ল্যাবে এসেছি কিছু টিস্যু-স্লাইড স্ক্যান করবো বলে। এসে ফেঁসে গেছি। এয়ার কুলার বিগড়ে গেছে। তাই ঘেমে কুলুকুলু। জার্মান দেশে তাল গাছ থাকলে অনায়াসে বলা যেত আজকে তালপাকা গরম পড়েছে। তার উপর ড্রিল মেশিনের একটানা ঘ্যার ঘ্যার আওয়াজ। সাথে বোনাস হিসেবে ল্যাবময় ফর্মালিনের বিটকেলে ঝাঁ ঝাঁ গন্ধ। কানের পর্দা, কলিজার পর্দা দুটোই ফর্দাফাই। তিতিবিরক্ত হয়ে এক এক করে লোকজন ল্যাব থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাকি শুধু আমি। মাঝ পথে কাজটা রেখে যেতে পারছি না। লাইকা কোম্পানির বেঢপ স্লাইড স্ক্যানারটা ধরে ঝুলে আছি।
আরও কিছুক্ষন ঝুলে থাকলে বোধ হয় কাজটা শেষ হয়ে যেত। ফর্মালিনের বদবু সামান্য সয়ে এসেছে। গবেষনা নামক গ্যাঁড়াকলে পড়ে নাকে মুখে মাস্ক এঁটে কত শত ইঁন্দুর মিন্দুরের নাড়ি ভুড়ি কেটেছি, তার ইয়াত্তা নেই। ফর্মালিনের ঝাঁজ তো সেই তুলনায় বাইতুল মোকাররমের মদীনা আতর। নিজেকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে বসিয়ে রাখলাম। হঠাৎ মারিয়ন এসে সামনে দাঁড়ালো। আমাদের ল্যাবের এক টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট। ষাট বছরের মারিয়ন ষোলো বছরের কিশোরী বনে গিয়ে গোটা চারেক রঙ্গিন মোড়ক মেলে ধরে বলল, ‘বেছে নাও। আর চল পালাই এই দোযখ থেকে।‘ মুহূর্তের ভেতর একটা চকলেট আইস্ক্রিম আমার মালিকানায় চলে আসলো। ছিলকে খুলতে খুলতে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলাম ল্যাব থেকে। এবার কাজকে কাঁচকলা দেখাতে অসুবিধা হল না। কিন্তু খেয়ালও করলাম না যে ডিসেকশন করার ধাতব টেবিলটায় ভীষন অদ্ভূতুড়ে একটা জিনিস পড়ে আছে।
‘ঘটনা কি বলো তো? ফর্মালিন হুড কি কাজ করছে না নাকি?’ প্রশ্নের সদুত্তর দেবার সময় কারো নেই। সপ্ সপ্ শব্দ তুলে আইস্ক্রিম খেতে ব্যস্ত সবাই। এই মুহূর্তে ঠান্ডা খাওয়া সবচেয়ে জরুরী কাজ। স্ট্যান্ডিং পাখা গোটা দুই ছিল বটে। সে দুটোকে মাইনাস আশি ডিগ্রির ফ্রিজারের দিকে তাক করিয়ে রাখা হয়েছে। একটু পর পর একজন গিয়ে ফ্রিজারটাকে রোমান্টিক ভঙ্গিতে দুই হাতে জাপটে ধরে ভেতরের তাপমাত্রার হেরফের বোঝার চেষ্টা করছে। এদিকে আমরা যে গরমে গলে যাচ্ছি তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু মহামূল্য রিসার্চ স্যাম্পল গলে গেলে বিরাট মুসিবত।
পায়ে পায়ে কি ভেবে আবার ল্যাবে উঁকি দিলাম। কেউ একজন চেয়ারে উঠে একটা একটা করে জানালাগুলো খুলে দিচ্ছে। সাথে সাথে বিশুদ্ধ বাতাস ঝাঁপিয়ে ঢুকে পড়লো। এই ধাক্কায় ফর্মালিনের ঝাঁজটা যদি পালায়। বাতাস খেতে খেতে টেবিলে ঠেস দিয়ে আইস্ক্রিমের বাকিটুকু হাপিশ করে দিলাম। ল্যাবে খানপিনা নিষেধ। কিন্তু এখন সব আলাব্বু।
বাকিরাও ফিরছে গুটি গুটি পায়ে। টুকরো কথাগুলো ভেসে আসছে। ‘মগের মুল্লুক নাকি? আজকে হয় ওরা থাকবে, নয় আমরা। অনুমতি দিল কি করে কাতিয়া, এ্যাঁ?’ কাতিয়া বেচারার দোষ নেই। সে আমাদের রিসার্চ ইউনিটের হেড। হাজারটা কোলাবরেশন প্রজেক্টের কারনে তাকে সারাক্ষনই ছোট-বড় অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে হয়। আজকেও তেমন কিছু একটা গেলার ফল এই ফর্মালিন আর ড্রিল মেশিনের যুগলবন্দী। তবে গান্ধীজির দেখিয়ে দেয়া অসহযোগ আন্দোলনের যে নমুনা দেখছি, তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারছি, ফর্মালিনওয়ালাদের আজকের বরাত খারাপ। খেদিয়ে দিতে, তাড়িয়ে দিতে জার্মানদের জুড়ি নেই।
কথাগুলো শেষ না হতেই কয়েকজন ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঢুকলো। ‘একটু সরবে? মাথাটা নেবো।‘ ভ্যাবাচ্যাকা খেলাম। ‘মাথা? মাথা আসলো কোত্থেকে?’ বলতে না বলতেই টেবিলের দিকে তাকিয়ে দাঁত কপাটি লেগে গেলো। অস্ফুট একটা হেঁচকি তুলতে তুলতে দেখলাম, টেবিলের ওপর অতিকায় কাটা মুণ্ডু কাত পড়ে আছে। লতানো কান আর সিলিন্ডারের মত নাকটা বলে দিচ্ছে এটা শুকরের মাথা। এই বস্তুই বিশাল এক বালতি ফর্মালিনে চুবিয়ে ল্যাবে নিয়ে আসা হয়েছে। পাশেই ড্রিল মেশিনটা গড়াগড়ি খাচ্ছে। মাথাটার খুলি ফুটোর চেষ্টাই চলছিল এতক্ষন। চেষ্টা খানিকটা সফলও হয়েছে। আধখোলা ঢাকনার ফাঁকে গোলাপি-সাদা কি যেন দেখা যাচ্ছে। ঘিলু মিলু ছাড়া আর কি হবে। তাহলে কি একটু আগে এই ঘিলু আর কাটা মুণ্ডুকে সাথে নিয়ে নির্বিকার আইস্ক্রিম খেয়েছি? টের পেলাম, শিরদাঁড়া বরাবর একটা শির শিরে অনুভূতি দৌড়ে নেমে যাচ্ছে। এবার নিজেই জমে আইস্ক্রিম হয়ে গেলাম।
ল্যাবে এমন ঘটনা গটে না বললেই চলে। আমাদের এক্সপেরিমেন্টাল প্যাথোলজি বিভাগের আলাদা অপারেটিং রুম আছে। সেখানে কুকুর, বিড়াল, শুকর এমনি কি ঘোড়ার মত বড় বড় প্রানি কাটাকুটি করা নিত্যদিনের মামলা। কাটাকুটি করে বের করা টিস্যু নানান ধাপ পেরিয়ে ছোট্ট কাঁচে স্লাইডে চড়ে স্ক্যানারে ঢুকে ছবি হয়ে যায়। আমি এই ডিজিটাল ইমেজ নিয়ে ঘটর মটর করি বলে শুরুর রোমহর্ষক অ্যানালগ কেচ্ছা-কাহিনী দেখা থেকে বেঁচে গেছি। বাদ বাকি সবার কাছে এগুলো ডালভাত। যাহোক, লুতুপুতু হৃতপিন্ডটা সামলে নেয়া দরকার। ভৌতিক সিনেমার দৃশ্য আর একটু আগে খেয়ে ফেলা আইস্ক্রিম-দুটোই তাই জোর করে হজম করে ফেলতে চাইলাম।
এদিকে কাটা মুণ্ডুর মালিকরা মাথাটা আবার ফর্মালিনের স্টিলের বালতিতে চুবিয়ে দিয়েছে। শুকরের মগজ থেকে নমুনা সংগ্রহ মাঠে মারা গেল আজকে। রণে ভঙ্গ দেয়া পাংশু মুখে ড্রিল মেশিনটা বাক্সে পুরে মুণ্ডুসমেত ট্রলি ঠেলে বেরিয়ে গেল তারা। ফোস্ করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক বাবা, আপদ বিদায়। পাঁচ মিনিটের ভেতর ল্যাব তার পুরোনো চেহারায় ফিরে গেল। ‘মুণ্ডুখেদাও আন্দোলন’ সফল হওয়াতে সবার ভেতর চাপা উচ্ছ্বাস। সেই উপলক্ষ্যে আরেক দফা ঠান্ডা খাওয়া হবে কি না, তাই নিয়ে নিচু স্বরে গুনগুনিয়ে আলোচনা চলছে। আমার আর ঠান্ডা খেয়ে কাজ নেই। কলিজা এমনিতেই ঠান্ডা মেরে গিয়েছে।
একটা ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে। শুকরের মাথা কাটাকুটির যজ্ঞটা মাত্র হাত কয়েক দূরেই চলছিল। অথচ একবারও চোখে পড়ে নি। নিজের ধান্দায় মশগুল ছিলাম। বিজ্ঞানী হবার পূর্বশর্ত নাকি তুখোর পর্যবেক্ষন শক্তি। বুঝলাম, এই বস্তুটার খামতি আছে। চিন্তায় পড়ে গেলাম। চাকরিটা টিকবে তো? কে জানে, এক সকালবেলা হয়তো ডেকে বলা হবে, ‘এ্যাই, লোটা-কম্বল নিয়ে ভাগো হিঁয়াসে। এমন আন্ধাকে দিয়ে আর পোষাচ্ছে না। খালি ইউনিভার্সিটির পয়সা খাচ্ছো আর মোটা হচ্ছো।‘ সুতরাং, বিকল্প পেশা ভেবে রাখা দরকার। মুশকিল হল, মাথায় তো ভারিক্কী ভারতীয় নাম দিয়ে বাংলাদেশি রেস্তোরা খোলা ছাড়া আর কিছু আসছে না। অবশ্য বুদ্ধি মন্দ না। কেকা ফেরদৌসির নুডুলসের তেহারিকে অথেনটিক হায়দ্রাবাদি দম বিরিয়ানি বলে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে। গিজগিজে দুই নম্বুরি বুদ্ধির বহরে মুগ্ধ হয়ে চতুর এক চিলতে হাসি ঠোঁটে স্লাইডগুলোর কাছে ফিরে গেলাম।
কাজ সেরে অফিসের দিকে রওনা দিয়েছি। বাইরের তাতানো রোদ্দুরের ভয়ে হাসপাতালের পাতাল ধরে চলছি। আন্ডারগ্রাউন্ডটা গুমোট আর এক আধ জায়গায় আবছা অন্ধকার। খালি মনে হচ্ছে কাটা মুণ্ডুটা শূন্যে ভেসে ভেসে ঠিক পিছু নিয়েছে। ফিরে তাকালেই ঘাড় মটকে আমাকেও স্কন্ধ কাটা ভূত বানিয়ে দেবে। ইন্নি কুনতু দোয়াটা পড়বো কিনা ভাবছি। কি ভূত চাপলো, ফিরে তাকালাম। দেখি, হুড়মুড় বেগে ট্রলি ছুটিয়ে আসছে মুণ্ডুবাহিনী। তাদের চোখ মুখে বিরাট খুশির ঝিলিক। আর কোন ল্যাবে জায়গা পেয়েছে বোধহয়। একজন আবার কায়দা করে ড্রিল মেশিনটা কালাশনিকভ রাইফেলের মত বাগিয়ে ধরেছে। খুলি উড়িয়ে ঘিলু হাতিয়ে নেয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
দেখে শুনে হাঁটার গতি দ্বিগুন বাড়িয়ে দিলাম। কিন্তু বিচিত্র এই জায়গাটা ভাল লাগতে শুরু করেছে। একঘেয়েমি শব্দটা বোধহয় এই ক্যাম্পাসে হ্যারিকেন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
০১.০৯.২০১৯
-ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার
গবেষক, ইন্সটিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন,
টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি