এই লেখাটি যখন লিখছি তখন চারদিন মাদ্রিদে কাটিয়ে আমি বার্সেলোনার দিকে রওনা দিয়েছি। ঝলমলে রোদ, কখনো বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠ কখনোবা গাঢ় ঘন সবুজ বন চিড়ে আমার বাস চলছে। ৮ ঘণ্টার জার্নি, ভাবলাম ল্যাপটপে বসে একটা লেখা রেডি করে ফেলি। গান না শুনলে লেখা আসে না। ইউটিউব খুলতেই দেখলাম শাওন আর চঞ্চল চৌধুরীর নতুন গান নিশা লাগিলোরে…। নেশা অবশ্য আমার লেখে আছে গত চারদিন থেকেই, যেকদিন মাদ্রিদে থাকলাম। সম্মানিত পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক না করে মুল ঘটনায় চলে যাওয়াই বোধহয় উত্তম কাজ হবে।
ভাগ্য আমার প্রতি সর্বদা সুপ্রসন্ন থেকেছে সেকথা গর্ব করে বলার জো আমার অন্তত নেই। যেমন ধরুন, ট্রেন ধরতে গেলাম, আমি স্টেশনে পৌঁছানোর ১ মিনিট আগেই ট্রেনকে চলে যেতে হয়। ওদিকে ড্রয়ারে যে বস্তুই রাখিনা কেন, তার পাখা গজায়, যে ড্রয়ারে রেখেছি সেখানে না থেকে অন্য জাগায় উড়াল দেয়। তাই ইদানীং নিচের ড্রয়ারে আগে খুঁজি। এত বেদনার কথা কেন লিখছি তা বলছি। ভেবেছিলাম দেশে যাব। দু’দুবার করে ভ্যাক্সিন নিয়ে সম্প্রতি অমরত্বলাভ করেছি। দেশে যেতে বাঁধা নেই। হঠাৎ শোনা গেল দেশে কঠোর লকডাইন না দিলে কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। উপায়ান্তর না দেখে আমার কেবলা ঘুরে গেল বাংলাদেশ থেকে স্পেনের দিকে। স্পেন বলতে রাজধানী শহর মাদ্রিদ।
হঠাৎ করেই যখন সিদ্ধান্ত হল স্পেন যাচ্ছি, তাই এই দেশ সম্পর্কে আরো জানতে চাইলাম। ইহকালেও স্পর্শ না করা তিন ইঞ্চি ধুলোর আস্তর পরে যাওয়া বইয়ের তাক থেকে নামালাম মাহবুবুর রহমানের “স্পেনে মুসলমানদের ইতিহাস (৭১০ – ১৪৯২ সাল)” বইটি। এক পাতা পড়ি দশ পাতা ঘুমাই অবস্থা করে অর্ধেক পড়া হল। তারপরই উড়াল দিলাম। অর্ধেক ইতিহাস জানা বড় ভয়ানক ব্যাপার। আজকের বয়ান তাই ইতিহাস দিয়ে নয়, আজকের বয়ান মাদ্রিদের মায়াজাল নিয়ে।
প্রায় ৩৫ লাখ জনবাসীর শহর মাদ্রিদ বিমানবন্দরে যখন নামি তখন রাত ১২ টা, ট্যাক্সি করে এয়ারবিএনবি বাসায় পৌঁছাতে লাগে ২০ মিনিট। সর্বোচ্চ ২৫ ইউরোর স্থলে রসিক ট্যাক্সিওয়ালা ৩৫ ইউরো লুটে নিলো। ঘরে ঢুকেই ছাতার একটু ফ্রেশ হবো, কিন্তু ওদিকে পুজোর লগ্ন গড়িয়ে যায়, পেটপুজোর কথা বলছি। চো চো করা পেট নিয়ে বের হলাম, রাত তখন দুটো তো হয়েছেই। সড়কে মানুষ আর যান থাকলেও দোকানপাট তেমন খোলা নেই। নতুন কোন দেশ বা শহরে বেড়াতে গেলে সেদেশের স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার চেখে দেখার অভ্যাস অনেকের মত আমারও। আর টাকা দিয়ে ভারতীয় বা বাঙ্গালি খাবার খাওয়ার লোক আমি নই। সে তো রোজই বাসায় করে খাই! কিন্তু আগেই বলেছি, ভাগ্যের দেবতা আমার প্রতি দরদী হয়েছে, দেবতা নিজেও একথা দাবী করার দুঃসাহস দেখাবে না। অত্র অঞ্চলে সব বন্ধ, কিন্তু আলো আঁধারির শহরে দুটো জ্বিন দোকান খোলা রেখেছে,গিয়েই দেখি দুটি জ্বিনই বাঙ্গালি জ্বিন। বাঙ্গালি জ্বিনের সাথে দেখা হয়েছে আর সেখানে ঘণ্টা দুয়েক গালগপ্পো হবে না সেও কি সম্ভব! কথায় কথায় রাত তিনটে। ওখান থেকে স্যান্ডউইচ কিনে বাইরে দাঁড়িয়ে খাচ্ছি, দেখি বাংলা গান “তুই কি আমার হবিরে…” ভেসে আসছে। পেয়ে গেলাম আরো তিনজন বাংলাদেশি। ওদের থেকেই শুনলাম এই এলাকায় বাংলাদেশিতে ভর্তি।
পরদিন ঘুম ভাঙ্গলো দেরিতেই। মাদ্রিদের এক যুবক আমার অফিসের কলিগ। ওর থেকে আগেই তালিকা করে নিয়েছিলাম কোথায় কোথায় ঘুরবো। সেমতে প্রথমেই গেলাম পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ বিখ্যাত ওদের জাতীয় জাদুঘরে। ওখানে আছে ফ্রান্সিসকো গোয়ার কিছু কাজ। ওঁর নাম আমি শুনেছি আগে, সচক্ষে এবার দেখলাম।
এছাড়া জানতাম দিয়েগো ভেলাস্কেজের “Las Meninas” (ইংরেজিতে The Ladies-in-waiting) ওখানে। পৃথিবীতে এই চিত্রকর্মটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে। আর্টের “অ”-ও বুঝি না, কিন্তু লোকে বলে মিউজিয়ামে গেলে নাকি ফেসবুকীয় সমাজে সম্মানবৃদ্ধি হয়। যাহোক, এখানে ১৫ ইউরো টিকেট লাগে।
সেখান থেকে স্কুইড স্যানউইচ খেতে গেলাম প্লাজা মেয়রের সাথেই La Ideal- এ, এটা একটা ধ্রুপদী স্প্যানিশ বার যেখানে মুখরোচক খাবার পাওয়া যায়। আমার কলিগের প্রস্তাবিত তালিকায় এটা আবশ্যক ছিল। এর মাঝেই সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সুর্যাস্ত দেখতে যেতে হবে Círculo de Bellas Artes। এটাও একটা বার। এখানকার টেরাসে বসে এক কাপ কফি পান করতে করতে সুর্যাস্ত দেখার দৃশ্য আমি বহুদিন মনে রাখব।এরপর প্ল্যান হল বাসায় চলে যাব, গাও গোসল করে আবার রাতে বের হব রাতের মাদ্রিদ দেখতে।
বাসায় এসে আরেক কাণ্ড। যে বাসায় উঠেছি সেখানে তিনটে ঘর। দেখি পাশের ঘরে নিউইয়র্ক থেকে একজন আফ্রিকান-আমেরিকান এসেছে দুই দিনের জন্য। কথায় কথায় বলল, ওঁর কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই, আমারও নেই। দুজনেই চললাম একসাথে প্রায় মধ্য রাতের দিকে। Chueca নামের এক এলাকায় হাজারো বার, ডান্স ক্লাব, রেস্টুরেন্ট। আমার ইচ্ছে হল সবগুলোতেই ঢুকবো একবার করে। টিকেট কেটে একটাতে গিয়ে কিছুক্ষণ বসলাম। এত বিকট শব্দে টেকনো সঙ্গীত বাজছে, দুজনেই বধির হয়ে বেরিয়ে আসলাম।
বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। এমতাবস্তায় স্পষ্ট বৃটিশ উচ্চারণে এক তরুণ ঢুলতে ঢুলতে এসে জিজ্ঞেস করছে, ওহ তোমরা ইংরেজিতে কথা বলছ? আমাকে হেল্প করো। আমি মাতাল হয়ে গেছি, আমার বন্ধু কোথায় কি করে পুলিশের কাছে ধরা। আমাকে দয়া করে হোটেলে নিয়ে যাও। মাতাল হলেও তালে ঠিক, ঠিকঠাক হোটেলের ঠিকানা আমাদের দিল, গুগল করে দেখলাম দশ মিনিটের হাঁটাপথ। আমেরিকার ওই যুবক ডিভান্তে, এশিয়ার এই আমি, বৃটিশ যুবা জর্ডানকে দুইপাশে ধরে ধরে হাঁটা শুরু করলাম। দুই মিনিটও হাঁটা হয়নি, সে আরেকটা বারে ঢুকে মদ্যপান করবে। ঢুকলাম। আমি নিলাম বিয়ার ওরা নিলো জিনটোনিক। কথায় কথায় জানলাম, গেল সপ্তাহেই ওঁর বয়স বিশে পড়েছে। তাঁর মা বাপ বৃটিশ, কিন্তু থাকে সুইজারল্যান্ডে। ওখান থেকেই মাদ্রিদ ঘুরতে এসেছে এক বন্ধুকে সাথে করে। ভাগ্যবান বন্ধুটি এখন গারদে পুলিশের আতিথেয়তা উপভোগ করছে!
যাহোক, জিনটোনিকে চুমুক দিয়েই জর্ডান হড়হড় করে বমি করে দিল পেয়ালার ভেতরেই! ভাবলাম পানাপানি বহুত হল, এবার জর্ডানকে হোটেলে রেখে আপদ বিদেয় করি। হোটেলে গিয়েই ধপাৎ করে সে বিছানায় চলে গেল, আমরা চলে আসতেই আমাদের ইন্সটাগ্রামে যুক্ত করে নিল।
পরদিন রবিবারে সকালেই দেখি জর্ডানের মেসেজ। আমাকে আর ডিভান্তেকে কৃতজ্ঞতার বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে বলছে আমাদের সাথে আবার দেখা করতে চায়। শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝেই একটা বিরাট পুল আছে সেখানে সাঁতার কাটতে যাবে। সেদিন আবার অত্যাধিক গরম, ভাবলাম জলকেলি করে আসি। গিয়ে আমি সামান্য অবাকই হলাম, হবোই বা না কেন? এর আগে বার্লিনে এখানে সেখানে দুই চারজন নগ্ন মানুষ আমি দেখেছি, কিন্তু হাজার হাজার নয়! হ্যাঁ, সত্যি বলছি, ওখানে অজানা সংখ্যক নারী পুরুষ আবালবৃদ্ধবনিতা নগ্ন হয়ে রোদ পোহাচ্ছে, সাঁতরাচ্ছে! সবই করলাম, কিন্তু ভোঁদড় বাঙ্গালির পক্ষে নগ্ন হওয়া কিছুতেই সম্ভব হল না! যাহোক, সেখানেই পরিচিত হলাম নিউজার্সি থেকে আসা নিকের সাথে! নিক একাই ইউরোপ ট্যুরে বের হয়েছে ডিভান্তের মতই। তিন থেকে চারজন হয়ে গেলাম, প্লান হল আজকের বিকেল থেকে সারারাত শহর ভেজে খাব!
মাদ্রিদের দামি পুলে সোনার অঙ্গ ভিজিয়ে যার যার মত আপাতত বাসায় ফিরে গেলাম, রেস্ট করে সন্ধ্যায় বের হলাম। উদ্দেশ্য স্পেনের সব বিখ্যাত আর মজাদার খাবার খাওয়া। সারা শহর হেঁটে হেঁটে ক্ষুধা বাড়ানো হল, বিশ্বাসযোগ্য, নির্ভরযোগ্য স্প্যানিশ রেস্টুরেন্ট খুঁজে পাওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য, যাতে করে খাবারও একদম স্থানীয় হয়। বহু মরোক্কান, পাকিস্তানি বা ভারতীয় “অথেনটিক স্প্যানিশ রেস্টুরেন্ট” দিয়ে বসে আছে, সেসবে যাওয়ার ইচ্ছে কারোর নেই। অবশেষে পেলাম একটা। কেউ স্পেনে গেছে অথচ পায়েলা (এটাকে ওরা piaya অথবা Paella বলে) খেয়ে ফেরেনি, এমন হতচ্ছাড়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই! এটা আসলে আমাদের খিচুরির স্প্যানিশ ভার্সন বলা যায়। উপরে শুধু সীফুড ছড়ানো থাকে। খাওয়া হলে আমরা ঢুকলাম একটা বারে, ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধ থেকে জর্ডানের মত তরুণ নৃত্যগীতে মেতে উঠেছে। আমরাও যোগ দিলাম।
লেখাটির কলেবর বড় হয়ে যাচ্ছে। শেষ করবো বৃটিশ মাতাল তরুণের কথা দিয়েই। এই বয়েসে সে যে কতকিছু করে, তার ইয়ত্তা নেই। জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস সাইন্স নিয়ে পড়ে, দুনিয়ার প্রায় অর্ধেক দেশ ঘোরা ওঁর শেষ, ১৪ বছর বয়স থেকে টুকটাক কাজ করে আয় করা শুরু। আঠারো হওয়ার পর থেকে আজ অব্দি বাপের পকেট থেকে একটা পয়সা নেয়নি। যা কিছু মাথায় আসে তার সবই মোবাইলে নোট করে রাখে। তার মাথায় অবাককরা সব আইডিয়া গিজগিজ করে, আর একটা মুহুর্তের জন্যেও সে কথা বলা বন্ধ করে না। যে দেশেই যায়, সেখানে নিজের হাতে কিছু একটা হ্যান্ড ক্রাফট বানিয়ে বাড়ী ফেরে। মাদ্রিদে ওঁর প্লান একটা ল্যাম্প বানিয়ে নেবে। নানারকম স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে জড়িত। মুসলিম দেশগুলো থেকে আসা শরণার্থী শিশুদের শিক্ষার জন্য কাজ করে। সতেরো বছর বয়সে ভার্জিনিটি হারিয়েছে সহপাঠীর সাথে, তাও টয়লেটের ভেতর। ফ্যান্টাসি হল বনে বাদাড়ে যৌনকর্ম সারা। ইতিমধ্যে আটজনের সাথে শুয়েছে, এর মধ্যে দুইজনকে সে মন থেকে ভালবেসেছে।
এই লেখা আপনারা যখন পড়ছেন তখন আমার বার্সেলোনা ঘোরাও শেষ করে বার্লিন রওনা করেছি। বার্সেলোনার কথা আরেকদিন পাড়া যাবে।
২৩ জুলাই ২০২১
জাহিদ কবীর হিমন
সম্পাদক, জার্মান প্রবাসে