২৫শে এপ্রিল ২০১৫, জার্মানি এর মাটিতে পা দেওয়ার ১৭তম দিন। ইউনিভার্সিটি ওয়েব সাইটের ইন্টারন্যাশনাল অফিস সেকশন থেকে “Just Arrived” গাইড দেশে থাকতেই ডাউন-লোড করে মোটামোটি মুখস্থ করে ফেলায় “ZiS” এর ইভেন্ট গুলো সম্পর্কে ধারনা ছিল। জানা ছিল ছিস প্রতি মাসেই একটা এক্সকারশনে যায়। এপ্রিল মাসের এক্সকারশনটা ছিল ২৫ তারিখে, জারল্যান্ড স্টেটের বিভিন্ন টুরিস্টিক যায়গাগুলোতে যাওয়া। ভ্রমণের নেশাটা যেহেতু জিনের মধ্যে বিদ্যমান আর কম খরচে স্টেট ঘুরে দেখার সুযোগ সামনে আসতেই দেরী না করে এক্সকারশনের জন্যে রেজিস্ট্রেশন করে ফেললাম।
নির্দেশনা অনুযায়ী সকাল সাতটাতেই ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে পৌঁছে গেলাম। বাস পৌঁছানোর পরে ছিসের ৩ জন ভলান্টিয়ার, একজন পেশাদার গাইড এবং ছাত্র/ছাত্রী মিলিয়ে ৩৫/৪০ জনের একটি দল হিসাবে আমাদের এক্সকারশন শুরু হোল। আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল রোমারমুজিয়ম সোয়াতছনাকার। বাস চলতে শুরু করার পরেই গাইড প্রথমে ডয়েচে এরপরে ইংরেজিতে জারল্যান্ডের ইতিহাস বর্ণনা করতে শুরু করল। ওনার কথা শুনতে শুনতেই পৌঁছে গেলাম রোমারমুজিয়ম সোয়াতছনাকার।
রোমারমুজিয়ম সোয়াতছনাকার মূলত একটি রোমান ভিকাস (উপশহর) এর ধ্বংসাবশেষ, যেখানে খনন করে পরবর্তীতে মিউজিয়াম বানানো হয়েছে। ধারনা করা হয় যিশুখ্রিস্টের জন্মের সময় থেকে শুরু করে ২৭৫ বছর পর পর্যন্ত এই শহর বহাল তবিয়তে টিকে ছিল। এই উপশহর ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয় জার্মান আলেমান্নি উপজাতিকে।
গেট দিয়ে ঢুকতেই একটা পাথরের মূর্তি, তরবারি হাতে একজন ঘোড়সওয়ার। সামনে যেতেই মাথার যায়গাটা দেখলাম কিছুই তেমন বোঝা যাচ্ছে না। অজ্ঞতার কারণেই ভাবলাম এত পুরনো মূর্তি যখন নিশ্চয় ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু আসল ঘটনা যানতে পারলাম গাইড মুখ খোলার পরে। এটা একজন রোমান রাজার মূর্তি। রোমান সময়ে নিয়ম ছিল নতুন কেউ রাজা হলে তার নামে নতুন মুদ্রা প্রচলন করে সব দিকে ছড়িয়ে দেওয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের সব শহর বা উপশহর গুলোতে রাজার মূর্তি স্থাপন করা। এটা করা হত মূলত রাজার পরিবর্তন সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিত করার জন্যে। তো এই রাজার ক্ষেত্রেও নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি, উনি শাসনভার গ্রহণ করেছেন এই খবর সোয়াতছনাকারে পৌঁছোবার পরে ওনার জন্যেও মূর্তি বানানো শুরু হয়। তবে ওনার দুর্ভাগ্য, শাসনভার গ্রহণ করবার কিছুদিন পরে ক্যু করে ওনাকে হত্যা করা হয় এবং নতুন একজন শাসনভার গ্রহণ করেন। এই খবর যখন সোয়াতছনাকারে পৌঁছল মূর্তিটিতে আর কোন কাজ না করে ওভাবেই রেখে দেওয়া হয় যেটা এখনো সেভাবেই আছে।
এরপরে পা বাড়ালাম বাসস্থানের ধ্বংসাবশেষের দিকে। এর মধ্যে একটা ঘর দেখলাম বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে, জানতে পারলাম সাধারণ নাগরিকদের বাসস্থানের মধ্যে এই ঘরটি সব থেকে সম্পদশালী ব্যক্তির ছিল। স্বাভাবিক ভাবেই ঘরটি সব থেকে আরামদায়ক এবং কারুকার্যপূর্ন ছিল। সেটা প্রমাণ করার জন্যেই বোধহয় জানালাতে এখনো রঙ্গিন কাচ টিকে আছে। আর অবাক হয়ে গেলাম সেই সময়ের হিটিং সিস্টেম দেখে, বেশ চতুরতার সঙ্গে মেঝের নিচে এবং দেওয়ালের সঙ্গে হিটিং সিস্টেমের সংযোগ। গাইড আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, আমরা কেউ অনুমান করতে পারব কিনা বাসাটি কার ছিল? আমাদের নিরুত্তর দেখে উনি জানালেন রোমান ভিকাস গুলোতে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সব থেকে সম্পদশালী ছিলেন চিকিৎসকরা। এই ঘরে পাওয়া চিকিৎসা সম্পর্কিত টুলস দেখে অনুমান করা হয় এটাও একজন চিকিৎসকেরই বাসা ছিল। বুঝলাম চিকিৎসক এবং সম্পদের সম্পর্ক বেশ পুরনো 😉
সেখান থেকে পা বাড়ালাম মিউজিয়ামের দিকে। ঘুরেঘুরে দেখলাম রোমান সময়ের তৈজসপত্র, জুতা, প্রসাধনী, কাপড় ইত্যাদি। এরমধ্যেই গাইড ডাকলেন মুদ্রার বাক্সের কাছে। যাওয়ার পরে কাচের ভেতর এক পাশে রাখা কিছু মুদ্রা দেখিয়ে বললেন এগুলো অন্যান্য মুদ্রাগুলো থেকে আলাদা, কারণ মুদ্রাগুলোতে রাজার মুখাবয়বের পরিবর্তে রানীর মুখাবয়ব ব্যাবহার করা হয়েছে। এরপরে উনি ছবি বের করে আরো কিছু এমন মুদ্রা দেখিয়ে পেছনের ঘটনা বর্ণনা করলেন। সাধারণত রাজার প্রভাবশালী রানী-গন নিজেদের মুখাবয়বের মুদ্রা বের করার সুযোগ পেতেন। এই মুদ্রাগুলো সম্পর্কে ভিকাসগুলোতে বসবাস করা রমণীদের বিশেষ আগ্রহ ছিল। কারণ মুদ্রাতে দেখে তারা বুঝতে পারতেন রাজধানী রোমে এখন কি ধরেনের চুলের সজ্জা আধুনিক হিসেবে বিবেচিত।
বের হয়ে আগালাম সরাইখানার দিকে। জানতে পারলাম তখনকার দিনে বেশিরভাগ মানুষ বাসায় রান্না করতনা, তিন বেলাতে সরাইখানাতেই খাবার খেত। বিশাল বিশাল মদের পিপেগুলো রাখার কারণটাও তখন পরিষ্কার হয়ে গেলো। আর এর মধ্যেই শেষ হোল আমাদের প্রথম গন্তব্য রোমারমুজিয়ম সোয়াতছনাকার অভিযান।
কিছুক্ষণ বাস ভ্রমণের পরে আমরা পৌঁছে গেলাম আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য বিলিসকাস্টেল। এটি ফ্রান্সের লে ক্রুজো এবং ইতালিয়ের কাস্তেল্লাবাতের “টুইন টাউন”। এখানে টুইন টাউন মানে দেখতে একরকম হতে হবে তা নয়, বরং এটি দুই বা ততোধিক শহরে মধ্যে সম্পাদিত আইনি বা সামাজিক চুক্তি যা শহরগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আদান-প্রদানের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখে।
শহরটার প্রধান আকর্ষণ বিলিসকাস্টেল মনেস্ট্রি। এটি তীর্থযাত্রীদের কাছে এই অঞ্চলের অন্যতম পুণ্যস্থান হিসাবে বিবেচিত হয়। বাস থেকে নেমে অনেকটা খাড়া পথ পায়ে হেটে পৌঁছলাম মনেস্ট্রিতে। এটাই আমার প্রথমবারের মত কোন ইউরোপিয়ান চার্চ দর্শন। পুণ্যের ব্যাপারে কিছু জানিনা, তবে এর নির্মাণশৈলী আমাকে মুগ্ধ করেছে। সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে নিচে চলে আসলাম লাঞ্চ ব্রেকে কিছু খেয়ে নেওয়ার জন্যে। একটা টার্কিশ দোকানে ঢুকলাম, একটু পরেই সেখানে আসলো ছিসের ভলান্টিয়ার লিনা আর মুস্তাফা এবং ওদের পরপরই চার কোরিয়ান। সবাই এক সঙ্গে খেয়ে ফিরে গেলাম বাসের কাছে।
সবাইকে পেটের মধ্যে ঢোকানোর পরে বাস রওনা হল জারশ্লাইফের উদ্দেশ্যে। ঘণ্টা দেড়েকের মত সময় লাগবে, তাই কিছুক্ষণ পরেই দেখি প্রায় সবাই ঘুম। কি আর করার, একাএকাই বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলাম।
জারশ্লাইফকে বলা হয় জারল্যান্ড স্টেটের সব থেকে বেশি পর্যটক আকর্ষক স্থান। মূলত জার নদী এখানে একটা লুপের মত তৈরি করেছে। ক্লোফ নদীপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০ মিটার উঁচুতে, আর এই ক্লোফ থেকেই লুপটা দেখা যায় সব থেকে ভালো ভাবে, রৌদ্রজ্জ্বল দিনে অসম্ভব সুন্দর এক দৃশ্যপট। দিন দশেক আগে মানে ১৪ই এপ্রিল আমি একা এসে এখান থেকে ইতোমধ্যে ঘুরে গিয়েছি একবার, যায়গাটা মোটামোটি চেনাই ছিল। আগে আগে যেয়ে একটু আশেপাশে ঘুরে নিলাম তাই। তবে জারশ্লাইফের ক্লোফে গাড়িতে করে যাওয়ার থেকে অনেক অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং মেটলাক থেকে পাহাড়/জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্র্যাকিং করা। যেটা আমরা করেছি বিগত ২৪শে ডিসেম্বর, যেদিন সারাদিনে ২৫+ কিমি হেঁটেছি। তবে সেই গল্প আরেকদিন বলা যাবে।
এরপরে আবারো বাস, গন্তব্য ভিলা বগ। এখানে একটি রোমান ভিলার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো যেগুলোকে পরবর্তীতে সংস্কার করে অনেকটা আগের চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বর্তমানে অবশ্য এটাকে অনেকটা বাজার বানিয়ে ফেলা হয়েছে। ভিলার ভেতর বা বাইরে তাঁবু টানিয়ে কয়েক ডজন দোকান দেওয়া হয়েছে, যেখানে বর্তমান সময়ে তৈরি রোমান সামগ্রী বিক্রি করা হয়। কথাটা হয়ত অনেককেই বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। আসলে সামগ্রী গুলো রোমান সামগ্রীর আদলে তৈরি করা হলেই সবে তৈরি করা হচ্ছে এখন।
সেখান থেকে শেষ গন্তব্য একটি ভিনিয়ার্ড কাম রেস্টুরেন্ট। আমাদের রাতের খাবার আয়োজন করা হয়েছে সেখানেই সেই সঙ্গে ৬ রকম ওয়াইন আন-লিমিটেড টেস্ট করার সুযোগ। বেশিরভাগ খাবারই শূকরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তাই চিজ, ব্রেড আর টার্কি দিয়ে ডিনার শেষ করলাম। দুইরকম ওয়াইন টেস্ট করে সেটাতেও ক্ষান্ত দিলাম। তবে আমার ঠিক উল্টো দিকেই বসা কিরগিজিস্তানের আয়নাজ একের পর এক গ্লাস শেষ করে যাচ্ছিল। ইফেক্ট টের পাওয়া গেলো একটু পরেই, যখন অল্প করানেই ও হো হো করে ননস্টপ হাসতে শুরু করলো।
ফেরার সময় ওয়াইন ইফেক্টের কারণেই বোধহয় বাসের ভেতরের পরিবেশ একদম চেঞ্জ হয়ে গেলো, অনেকটা বাংলাদেশের পিকনিকের বাসের মত। আয়নাজ আর ছিসের ভলান্টিয়ার অ্যালেক্সী উচ্চমার্গে চলে যাওয়ার কারণে প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ গান গাইল, এর পরে বাসের মধ্যেই শুরু করল নাচ, আর আমি মর্তে থাকার কারণে শুধু পরিচিত গান গুলোতে গলা মিলিয়ে আর তবলা বাজিয়ে ওদের উৎসাহ দিয়ে গেলাম। প্রথম থেকেই ওরা গান গাচ্ছিল যা সব ছিল ইংরেজি গান। হটাত করেই দুইজনে শুরু করল রাশিয়ান গান। চিন্তা করে দেখলাম তাহলে আর বাংলাদেশি গান বাকি থাকে ক্যান? ওরা থামার পরে শুরু করলাম “এই দূর পরবাসে” । আয়নাজ সহ পেছেনে যারা ছিল তারা সব হইহই করে উঠল। একে হইহই এর জন্যে, দুই হটাত করেই সম্পূর্ণ অপরিচিত ভাষা শুনে সামনে যারা ছিল তাদের বেশির ভাগি দেখি পেছন দিকে ঘুরে তাকিয়েছে। তাই গান শেষ হওয়ার পরে আমাকে কোথাকার গান এটা এবং ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হল। সেদিন রাতে এক ভনহাইমে পার্টি ছিল, তাই আমি সহ কয়েকজন ইউনিভার্সিটিতে না গিয়ে নেমে যাচ্ছিলাম ভনহাইমের বাসস্টপে, দরজার কাছে যখন পৌঁছেছি গানের জন্যে বাসেরগুলো চিৎকার করে উঠলো “চিয়ার্স বাংলাদেশ”। স্বাভাবিকভাবেই অসম্ভব ভালো লাগার মধ্যে দিয়ে শেষ হল আমার জারল্যান্ড অভিযান।
পূর্ববর্তী পর্বঃ ইতালি
পূর্ববর্তী উপপর্বঃ ভেরোনা ও লনিগো
পরবর্তী পর্বঃ ফ্রান্স
পরবর্তী উপপর্বঃ ফোরবাক