একটু আগে আমার ল্যাবে কাজ করা একজন প্রাক্তন ছাত্রের সাথে ফোনে কথা হল। আলাপ করে জানতে পারলাম, সে এখন সিমেন্সের হেড কোয়ার্টারে পিএলসি প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করছে। বলাবাহুল্য, সিমেন্সের পিএলসি ডিভাইস অটোমেশন দুনিয়ার বিখ্যাতদের একটি।

মনে পড়ে গেল বছর দুয়েক আগের কথা। আমার চাকরির বয়স তখন ৫ মাসের মত। আমাদের সদ্য প্রতিষ্ঠিত কন্ট্রোল ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবে অনেকগুলো নতুন পিএলসি ডিভাইস ও মাস্টার প্রোডাকশন সিস্টেম ইন্সটল করতে হবে। পার্শ্ববর্তী ইউনি থেকে আসা ৩৫ বছর বয়সী মাস্টার্সের ছাত্র মেতিন তার থিসিস প্রজেক্ট হিসেবে আমাদের ল্যাবে কাজ শুরু করেছে। তুরস্কের নাগরিক মেতিনের ৫ বছর বয়সী একটা ছেলে রয়েছে। ইস্তাম্বুলে কয়েক বছর ধরে পিএলসি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় জার্মানীতে মাস্টার্স করতে আসে সে। বিনা বেতনে থিসিসরত মেতিন উইকেন্ডে কাজ করে ও তার বউয়ের পার্ট টাইম কাজের আয় দিয়ে কোন রকমে দিনানিপাত করছিল। প্রোগ্রামিং এর প্রতি প্রবল আগ্রহ থাকায় মাসখানেক পরে আমি জবের পাশাপাশি ওর কাছে পিএলসি প্রোগ্রামিং শিখতে লাগলাম। বিনিময়ে তাকে প্রতিদিন দুপুরে অফিসের কফি খাওয়াতে হত।

কিছুদিন পরে লক্ষ্য করলাম যে, সে আমাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছে। পরিচিত হিসেবে তার প্রতি একটা সিম্প্যাথি থাকলেও তার এহেন মানসিকতা আমার পছন্দ হলনা। তাকে কফি খাওয়ানো বন্ধ করে দিলাম ও নিজে নিজেই প্রোগ্রামিং শিখতে লাগলাম। তবে তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে লাগলাম।
তার আসল সুপারভাইজার ছিলেন আমার বস ও প্রফেসর এবং একজন জার্মান সহকর্মী। মাঝেমধ্যেই তার কাজের আপডেট নিতে লাগলাম। তাকে আমার কাছে অনেক দক্ষ মনে হল। তবে প্রফেসরের কয়েকদিন পরপর নতুন কাজ চাপিয়ে দেওয়াটাকে তার পছন্দ হয়নি বলে প্রতীয়মান হল।

মাস পাঁচেক পরে তার থিসিসের প্রেজেন্টেশন হল। অফিসে ফিরতেই আমার কলিগকে জিজ্ঞেস করলাম,”মেতিনের প্রেজেন্টেশন কেমন ছিল?”
“প্রফেসর তাকে ৩.৩ গ্রেড (প্রায় ৫৫% নাম্বার) দিয়েছেন।”
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি সিরিয়াস?”
“হ্যা। তবে তার গ্রেড যুক্তিসংগত।” গম্ভীর মুখে কলিগের প্রত্যুত্তর।
চেয়ারসহ তার ডেস্কের পাশে গিয়ে বললাম, “কাহিনী কি, বলোতো।”
“সে ভাল জার্মান বা ইংলিশ কোনটাই পারেনা (এটা সত্যি)। ডকুমেন্টেশনের কোন আগামাথা নেই। নিজে অনেক জটিল প্রোগ্রামিং করলেও সে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো – ইলেক্ট্রিক্যাল বা নিউমেটিক কানেকশনগুলোও ঠিকমত হয় নাই। নাট-বল্টুগুলোও ঠিকমত টাইট দিতে পারেনি সে।” তার কন্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ল।

আমি তার সাথে দ্বিমত করলাম না। কারণ এ ব্যাপারগূলো আমি আগে থেকেই লক্ষ্য করেছি।
“তুমি দেখে নিও, এই ছেলে কোথাও চাকরি পাবে না, পেলেও বেশিদিন টিকবে না।” কলিগের ভবিষ্যত বাণী!

কথা না বাড়িয়ে নিজের ডেস্কে ফিরে এলাম।
বলাবাহুল্য, পরবর্তিতে তার কাছ থেকে শেখা জ্ঞান দিয়ে তারই ইন্সটল করা মাস্টার প্রোডাকশন সিস্টেমের উপর একটি মাস্টার্স প্রজেক্ট সফলভাবে সুপারভাইজ করেছি।

সেদিনের মেতিন কিভাবে এত ভাল কোম্পানিতে দেড় বছর ধরে চাকরি করছে সেটা জানার জন্য প্রচন্ড উতসাহ বোধ করছি। পরশু হয়ত তার সাথে দেখা হবে। ভাবছি, খুব শীঘ্রই আমার সেই কলিগকে মেতিনের চাকরির সুসংবাদটা দেব!

মোরাল: কাউকে আন্ডারএস্টিমেট করতে নেই। চেষ্টা ও মেধা থাকলে জীবনে সফল হওয়া তেমন কঠিন কিছু নয়। বাকিটা ওরা সাথে কথা বলে জানাবো।

আমার মনে হয়েছে যে, অত্যধিক কাজের চাপে এবং আমাদের এখানে সবকিছু নতুন ও অগোছালো হওয়ায় সে বোধহয় খেই হারিয়ে ফেলেছিল।

mm

By Shariat Rahman

আমি বর্তমানে রাইন-ওয়াল ইউনিভার্সিটি অফ এপ্লায়িড সাইন্সে সায়েন্টিফিক এসিস্ট্যান্ট (Wissenschaftlicher Mitarbeiter) হিসেবে কাজ করছি। ২০০৯ সালে বুয়েট থেকে আইপিইতে ব্যাচেলর আর ২০১২ সালে রাইন-ওয়াল ইউনিভার্সিটি অফ এপ্লায়িড সাইন্স থেকে বায়োনিক্সে মাস্টার্স সম্পন্ন করি। অবসর সময়ে সোস্যাল মিডিয়া, আড্ডাবাজি আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করি।