জার্মান মুলুকে শিক্ষার দিন শেষ, শেখা তো আসলে শেষ হয় না , বলা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দিন ফুরিয়েছে। বছর দুয়েক আগে আরও ভালভাবে শেখার প্রত্যাশায় দেশ ছেড়ে গেলাম, তাই এখন সব শেষে কি নতুন শিখলাম তার একটা হিসাব করাই যায়। কিছুক্ষণ ভাবার পর যা বুঝলাম -এমন তো নয় যে খুব নতুন কিছু শিখেছি, কিন্তু খুব সম্ভবত কিভাবে কোনকিছু শিখছি সে ধারণাটা পাল্টে গেছে। এক বন্ধু একবার বলল যে এখানে তার সফট স্কিল নাকি ভাল হয়েছে। তো সেই সব শেখাগুলোকে একজায়গায় লিখে সবার সাথে ‘শেয়ার’ করাই হচ্ছে এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য। লেখার পর নিজে পড়ে যেটা মনে হল যে ‘দেশে খারাপ এখানে কি ভাল’ এই ধরনের একটা টোন চলে এসেছে, সেটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় বা এমনটা আমি চিন্তাও আসলে করি না। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সাথে ওখানকার পার্থক্য থাকবে তাই স্বাভাবিক। অনুকরণ নয়, কিন্তু কিছু ব্যাপারে ‘চিন্তা’ করা যেতে পারে, তাই লেখা!
সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করা- যে শব্দ জোড়া জার্মানিতে আমার উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিল, তা হচ্ছে “Critical Thinking” বা আমি যা বলছি সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করতে শেখা। যা পড়ানো হচ্ছে, যা শেখানো হচ্ছে তার সবটুকুকেই আমাদের দেখতে হবে একটু গভীর ভাবে। টপিকগুলো কে শুধু মেনে না নিয়ে সেগুলোকে প্রশ্ন করা একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অথবা একটা পরীক্ষা করতে গিয়ে যে মানগুলো আসছে তাকে একটা বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা। শুধু যে মানগুলো থিওর‍্যাটিক্যাল এর সাথে মিলছে সেগুলোকেই শুধু রাখলেই চলবে না, যেগুলো সেরকম আসছে না, কেন আসছে না? কিভাবে সেই মানগুলোকে ব্যাখ্যা করা যায়? আমাদেরকে এক শিক্ষক মান উলটা পাল্টা আসলে বলতেন যে এগুলো নাকি বেশ ‘ইন্টারেস্টিং রেজাল্ট’। আর যেই মানগুলোই পরীক্ষায় আসছে না কেন তা কতটুকু নিশ্চিত ভাবে আমি লিখতে বা বলতে পারছি সেটাও একটা গুরুত্ত্ব বহন করে। একটা পরীক্ষায় যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে আমি মানগুলো পরিমাপ করছি, আসলে কতটা নিশ্চয়তার সাথে তা আমাকে বলে দিতে পারে তার দিকেও খেয়াল রাখতে হবে। তাই Error Propagation কি, কেন এবং কিভাবে বের করতে হয় তা জানাটা মনে হয় একটা দারুণ ব্যাপার। এই ব্যাপারে একটা লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি লেখার শেষে [১]।
সময়ের বটিকা- জার্মানরা আরেকটা ব্যাপারে খুবই কড়া – সেটি হচ্ছে সময়। সকাল আটটায় ক্লাস থাকলে একটু (!) দেরি করলেই ইন্সট্রাক্টর মজা করে বলতেন ‘ইয়ু আর ২০ সেকেন্ডস লেইট’। এতটা ঘড়ি ধরে না চললেও তার থেকে খুব বেশি একটা কমও না। বাসস্টপে একটু আধটু যেতে দেরি করলেই আর পাবেন না, ট্রেনের ব্যাপার তো আরও কঠিন। এতটা সময় ধরে চলাতে বেশ কিছু লাভ আছে। পরিকল্পনা করে কাজ করার অভ্যাস থাকলে তা ঠিকঠাক মত করে ফেলা যায়, কর্মদক্ষতা বেড়ে যায়। থিসিস করবার সময় সময়কে আরেকটু গুরুত্ব দিতে শিখলাম। সময় ধরে ধরে কাজ করা। সময় ধরে কাজ করবার জন্য ‘পোমোডোরো টেকনিক’ ব্যবহার করলাম [২], কাজ শেষে কোন কাজে কতটুকু সময় দিয়েছি তা নোট করে রাখতে শুরু করলাম। এতে করে কোন কাজে কেমন সময় দিচ্ছি বা যতটা দেয়া দরকার তা দিচ্ছি কিনা ধারনা করতে পারলাম। আমি যেমন বলতে পারি যে থিসিস এর সময় আমি সর্বমোট ৮৩৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছি, গড়ে প্রায় দিনে ৪.৫ ঘণ্টার মত। থিসিস এর সময় আমি কোন কাজে কেমন সময় দিয়েছিলাম তার জন্য একটা পাই চার্ট দিয়ে দিলাম (আমি যে খুব বড় কিছু করে ফেলেছি থিসিসে তা না, কিন্তু গুছিয়ে কাজ করেছি এতটুকু বলতে পারি)।
নিজে নিজে করো: জার্মান সিস্টেম আপনাকে শেখাবে নিজে নিজে সব কাজ করবার। সাহায্য করবার জন্য সবাইকে পাওয়া যাবে, কিন্তু কাজটা শেষমেশ নিজেকেই করতে হবে। এমনিতে প্রবাসে এসে নিজেকেই গিয়ে গিয়ে অনেক কাজ করতে হবে, নিজের রান্না নিজে করতে হবে, নিজের বাড়ি ঘর নিজেকেই পরিষ্কার রাখতে হবে । তা বাদেও আমি বলছি নিজের পড়াশোনার কথা। ইন্টার্নশিপ খুঁজে বের করা বা থিসিস টপিকের হদিস- সব নিজেকেই করতে হবে। থিসিসের সময় যেমন সুপারভাইজার কে জিজ্ঞেস করলাম- এইটা দিয়ে কিভাবে কাজ করব? , তার উত্তর ছিল ‘এইটা তোমার থিসিস, তুমি নিজে থেকে ঠিক কর যে কিভাবে এই নিয়ে কাজ করতে চাও’। মোদ্দা কথা ‘স্বাবলম্বী’ হও।
তোমার ধারনা কি?: আমাদের দেশে যখন কাজ করেছি- যে জিনিষ আমি প্রায় সবার মধ্যে খেয়াল করেছি তা হল বস কে খুশি করবার একটা চেষ্টা বা বস যা শুনতে চাচ্ছে তাকে তাই বলা। একটা আইডিয়ার বিরোধিতা করা বা সমালোচনা করা আমাদের এখানে বেয়াদপি (সব টিমে না বা সব জায়গাতে না অবশ্য)। এটার বিভিন্ন প্রকারভেদ আছে, কিন্তু মূলটা একই। জার্মানরা এ ব্যাপারে একটু দিলদরিয়া। আপনার বসকেও আপনি নির্দ্বিধায় বলতে পারেন আপনি কি চিন্তা করছেন, বা কোন একটা সমস্যা সমাধানের জন্য আপনার কি ধারনা। আপনার আইডিয়াটা যতটাই ফালতু হোক না কেন আপনার চিন্তাগুলা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনবে এবং সেটা নিয়ে আলোচনা করবে।
কাজের কাঠামোঃ একবার একটা পরীক্ষা চলছে, আমরা দুই ল্যাব পার্টনার মিলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছি কি হচ্ছে। কিছু একটা হল যা হওয়ার কথা না, আমরা ব্যাপারটা মনে রেখে পরে ল্যাব ইন্সট্রাক্টরকে বললাম। তার প্রথম প্রশ্নই ছিল যে কি মান এসেছিল? আমি আমার নোটবুকের দিকে না তাকিয়ে বললাম যে ‘এরকম’ কিছু একটা। সে বলল যে এই প্র্যাকটিসটা অনেক দরকারি যে তুমি যেমনই হোক তোমার পরীক্ষায় আসা সব মান নোটবুকে টুকে রাখবে, যাতে পরে তুমি এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাল ভাবে চিন্তা করতে পার। ধীরে ধীরে বুঝতে শিখলাম যে নিজের সব কাজ গুছিয়ে করার কিছু ব্যাপার স্যাপার বুঝে নেয়াটা ভাল। আর তার জন্য একটা কাঠামো দাড় করিয়ে ফেলতে পারলে সবচেয়ে ভাল হয়। যেমনঃ আমাদের ল্যাবের সব পরীক্ষার তিনটা ধাপ ছিল ১) পূর্বপ্রস্তুতি (থিওরি ভালমতন বোঝা ও শিক্ষকের কাছে একটা ইন্টার্ভিউ দেয়া- সময় লাগবে ঘণ্টা পাঁচেক) ২) পরীক্ষা (আগে থেকেই মান নেয়ার চার্ট নিয়ে আসা, এবং ল্যাবের ভিতরেই কিছু সাধারণ বিশ্লেষণ করে ফেলা যাতে কোন বড় ধরনের ত্রুটি নেই তা নিশ্চিত করা – এবারো সময় প্রায় পাঁচ ঘণ্টার মত) ৩) রিপোর্ট লেখা (সবচেয়ে সময়সাপেক্ষ কাজ, মানের বিশ্লেষণ ও সেটা নিয়ে আলোচনা করা, সময় দিয়ে হয় প্রায় ২০ ঘণ্টা)। তার মানে কাঠামো মেনে কাজ করলে প্রতিটি পরীক্ষার পেছনে ৩০ ঘণ্টা সময় দিতে হবে।
একদিন, একমাস, একবছরঃ নিজেকে নিয়ে বা উন্নতির জন্য প্ল্যান করা আমার পুরনো অভ্যাস। কিন্তু আমার প্ল্যান গুলোর মধ্যে একটা সমস্যা ছিল, সেইটা ঠিক আক্ষরিক অর্থে প্ল্যান ছিল না। এগুলো ছিল আসলে ‘গোলস’ যা পেতে হলে আমাকে একটা একটা করে কি করতে হবে তা আমার ভাবনায় ভালভাবে ছিল না। জার্মান মুলুকে থাকবার সময় এগুলো নিয়ে ভাববার কিছুটা সুযোগ হয়েছে- যার ফলাফল হচ্ছে বড় পরিকল্পনাগুলোকে ছোট ছোট ‘গোলে’ ভাগ করে ফেলা আর সেগুলোকে নিয়ে কাজ করা। থিসিসের সময় যেমন প্রতি সপ্তাহ ভিত্তিক একটা লক্ষ্য থাকত, প্রতিদিনকার কাজ গুলো সেই লক্ষ্যগুলোর ভিত্তিতে ঠিক করা যেত।
সমস্যা থেকে শেখাঃ ‘প্রবলেম বেইজড লার্নিং’ বা একটা সমস্যা থেকে শেখা এখানকার কিছু কোর্সে আমি দেখেছি। সমস্যা থেকে শেখার উপর খুব মজার একটা জার্নাল আছে [৩]। একটা সমস্যা থেকে শেখার ধাপগুলো হচ্ছে, ১) প্রবলেমে যেসব ‘টার্ম’ ব্যবহার করা হচ্ছে তা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা। ২) সমস্যাটা কি সেটা ভালমতন বোঝা ৩) সমস্যাটাকে বিশ্লেষণ করা বা বলা যেতে পারে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে ফেলা ৪) সমস্যা সমাধানের উপায়গুলো বা এ সংক্রান্ত ধারনাগুলোকে সুন্দর করে একজায়গায় করা ৫) এ সমস্যা থেকে কি কি শেখা যাবে বা কি কি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে সেগুলো বের করে ফেলা ৬) সবাই মিলে বা একা একা এই সমস্যা সংক্রান্ত বই, জার্নালগুলো বুঝে বুঝে পড়ে ফেলা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একা একা খুব বেশি কিছু করা যায় না, তাই একটা দলে বা রিসার্চ গ্রুপে থেকে কাজ করলে সমস্যা সমাধান সহজতর এবং দ্রুত হয়। ৭) শেষ ধাপ হচ্ছে সব তথ্য, সমাধানের আইডিয়া গুলো সবাই মিলে আলোচনা করা, যদি মনে হয় যে একটা নির্দিষ্ট ধাপে সব কাজ ঠিক মত হয়নি, সে ক্ষেত্রে সেই ধাপে আবার ফেরত যাওয়া। আমরা ‘রুরাল এনার্জি সাপ্লাই’ নামে একটা কোর্সে এই ধাপ গুলো মেনে একটা সমস্যা সমাধান করেছিলাম (আমরা কাজ করেছিলাম যে পেরুর কোন কোন অঞ্চলে সোলার এনার্জি ব্যবহার করে রোস্টেড কফি করা যেতে পারে)।
কন্ট্রোল সি কন্ট্রোল ভিঃ বেশ কিছুদিন আগে একবার পত্রিকায় দেখেছিলাম যে কিভাবে আমাদের দেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের পি এইচ. ডি. পেপারে অন্যের কাজ থেকে টুকলি করেছেন। সেই সময়ই আমাদের ব্যাচের অনেকের ল্যাব রিপোর্টে খুব কম মার্কস দেয়া হল। কারন ছিল ‘প্ল্যাগিয়ারিজম’ বা সোজা বাংলায় অন্যের কাজ নিজের বলে চালিয়ে দেয়া। জার্মানিতে এই বিষয়টা খুবই একটা বড় ধরনের অপরাধ। একেবারে কোর্সের শুরু থেকেই একাডেমিক এথিকস নিয়ে বেশ ক্লাস হয়েছে, ঠিক ভাবে কোন তথ্য কোন জায়গা থেকে নেয়া হচ্ছে তা উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক। আর তা না মানা মোটামুটি নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মত। শাস্তির পরিমান বাজে গ্রেড থেকে শুরু করে একেবারে ছাত্রত্ব কেড়ে নেয়া পর্যন্ত। এমনকি ক্লাসের ছোট খাট প্রেজেন্টেশনে যেসব ছবি বা তথ্য ব্যবহার করা হচ্ছে তারও উৎস উল্লেখ করতেই হবে। আমাদের এখানকার ‘ কন্ট্রোল সি কন্ট্রোল ভি’ একবারেই করা যাবে না। ব্যক্তিগতভাবে এমন শর্টকাট নেয়া আমি দেশেও করিনি, কিন্তু এখানে আলোচনার ব্যপ্তি আর দৃষ্টিভঙ্গিটাই ভিন্ন।
আপাতত এতটুকুই থাক। সময় পেলে এমন আরও কিছু অভিজ্ঞতা সবার সাথে ভাগ করে নেয়ার ইচ্ছে রইল। আমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়েছে এই শেখার ধরনটা নিয়ে আমাদের এখানে বেশ কাজ করবার জায়গা রয়েছে। সব ঠিক থাকলে পরবর্তী মাস থেকে ওখানে ‘কাজ’ শুরু করব। তো, ওখানকার ‘প্রফেশনাল’ দের কাছ এমন ছোটখাট কি কি শিখলাম তা জানানোর চেষ্টা থাকবে । সেই পর্যন্ত ‘আউফ ভিডেরযেহেন’ 😊
কিছু লিঙ্কঃ
[১] এরর এনালাইসিস এর প্রাথমিক ধারণা [http://felix.physics.sunysb.edu/~allen/252/PHY_error_analysis.html]
[২] পোমোডোরো টেকনিক [https://www.youtube.com/watch?v=H0k0TQfZGSc]
[৩] ‘প্রবলেম বেইজড লার্নিং’ এর উপর জার্নাল [https://onlinelibrary.wiley.com/doi/full/10.1111/j.1365-2923.1983.tb01086.x]
mm

By দীপ্ত মজুমদার

আমি দীপ্ত মজুমদার, ওল্ডেনবুরগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নবায়নযোগ্য শক্তির উপর সবেমাত্র মাস্টার্স শেষ করলাম। জার্মানিতে আসার আগে দেশে বছর তিনেক কাজ করেছি নবায়নযোগ্য শক্তির উপর, আর ব্যাচেলরস ইলেকট্রিকাল ও ইলেক্ট্রনিকস এর উপর।

Leave a Reply