এককালে দুনিয়ার বুকে দুটি বস্তুকে ভয় পেতাম। একটি তাবলীগের দল দেখে, আরেকটা মরণকে। যখন কিশোর ছিলাম তখন এই ভয়কে কীভাবে জয় করা তাই নিয়ে অস্থির। বিশ্বব্রহ্মমান্ডের সব ভয়কে জয় করা সম্বব কিন্তু তাবলীগের ভয়কে নয়। সে নিয়ে চেষ্টা বাড়িয়ে লাভ নেই। এর চেয়ে সহজ মৃত্যুভয়কে জয় করা। কিন্তু চাইলেই কি হয়? ভেবে দেখলাম এই ভয় জয় করার প্রাথমিক শর্ত হল- আমি একদিন মারা যাবই যাব- এটি বিশ্বাস করা। কোন এক অজানা কারণে আমাদের সবার ধারণা যে, বাকি সবাই মরবে, শুধু আমি বেঁচে থাকব। আমি একদিন মারা যাবই যাব- এই বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করলাম। ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে সিলেটে যাব ভর্তি পরীক্ষা দিতে (পড়ুন ঘুরতে)। জীবনের প্রথম এতদূর কোথাও যাচ্ছি, আর যেহেতু আমি বিশ্বাস করা শুরু করেছি যে আমার মৃত্যু যেকোন মুহুর্তে হতে পারে, তাই প্রথমে মাথায় যেটি আসল সেটি হল, সিলেটে গিয়ে মরে গেলে আমার দেনা পাওনার কি হবে? বাজারের দুটি দোকানে গুনে গুনে প্রায় ২০০ টাকা পাবে। দুনিয়ার বুকে দেনা রেখে পরপারে গিয়ে দোজখবাসী হওয়ার মতো বোকা আমি নই। এদিকে নিজের সাধ্যও নেই শোধ দেওয়ার। অগত্যা চিঠি লিখে বালিশের তলে রেখে সিলেটে রওনা দিলাম। সেই চিঠি গিয়ে পড়লো আমার বদ কাজিন শুভর হাতে। শুভ এমন এক বস্তু, কোন কথা যদি পাড়ার সবাইকে জানানোর প্রয়োজন পড়ে তবে ওকে জানালেই যথেষ্ট।
বহুকাল বাদে আজ একথা মনে পড়লো। কারণ করোনা। খেলতে খেলতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, আর মারা যাচ্ছে। এতদিনে মৃত্যু নিয়ে আমার ভাবনা আরো পরিবর্তিত হয়েছে। মৃত্যু আমার কাছে একটা তাচ্ছিল্যের বস্তু বৈ আর কিছু নয়। আমার মৃত্যুর পর কি কি করা হবে তার সবই আজ হতে তিন বছর আগেই ঠিক করা। আমার মরা লাশ নিয়ে সজলে কান্নার উৎসব করবে, কফিন নিয়ে নাচতে নাচতে গোরস্তানে যাবে সেসব হবেনা। লাশ মেডিকেলে দান করা আছে। কিন্তু করোনায় মরলে তো সে আশার গুড়ে বালি। এখন উপায়! যাকগে, প্রাণহীন দেহ নিয়ে কি হল না হল কার যায় আসে!
মৃত্যুর জন্য যদিও প্রতি মুহুর্তে প্রস্তুত, তবু করোনার কারণে কিছু জিনিস নতুন করে ভাবতে হল। এছাড়া বেশ ক’জন বাঙ্গালদেশি এখানে মারা যাবার পর দেখেছি সহপাঠী বন্ধুদের সে কী ঝামেলা যায়। আমার জ্বালায় এমনিতেই সবাই অস্থির, মরে আর জ্বালাতে চাইনা। সেই ভাবনা থেকে ভাবলাম, আমার ব্যাংক, মোবাইল, ল্যাপটপ সবকিছুর পাসওয়ার্ড এক বড়ভাই+বন্ধুকে দিয়ে যাব। পাওয়ার অব এটর্নি যাকে বলে, যাতে আমার অনুপস্থিতিতে সবকিছু বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিতে পারে। তাঁকে সব দেওয়ার পর আমাকে বলে কিনা, তোমাকে নিজ খরচায় টিকেট কেটে দেই, ক’টা দিন ইতালির মনোরম পরিবেশে ঘুরে আসো। একি সর্বনাশ হল আমার!! এখন না মরলে কি হবে আমার!!
বেলজিয়ামে এক বিজ্ঞানী বন্ধুর দুদিন ধরে হালকা কাশি। গলা নাকি ধরে ধরে আসে। তার ধারণা এটি করোনা না হয়ে পারেই না। সে নিশ্চিত সে মারা যাবেই এবার। ভিডিও কলে দেখলাম অনেক দুঃখ তার। কথার মাঝে একবার গেল চুলাপাড়ে তরকারী নাড়তে। ডাল দিয়ে গরুভুনা, ঝাল দিয়ে। আমি তো অবাক। যেখানে করোনায় আক্ত্রান্ত সে, মরে কি বাঁচে ঠিক নাই, এর মাঝে গরু রেঁধে ফুটানি। তার উত্তর, মরেই যেহেতু যাব, ফ্রিজের সবকিছু শেষ করে পৃথিবীকে চিরবিদায় বলতে চাই।
করোনা নিয়ে এতই ভাবলাম যে তা স্বপ্নেও দেখে ফেললাম। শুধু কি তাই? স্বপ্নে বিজ্ঞানী বনে গিয়ে এই ভাইরাসের দাওয়াও বানিয়ে ফেললাম। নামীদামী ল্যাবে বসে এপ্রোন পরে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে ভাইরাস চেক করছি। একটা করে ভাইরাস দেখছি আর কাঁচামরিচ দিয়ে খোঁচা দিচ্ছি। খোঁচা খেয়ে ভাইরাস মরে যাচ্ছে। আবিষ্কার হয়ে গেল করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক। ঘুম ভেঙ্গে দেখি অজানা কারণে মুখে ঝাল লাগছে।
তবে ভাই ফাইজলামি করি আর যাই করি, যেখানে এঙ্গেলা মের্কেল পর্যন্ত বলেছে যে, প্রায় সত্তুর শতাংশ জার্মান এই ভাইরাসে আক্ত্রান্ত হতে পারে, সেখানে ভয়ের অনেক কিছু আছে। বেহুদা কথার মানুষ জার্মান চ্যান্সেলর না। সে তো বাংলাদেশের মন্ত্রী নয় যে বলবে, বিএনপি রানা প্লাজা ধরে নাড়ানাড়ি করছিল, তাই ভেঙ্গে পড়ে ১১শ মানুষ মারা গেছে। ‘আর তোমরা যারা বুদ্ধিমান, মের্কেলের কথায় তাদের জন্য আছে অপরিসীম ইঙ্গিত’
আরো পড়ুনঃ বঙ্গসমাজ আর চৈনিক ভাইরাস
ধন্যবাদান্তে
জাহিদ কবীর হিমন
বার্লিন থেকে
১৬.০৩.২০২০