তাওহিদুল ইসলাম এবং স্ত্রী সায়লা আলম সুইডেনে থাকেন। দেশে বেড়ানো শেষে আজ সকাল ৬.১৫ মিনিটে টার্কিশ এয়ারলাইন্স যোগে এ দম্পতির সুইডেন ফেরার কথা ছিল। ভোর সাড়ে চারটায় তাঁরা টার্কিশ চেক-ইন কাউন্টারে লাইনে দাঁড়ান। ৫.০৭ মিনিটে তাঁরা কাউন্টারে পাসপোর্ট-টিকেট সাবমিট করতে সক্ষম হন। ৫.০৯ মিনিটে তাদের নাম সিস্টেমে এন্ট্রি করা হয়।
সমস্যা দেখা দেয় ব্যাগেজ বুকিং দিতে গিয়ে। দু’জনে ৪৬ কেজি করে মোট ৯২ কেজি লাগেজ এলাউড। এয়ারলাইন্সের নিয়ম অনুযায়ী লাগেজের সংখ্যা নির্ধারিত নয়, তবে কোনও লাগেজ ৩২ কেজির ওপরে যেতে পারবে না। দু’জনের কাছে মোট চারটা লাগেজ ছিল, যার সর্বমোট ওজন ৮০ কেজিরও কম। তাওহিদুল এর বক্তব্য মতে, বাড়ি থেকে মেপে আনা চারটি লাগেজের মধ্যে সবচেয়ে বড় লাগেজটির ওজন ছিল ৩০ কেজি। কিন্তু কাউন্টারে ওজন মাপার যন্ত্রে রিডিং আসে ৩৮ কেজি। হতভম্ভ যাত্রীর কাছে বিষয়টি অসম্ভব মনে হলে তিনি লাগেজটি পাশের দ্বিতীয় মেশিনে ওজনে দেন, সেখানে রিডিং আসে ৩০ কেজি। অতঃপর কাউন্টার অন্য এক নারী অফিসারের নির্দেশমতে তিনি লাগেজটি তৃতীয় মেশিনে ওজনে দেন, সেখানেও রিডিং আসে ৩০ কেজি। কিন্তু প্রথম অফিসার এটা মানতে রাজি নন। প্রথম মেশিনের রিডিং অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে তিনি অনড়।
ইতিমধ্যে ৫.১৫ মিনিটে এয়ারলাইন্সের টার্কিশ ডেপুটি ম্যানেজার এসে ঘটনা শুনে সংশ্লিষ্ট অফিসারকে ইংরেজিতে শাউট করে তাৎক্ষণিক কাউন্টার ক্লোজ করে চলে যেতে বলেন এবং তিনিও চলে যান। এদিকে আতংকিত ঐ দম্পতি অফিসারদের পেছনে পেছনে দৌঁড়ে গিয়ে অনুরোধ করে এক মিনিট সময় চান এবং বলেন, বড় লাগেজের অতিরিক্ত মাল ফেলে দেবেন কিংবা ছোট লাগেজে নেবেন। অফিসাররা উল্টো তাঁর উপর বিরক্ত হয়ে কর্কশ ভাষায় তাকে চলে যেতে বলেন এবং রিজার্ভেশন অফিসে গিয়ে দুই টিকেটে ২২ হাজার টাকার মতো নোশো ও চেইঞ্জিং চার্জ দিয়ে টিকেট করে নিয়ে আসতে বলেন। নিরুপায় হয়ে তারা ফিরে যাচ্ছিলেন রিজার্ভেশন অফিসে।
পথিমধ্যে তাওহিদ ফোন দেন তার বন্ধুদের কাছে। বন্ধুরা তাকে ম্যাজিস্ট্রেটস অল এয়ারপোর্টস অব বাংলাদেশে নক করার পরামর্শ দেন। তাওহিদুল তখনই ফেসবুক পেইজ থেকে একটি নাম্বার নিয়ে সকাল ৮টার দিকে ফোন করেন বিমান বন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফকে। ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনা শুনে তাঁকে রিজার্ভেশন অফিসে না গিয়ে কোর্টে আসার পরামর্শ দেন এবং তিনিও তৎক্ষণাৎ অফিসে রওয়ানা দেন।
ইতিমধ্যে তিনি টার্কিশ এয়ারলাইন্সকেও খবর দিয়ে রাখেন, যাতে মিউচুয়ালি বিষয়টি নিষ্পত্তি করে দেয়া যায়। যাত্রীরা আসলেও এয়ার লাইন্সের দায়িত্বশীল অনেকেই আদালতে আসতে অনীহা প্রকাশ করছিলেন। সিসিটিভি দেখে তিনি যাত্রীর কথার সত্যতা পান এবং সংশ্লিষ্ট অফিসারও তা স্বীকার করেন। ম্যজিস্ট্রেট সেই অফিসারকে আইন অনুসারে যাত্রীদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ ও থাকা-খাওয়া সহ টিকেটের ব্যবস্থা করে দিয়ে সমঝোতার ভিত্তিতে বিষয়টি নিষ্পত্তি করে ফেলার অনুরোধ করেন। কিন্তু এয়ারলাইন্সের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। তাদের বক্তব্য, টার্কিশের কোনও দোষ নেই।
এরপর বসানো হলো মোবাইল কোর্ট। যে বিষয়গুলো উঠে আসে মোবাইল কোর্টে-
১। ডিপার্চারের একঘণ্টা পূর্বে অর্থাৎ ৫.১৫ মিনিটে কাউন্টার ক্লোজ করার অর্থ এই নয় যে, কাউন্টার বন্ধ করে অফিসার চলে যাবে। এই বন্ধ করার অর্থ হলো, এর পর আর কোনও প্যাসেঞ্জার অ্যাকসেপ্ট করা যাবে না। বরং সময়ের ভেতরে শেষ দিকে আসা প্যাসেঞ্জারের বোর্ডিং পাশ ইস্যু করতে আরও ১৫ মিনিট কাউন্টারে থাকা বাঞ্ছনীয়। আর সেই সময় হিসেব করেই ডিপার্চার টাইমের কমপক্ষে ৪৫ মিনিট পূর্বে ইমিগ্রেশনে ঢোকার টাইম নির্ধারণ করা হয়েছে।
২। যাত্রী নির্ধারিত সময়ের ৬ মিনিট পূর্বেই চেক-ইন করেছেন।
৩। তিনটি ওয়েট-মেশিনের মধ্যে দু’টির রিডিং এবং যাত্রীর দাবি একইরূপ। আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য সেখানে ডিউটিরত মেশিন অপারেটরের মতামত নেয়া যেত কিংবা আরও সন্দেহমুক্ত হতে চতুর্থ মেশিনে চেক করা যেত। অথচ পরে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে বাইরের নিরপেক্ষ ওয়েট মেশিনে মেপে রিডিং ৩০ কেজিই পাওয়া যায়। এতে অফিসার কর্তৃক প্রথম মেশিনের সন্দেহযুক্ত রিডিংকে ফাইনাল ধরে যাত্রীর সাথে রূঢ় আচরণ করা অন্য কিছু ইঙ্গিত দেয়।
৪। যাত্রীকে মালামাল অন্য লাগেজ শিফট করা বা ফেলে দেয়ার সুযোগটি পর্যন্ত না দিয়ে কাউন্টার ত্যাগ করা কোনও ধরনের যাত্রীসেবার সংজ্ঞায় পড়ে না।
৫। সবচেয়ে অন্যায় করা হয়েছে, একজন চেকিং করা যাত্রীকে লাগেজের এক্সট্রা ওয়েটের কারণে একান্তই যদি অফলোডই করতে হয়, তাকে অবশ্যই শেষ প্রশ্ন করতে হবে এই ভাবে যে, “সঙ্গত কারণে আমরা আপনার লাগেজ বুকিং নিতে পারছি না, কিন্তু আপনি চাইলে ঐ লাগেজ ছাড়া ফ্লাই করতে পারেন, এটা আপনার অধিকার।” এ ধরনের কোনও প্রশ্ন না করেই তার এন্ট্রি ক্যান্সেল করা বা অফলোড করা সেবার নামে জবরদস্তিমূলক অত্যাচারের পর্যায়ে পড়ে।
৬। উপরন্তু এটা সহজে অনুমেয় যে, ওজন কারসাজি বা নোশো চার্জের লোভে কূটকৌশলী হয়ে কাজটি করা হয়েছে। অভিযুক্ত এয়ারলাইন্সের পক্ষে দুই অফিসার আবু হায়াত মোহাম্মদ আফসান উদ্দিন এবং আব্দুস সাত্তার সিদ্দিক এর স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে দায়িত্ব অবহেলার কারণে সেবা গ্রহীতাগণ প্রতিশ্রুত সেবা না পাওয়ায় এবং তাদের আর্থিক ও মানসিক স্বাস্থ্যহানির ঘটানো বা ঘটানোর চেষ্টার অপরাধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ অনুসারে পৃথক দুজন যাত্রীর পৃথক পৃথক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এয়ারলাইন্সের দুই কর্মকর্তাকে ২ লক্ষ টাকা করে ৪ লক্ষ টাকা জরিমানা করেন, অনাদায়ে প্রত্যেককে তিনমাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদানের আদেশ দেন মোবাইল কোর্টের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ। পাশাপাশি একই আইনের ৭৬ ধারায় জরিমানার ২৫% ক্ষতিগ্রস্তদের প্রদানের নির্দেশ দেন তিনি।
তাওহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, আসলে আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না, আমি বাংলাদেশের বিমানবন্দর থেকে হয়রানি হওয়ার পরে এতো ভালো একটা সার্ভিস পাবো। আমার এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না। এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেটদের এই ধরনের কার্যক্রমে আমি বিস্মিত। ইতোমধ্যে ক্ষতিপূরণের ২৫ ভাগ অর্থ পেয়েছেন বলে তিনি জানান। আদালত সূত্রে জানা যায়, ইতিমধ্যে টার্কিশ এয়ারলাইন্স জরিমানাকৃত ৪ লক্ষ টাকা পরিশোধ করেছে এবং যাত্রী দু’জনও তাদের প্রাপ্য ৫০ হাজার টাকা করে বুঝে নিয়েছেন। টার্কিশ এয়ারলাইন্সের স্টেশন ম্যানেজার এ যাত্রী দম্পতির থাকা-খাওয়া-হোটেল সহ আগামীকাল সকালের ফ্লাইটে তাদের কোনো চার্জ ছাড়াই টিকেট নিশ্চিত করেছেন।
তথ্যসূত্রঃ কালের কন্ঠ