জীবন রক্ষার কাজে আসলাম আমরা। মরণোত্তর অঙ্গদান প্রক্রিয়া কিন্তু একেবারেই জটিল কিছু নয়। অঙ্গীকার পত্র ও হলফ-নামায় সম্মতিদানের মাধ্যমে নোটারি-পাবলিক করলেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়ে যায় আর সেই সাথে পরিবারের কাছের কাউকে জানিয়ে রাখলেই আর কোন সমস্যা হয় না। একবার ভাবুন তো, আপনার মৃত্যুর পর আপনার চোখ একজন অন্ধ মানুষের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করবে, আপনার চোখ দিয়ে সে বিশ্বকে দেখতে পারবে। অথবা, আপনার দান করা কিডনি দিয়ে একজন মৃত্যু পথযাত্রী আরো কয়েক বছর বাঁচবে, এর থেকে আনন্দের আর কি হতে পারে?
বর্তমানে আমাদের দেশের কিছু সংগঠন মরণোত্তর অঙ্গ দানের ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো- জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশন। তাদের সাথে যোগাযোগের ঠিকানা:
জনবিজ্ঞান ফাউন্ডেশন
১০৮ কাজী নজরুল ইসলাম এ্যাভিনিউ
৪ তলা/বাংলামটর, ঢাকা।
মোবাইল:০১৫৫২৩৫৮০১৮/০১৭১২২৯৬৮১৮
এবার আসি ইউরোপের পরিসংখ্যানে। ইউরোপে প্রতিবছর প্রায় সাতাশ হাজার রোগীর দেহে অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়। ষাট হাজার রোগী অঙ্গের অভাবে কেবল প্রতীক্ষাই করে যায়, আর প্রায় তিন হাজার রোগী সঠিক সময়ে অঙ্গ-প্রাপ্তির অভাবে মৃত্যুবরণ করে।
আপনি যদি জার্মান প্রবাসী হয়ে থাকেন আর মৃত্যুর পর সেখানেই আপনার অঙ্গ দান করতে চান তাহলে আপনাকে “Organ Donor Card” সংগ্রহে রাখতে হবে। আপনি যেই হেলথ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির তত্বাবধানে আছেন তাদের সাথে আলোচনা করলে তারাই আপনাকে একটা কার্ড ডাকযোগে পাঠিয়ে দিবে। আপনাকে বড়জোর জিজ্ঞেস করতে পারে আপনি কাগজের কার্ড চান নাকি প্লাস্টিকের। স্বভাবতই প্লাস্টিকের কার্ড সর্বক্ষন সাথে বহন করার জন্য বেশি উপযোগী। কি আছে এই কার্ডে?
একপাশে আপনার নাম, জন্মসাল, ঠিকানা এবং অন্যপাশে আপনি টিক দিতে পারেন ঠিক কোন কোন অঙ্গ আপনি দান করতে চান। মজার ব্যাপার হলো, এই কার্ড কিন্তু অন্যান্য দেশেও বৈধ।
সবশেষে, ইসলামের দোহাই দিয়ে কেউ বলবেন না অঙ্গ দান করা হারাম। সূরা মায়েদাহর ৩২নং আয়াতে একটু চোখ বুলান-
“এ কারণেই আমি বনী-ইসরাঈলের প্রতি লিখে দিয়েছি যে, যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে। তাদের কাছে আমার পয়গম্বরগণ প্রকাশ্য নিদর্শনাবলী নিয়ে এসেছেন।বস্তুতঃ এরপরও তাদের অনেক লোক পৃথিবীতে সীমাতিক্রম করে।”