সামার সেমিস্টার ২০১৫ তে ফেসবুকে আমাদের সাতজনের একটা গ্রুপ ছিল, “ফ্রাইরাবান”। সদস্য বলতে ফ্রান্স থেকে আসা ইরাসমুস স্টুডেন্ট ঈয্যূ, কৃটরী, মেলিনা আর মরগ্যান, ইরান থেকে মাস্টার্স করতে আসা ক্যূহীয়ার আর মোহসেন এবং বাংলাদেশ থেকে আসা আমি। মূলত আমাদের প্রোগ্রামগুলোর সমন্বয় করার জন্যে গ্রুপটা করেছিলাম। ১৪ই জুলাই, ২০১৫ সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি গ্রুপে ঈয্যূর পোস্ট। ১৪ই জুলাই ফ্রান্সের ন্যাশনাল ডে বা বাস্তিয়ে ডে, মোটামুটি সব শহরেই দিনটি উদযাপন করা হয়, তাই ও জানতে চাইছে আমরা পাশের ফ্রেঞ্চ শহর ফোরবাকে যেতে চাই কিনা? একের পর এক কমেন্টে প্রোগ্রাম ফাইনাল হয়ে গেলো কিছু সময়ের মধ্যেই।
যেহেতু ফোরবাক আমাদের ট্রাভেল টিকেটে কাভার করেনা তাই ঠিক হল ঈয্যূ ওর গাড়ি নিয়ে যাবে। যাবার সময় ঈয্যূ এর সঙ্গে মেলিনা, মরগ্যান আর আমি ওর গাড়িতে করে যাবো, আর কৃটরী, বেড়াতে আসা ওর বড় বোন জি, ক্যূহীয়ার আর মোহসেন ট্রেনে যাবে। ফেরার সময় অদলবদল করে নেবো যাতে ট্রেন টিকেটে সবারই সমান খরচ হয়।
যথা সময়েই শুরু হল আমাদের যাত্রা। এর আগে একদিন ঈয্যূ এর সঙ্গে ঘুরেছি তাই ফেসবুকের ট্রল ভিডিওগুলোতে দেখে মেয়েদের ড্রাইভিং সম্পর্কে যেই ভীতি ছিল সেটা কেটে গেছে। স্পীড লিমিট না থাকায় হাইওয়েতে উঠে ১৪০/১৫০ কিমি বেগে আমরা উড়ে চললাম ফোরবাকের উদ্দেশ্যে। যেহেতু আমাদের শহর জারব্রুকেন ফ্রান্স বর্ডারের কাছেই তাই খুব অল্প সময় পরেই ফ্রান্সের সীমানায় ঢুকে গেলাম।
ফ্রেঞ্চ বর্ডার ক্রস করার পরপরই যেই দৃশ্য দেখলাম ইউরোপে এটা দেখার মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। বর্ডার ক্রস করার সঙ্গে সঙ্গেই ৩ জনই দেখি গাড়ির কাচ নামিয়ে দিয়ে এক হাত বের করে বাতাসের স্পর্শ নিচ্ছে আর বলছে “ওহ দ্যাট এয়ার”, চিৎকার করে উঠছে “ওহ দ্যাট গ্রাস” বা “ওহ দ্যাট ফ্ল্যাগ” বলে। সামনে যাই দেখছে আবেগে আপ্লুত হয়ে তারই নাম নিচ্ছে। এমন নয় যে ওরা ফ্রান্স থেকে অনেক দূরে থাকে, মাত্রই ১৫ মিনিটের দূরত্ব, তাই বাতাসে কোন পার্থক্য থাকার কথা নয়। আবার এমনও নয় ওরা অনেকদিন পরে ফ্রান্সের মাটিতে ঢুকল। দুই জন ১ সপ্তাহ আগে আর এক জন ২ সপ্তাহ আগে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে এসেছে ফ্রান্সে। বুঝতে পারলাম কতটা গভীর দেশপ্রেম থাকলে একজন মানুষ এমনটা করতে পারে, আর অবাক হয়ে ভাবলাম আমরা মুখে দেশপ্রেমের কথা বললেও আদৌ কতজন এভাবে দেশ কে ভালোবাসি?
সিটি সেন্টারের কাছাকাছিই পার্কিং এর যায়গা খালি পাওয়া গেলো, তাই গাড়ি পার্ক করে পায়ে হেটে অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সিটি সেন্টার। যেয়ে দেখি ট্রেন বাহিনী আমাদের আগেই পৌঁছে গেছে। যেয়ে পরিচিত হলাম জি এর সঙ্গে যেহেতু ওর সঙ্গে এর আগে দেখা হয়নি।
সিটি সেন্টার সুন্দর করে সাজানো হয়েছে তিনকোনা রঙ্গিন পতাকা আর ছোটছোট রঙ্গিন বাতি দিয়ে। মাঝখানের খালি যায়গার একপাশে একটি মঞ্চ করে একদল লোক গান গাইছিল আর তার সামনেই নাচের জন্যে একটা মঞ্চ করা। মঞ্চের চারপাশে বসার জন্যে বেঞ্চ আর টেবিল দেওয়া। একটু পাশেই সারিসারি খাবারের দোকান, আর তার পরেই শুরু হয়েছে বাচ্চাদের খেলনার দোকানের সারি। অন্য পাশে বাচ্চাদের জন্যে নানারকমের ফান রাইড। অনেকটা আমাদের দেশের মেলার মত আবহ।
কিছুক্ষণ মেলার মধ্য দিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে টেবিল এর পাশে যেয়ে দাঁড়ালাম আড্ডা মারা একই সঙ্গে কন টেবিল খালি হয় কিনা সেটা দেখার জন্যে। আড্ডা মারতে মারতে হঠাত খেয়াল করলাম একটা টেবিল খালি হচ্ছে, দেশে যেমন মেহমানের আধিক্য থাকা বিয়ে বাড়িতে ঝাঁপিয়ে পরে টেবিল দখল করা হয় আমরাও তেমনি ঝাঁপিয়ে পরলাম।
বসে আড্ডা মারছি হঠাত শুনি মিউজিকের টোনে একটা পরিবর্তন, একই সঙ্গে দেখি ইয্যূ উঠে দাঁড়িয়েছে। ও জানাল গানটা মূলত ফ্রান্সের এক ট্র্যাডিশনাল নাচের জন্যে, ও নাচের মঞ্চে যেতে চায় আমরা কেউ যেতে চাই কিনা। ভাবলাম নতুন কিছু শেখার সুযোগ কে ঠেলে দেয়া ঠিক না, তাই আমিও উঠে দাঁড়ালাম, আর সেই সঙ্গে মরগ্যান। বাকিরা আর তেমন আগ্রহ না দেখানোতে আমরা তিন জনেই চড়ে গেলাম নাচের মঞ্চে। নাচটা বেশ মজার, প্রথম দিকে তাল মেলাতে একটু কষ্টই হচ্ছিল কিন্তু সহজ হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই উপভোগ করা শুরু করলাম। আমারা বেশ উপভোগ করছি দেখে একটু পরেই দেখি কৃটরী, ক্যূহীয়ার আর মোহসেন আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে।
বেশ কিছুক্ষণ নাচার পরে একটা বর্ণিল বিরতি, যানতাম মূল অকর্ষন আতসবাজি এর প্রদর্শনী কিন্তু সেটা যে এতটা চমকপ্রদ তা চিন্তা করিনি। ঐদিন ছিল আমার দেখা শ্রেষ্ঠ আতসবাজি এর প্রদর্শনী। হুউশ করে আকাশে উড়ে যাচ্ছে একটা আতসবাজি আর আকাশে যেয়ে বিস্ফোরণের পরে একেকটা একেক রূপ আর রঙ ধারণ করছে। আর মাটিতে দাঁড়ানো আমার হাতের ক্যামেরাটাও সমান তালে ক্লিক ক্লিক করে যাচ্ছিল। যদিও একটানা ছবি তুলতে পারিনি চর্মচক্ষেও প্রদর্শনী উপভোগ করার জন্যে। প্রায় একটানা বিশ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল প্রদর্শনীটা।
এরপরে ফিরে এসে আবারো বসে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা চলল। ফেরার সময় হয়ে যাচ্ছিল তাই সিধান্ত হল ফেরার আগে সবাই মিলে একসঙ্গে নাচের মঞ্চে যাওয়ার। কিছুক্ষণ উপভোগ করলাম লাফালাফি। এরই মধ্যে ১১ঃ৩০ বেজে গেলো, আমাদের শেষ ট্রেন কাছাকাছি সময়েই, তাই লাফালাফিতে ক্ষান্ত দিয়ে মেলিনা, মরগ্যান, আমি আর ক্যূহীয়ার বাকিদের থেকে বিদায় নিয়ে আগালাম ট্রেন স্টেশনের দিকে আর বাকিরা এগোল ঈয্যূ এর গাড়ী এর দিকে।
স্টেশনের টিকেট ম্যাশিন ফ্রেঞ্চ ভাষায় তাই মেলিনাকে দায়িত্ব দেওয়া হল টিকেট কাটার জন্যে। কিন্তু অনেক গবেষণা করেও গন্তব্য হিসেবে আমাদের শহরের নাম খুঁজে পেলনা। এর মধ্যেই ট্রেন ও পৌঁছে গেলো। টানটান উত্তেজনে, ঐটাই শেষ ট্রেন, প্লাটফর্মে বের হয়ে দেখি ট্রেনের ইউনিফর্ম পরা এক ভদ্রলোক। ভেতরে গিয়ে বাকিদের ডেকে আনলাম, মেলিনা ফ্রেঞ্চে ওনাকে আমাদের সমস্যা সম্পর্কে জানাল। উনি বললেন সমস্যা নেই, ট্রেনে চড়ে বস, ভেতরে টিকেট করতে পারবে। আমরা কিছুটা সস্তি পেয়ে চড়ে বসলাম ট্রেনে। গল্প করতে করতে কখন জারব্রুকেন পৌঁছে গেছি টের পাইনি, যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তখন খেয়াল করলাম ব্যাপারটা। কিন্তু মজার ব্যাপার আমাদের কাছে টিকেট চেক করতে বা বিক্রি করতে কেউই আসেনি। আমরাও খুশি মনে ট্রেন থেকে বের হয়ে আসলাম। স্টেশনের কাছেই তখন বাসা থাকায় বের হয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ালাম বাসার দিকে। আর এর মধ্যেই শেষ হল আমার বাস্তিয়ে ডে উৎযাপন।
পূর্ববর্তী পর্বঃ জার্মানি
পূর্ববর্তী উপপর্বঃ জারল্যান্ড (রোমারমুজিয়ম, বিলিসকাস্টেল, জারস্লাইফে, ভিলা বগ)
পরবর্তী পর্বঃ লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম, নেদারল্যাণ্ড
পরবর্তী উপপর্বঃ লুক্সেমবার্গ সিটি, ব্রাসেলস, রটারড্যাম, অ্যামস্টারডাম এবং একটি সারপ্রাইজ
[…] পরবর্তী পর্বঃ ফ্রান্স পরবর্তী উপপর্বঃ ফোরবাক […]