অভিনন্দন সবাইকে যারা ইতোমধ্যে ভিসা পেয়ে গেছেন, আপনাদের স্বপ্নের জার্মানি আর মাত্র দুই স্টেপ দূরে। হয়তো এখন বন্ধু বান্ধব আর প্রিয়জনদের সাথে অন্তিম মুহুর্তের (?) খাওয়া দাওয়া আর সেলফি তোলায় ব্যস্ত- শত হলেও ইউরোপে পাড়ি দিচ্ছেন! তবে এ সুযোগে বিয়েটাও সেরে ফেলুন। এতদিন বান্ধবীর চাপ সত্ত্বেও শশুর আব্বাকে ইমপ্রেস করা মুশকিল হবে ভেবে বিয়ের কথা মুখে আনার সাহস করেন নি। এখন শশুর আব্বা নিজেই আপনার মধ্যে তার মেয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যত দেখবে- এ সুযোগ হারাবেন কেন! এছাড়া এখানে আসলে সম্পর্ক নাও টিকতে পারে (অভিজ্ঞতা থেকে বলছি)।
নবীনদের অভিজ্ঞতায় জার্মানি-১ঃ যেভাবে শুরু
প্রবাস জীবনে অনেক সময় প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির মিল হতে সময় লাগে। আর আপনি আসেতেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা কালচার থেকে। ফলে শুরুতে এখানকার অনেক কিছুই অদ্ভূত লাগতে পারে। আমি এসেছিলাম গত বছরের এমন দিনে। আমার এক বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এরকম কিছু জিনিস বিষয় নিয়ে আজকের লেখা…
# উইন্টারে যারা আসতেছেন তাদের কপাল খারাপ (!) বলব- পশ্চিমা দেশগুলোর মত জার্মানির চিরাচরিত রূপ এই সময়ে চোখে পড়বে না। এখানে আসার আগে কত কথাই না শুনলাম এসব দেশ সম্পর্কে- ‘ফ্রি সেক্সের দেশ, অশালীন হেনতেন………।“ আমি বলতে গেলে একটু রোমাঞ্চিত ছিলাম- যেসব দৃশ্য আগে মনিটরে দেখা হতো- সেগুলো লাইভ দেখব! 😀 কিন্তু শীতকালে জার্মানিতে এসে মনে একটা ধাক্কাই খেয়েছিলাম- এ কোন জার্মানি!
কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো এসবদেশে অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু অনেকের কাছে কাতুকুতু লাগার মতো। উদাহরণস্বরূপ, আসার সময় এয়ারপোর্টে যখন দেখবেন কাপলরা অনেক্ষণ ধরে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ…… আপনার কাছে মনে হতে পারে এটাই বুঝি ‘ফেভিকলের মজবুত জোড়া’! আর আপনি যদি সীজনাল ঈমানদার হোন, তাহলে তো কথাই নাই। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক দৃশ্য। আমি অনেক সময় দেখেছি বাঙালিরা এমন দৃশ্য দেখে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করে, বাংলা ভাষায় মন্তব্য করে- ওরে, হ্যাতেরা কী শুরু করছে…
# জার্মানরা অনেক হেল্পফুল জাতি, সন্দেহ নাই। তাই বলে আপনি সব রকমের হেল্প আশা করতে পারবেন না। যেমন- জার্মানিতে নামার পর বন্ধুকে (যে আপনাকে রিসিভ করতে আসবে) ফোন করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আশেপাশেই তো অনেক জার্মান যাদের হাতে হাতে মোবাইল ফোন। আমি এয়ারপোর্টে পাশে দাঁড়ানো এক জার্মান মহিলাকে আমার মুঠোফোন থেকে নম্বর বের করে বললাম যে আমি এ নম্বরে কল করতে চাই। সে মনে করছে ‘কীভাবে ফোন করতে হয়’ তা আমি জানি না। ফলে সে আমার হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে সবুজ বাটনে ক্লিক করে বলল, এবার কানের সাথে চেপে ধর! একইভাবে, কাউকে কোনো জায়গার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে দেখা যাবে যে বলতে পারে না, যদিও জায়গাটা তার আশেপাশেই। অথচ ঢাকায় গাবতলীর হকার সায়েদাবাদের চিপাগলিরও খবর রাখে।
আসলে জার্মানির বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে ছোটবড় স্টেশনগুলাতে পাবলিক টেলিফোন থাকে, আপনি চাইলেই ফোন করতে পারেন। এছাড়া আছে ইনফোরমেইশন সেন্টার; বাটন চাপুন, সমস্যা বলুন, সমাধান নিন! ঢাকার মত ভুল তথ্য দিয়ে চিপাগলিতে নিয়ে আপনার জাইঙ্গাসহ সর্বস্ব হারানোর সম্ভাবনা নাই।
জার্মানরা ডানপন্থী! মানে, হাঁটাচলা, ড্রাইভিং, সাইক্লিং সব রাস্তার ডান পাশ দিয়ে; আমাদের দেশে যেটা উলটো! আমি প্রথম প্রথম অভ্যাসবশতঃ বাম পাশ দিয়ে হাঁটতাম, মাঝেমধ্যে দেখতাম সাইকেলওয়ালা আমার পিছনে ক্রিংক্রিং করে সাইড চাচ্ছে, আমি আরেকটু বামে চেপে সোজা হাটতে থাকতাম আর সে আড়চোখে তাকিয়ে পাশ কেটে চলে যেত। ভাবতাম- এতবড় জায়গায় ছেড়ে দিছি তারপরেও তার হয় না! এছাড়া পথচারি এবং সাইকেলের জন্য আছে পৃথক লেইন। ভুল করে সাইকেল লেইন ধরে মনের সুখে হাটতে থাকলে সাইকেলওয়ালার কড়া ভাষা শোনা লাগতে পারে। ভুল হয়ে গেলে অবশ্য Entschuldigung বলে দিলে সব ঠিক- কেউ বলবে না, “মিয়া! ভুল করছেন আবার সরি বলেন, গ্রাম থেকে উইঠ্যা আসছেন নাকি!”
# জার্মানিতে বিশুদ্ধ পানির অভাব নাই- কিন্ত টয়লেট সেরে ‘পরিষ্কারকর্ম’ সম্পন্ন করার জন্য পানির একটু বেশিই অভাব! এখানে টিস্যু দিয়েই উভয় জাহানের ধোয়ামোছার কাজ সারা হয়। মনে হবে, জার্মানরা বুঝি এতোই অপরিষ্কার!কিন্তু যুগ যুগ ধরে এটাই হয়ে আসছে। বরং টয়লেট সেরে স্বহস্বে নিজের পশ্চাদ্দেশ ঘষামাজা করা….. এটা তারা ভাবতেও পারে না।
কিন্তু সমাধান আছে- তা হলো কোকের খালি বোতল। দেশে তো কোক খেয়ে খালি বোতল ছুড়ে ফেলে দিতেন। এখানে এসে শিখবেন কোকের বোতলের এরকম বহুমুখী, সৃজনশীল ব্যবহার; দোকানে জমা দিলেও পাবেন প্রতি বোতলে ২৫ সেন্ট। প্রাকৃতিক কর্ম সেরে মনের সুখে গাইতেও পারেন- আমারে দু’দন্ড শান্তি দিয়াছিল কোকের খালি বোতল…
# স্টুডেন্ট ডর্মে বিশেষ কিছু জায়গা আছে যেগুলো পাব্লিক হিসেবে ধরা হয়, যেমন, কিচেন, টয়লেট, বারান্দা। এসব জায়গায় জিনিসপাতি রাখলে পাবলিক সম্পত্তি ভেবে যে কেউ নিয়ে যেতে পারে। শুরুতে আমিও কিচেনে সদ্য কেনা কিছু জিনিসপত্র হারাইছি। পরে অবশ্য সুদে-আসলে উসুল হইছে। এজন্য ডর্ম লাইফে প্রয়োজনীয় তেমন কিছু কিনতে হয় না, এমনিতেই পাওয়া যায়। আমাদের এখানে এক বাঙালি ভাই মেয়েদের কাপড়চোপড়ও আলমারিতে জমা করছে- ফ্রি বলে কথা! সামনে বউ আসলে এসব জিনিস কেনা লাগবে না- এরকম সৃজনশীল চিন্তা আর কি!
# নতুনরা এখানে এসে ডিজিটাল কপিরাইট এবং পাইরেসীর ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। বিশেষ করে মুভি এবং সিরিয়ালপ্রেমীরা এদেশে হাইস্পীড ইন্টারনেট পেয়ে হুশ হারাবেন না। এসব দেশে টরেন্টিং এবং বেশিরভাগ স্ট্রিমিং নিষিদ্ধ। অনেককেই জরিমানা গুনতে হইছে, যা প্রায় ১ হাজার ইউরোর মত। এক ভাই দেশে টরেন্টে মুভি ডাউনলোড করেছিলেন যেগুলো ডাউনলোড শেষে utorrent এ সীডিং লিস্টে ছিল। এ অবস্থায় জার্মানিতে এসে পরিচিত দুইজনের বাসায় গিয়ে ল্যাপটপে তাদের ওয়াইফাই ইউজ করেছে, ফলে utorrent এ সেই মুভিগুলা সীড হইছে। এরফলে কিছুদিন পর দুই ঠিকানায় জরিমানার কাগজ হাজির! একে বুঝি বলে, ‘হনুমানের লেজের আগুণে লঙ্কা পুড়ে ছাই’। আর জরিমানা হয়ে গেলে কিন্তু বাঁচার উপায় নাই, তাৎক্ষনিক শোধ না করলে পরে সুদে-আসলে দিতে হবে। কারণ আপনার সব অর্থনৈতিক কাজকর্ম Schufa (যা অন্যদেশে ক্রেডিট হিস্ট্রি নামে পরিচিত) তে জমা হচ্ছে।
# এদেশে পাবলিক পরিবহনগুলো টাইম মেনে চলে, আপনার জন্য এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করবে না। নির্দিষ্ট স্টেশনে থামে- ‘ও ভাই, নামাই দ্যান’ বলে চিৎকার দিলেও স্টেশন ছাড়া নামাবে না। জার্মানদের এই সময়ানুবর্তীতার সাথে আজও অভ্যস্ত হতে পারি নি। যানবাহন আর স্টেশন মিস তো হয়েই-তার উপর প্রতিদিনই বাস ধরার জন্য দৌড় দিতে হয়। আমার মত অবশ্য অনেকেই দৌড়ায়, এদের কেউ আমার মতোই বাঙালি কিংবা ইন্ডিয়ান/পাকিস্তানি। অভ্যাস কি আর সহজে বদলায়! মনে আছে এই বাস মিস করে এক জব ইন্টারভিউতে ঢুকতেই পারি নি। জার্মানদের নিয়ম হলো- “একটু আগে আসলে কী হয়!”
# জার্মানদের একটি বিশেষ অভ্যাস আমাকে মুগ্ধ করেছে। লালবাতি জ্বলা অবস্থায় তারা যতই ব্যস্ততা থাকুক রাস্তা পার হবে না, যদিও রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই। রাস্তায় কোনো গাড়ি নেই, কিন্তু তারা সিগনালের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। দেশে তো এসবের তোয়াক্কা করে না কেউ, এখানে এসে রোড ক্রসিং করার সময় নিয়ম মেনে চলতে হবে। পথচারি পারাপারের জন্য বিভিন্ন জায়গায় জেব্রা ক্রসিং থাকে। জেব্রা ক্রসিং এ সর্বোচ্চ অধিকার আপনার-গাড়ি আপনাকে দেখলে দাঁড়িয়ে যাবে। কেবল নিয়ম নেই এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস এর জন্য। এম্বুলেন্স বা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িকে সবাই সাইড দিয়ে দেয়। পথচারিরাও এসব গাড়ি দেখলে রোড ক্রসিং না করে দাঁড়িয়ে যায়। সবাই মিলে নিয়ম মানার এসব দৃশ্য সত্যিই মুগ্ধকর!
এছাড়া এমন অনেক ফর্মালিটি আছে যেগুলো বোঝার জন্য তেমন কিছু লাগে না-জাস্ট ‘মানুষ’ হতে হয়। যানবাহনে উঠার সময় কিংবা সার্ভিসের জন্য লাইনে দাঁড়ানো, চিপ্স খেয়ে প্যাকেটটা ডাস্টবিনে ফেলা, নিষিদ্ধা জায়গায় ধুমপান না করা….. এসব চর্চা সম্ভবতঃ বাংলাদেশ ত্যাগ করার পরই শুরু হবে (অভাগা দেশে এসবের পরোয়া করে কে!)। বাসে কিংবা ট্রেনে বয়স্ক কোনো জার্মানকে নিজের সীটটা একবার ছেড়ে দিয়ে দেখুন কেমন রেস্পন্স পাওয়া যায়!
নতুনদের এদেশে নবযাত্রা শুভ হউক!
ডিসক্লেইমারঃ লেখাটি আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে, ফলে অনেকের অভিজ্ঞতার সাথে নাও মিলতে পারে। কাউকে উপদেশ দেয়া কিংবা খাট করা লেখার উদ্দেশ্য নয়।
Bhia,eagerly waiting to know from your experience aboit doetch learning. Please do write how we cam learn upto b2 level easily
[…] নবীনদের অভিজ্ঞতায় জার্মানি-২ঃ জার্মা… […]
ভাই পড়েই জার্মানের বেপারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম ! জানিনা যেতে পারবো কিনা , সামনা সামনি এগুলো দেখলে হয়ত নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হবে ।