জার্মানিতে বড় ভাই কিংবা ছোট ভাই অনেকের সাথে কথা বলে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে নিচের কথাগুলো বলছি। এই কথাগুলো একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। তবে কারো উপকারে আসতে পারে বলেই লিখলাম। আপনার দ্বিমত থাকলে মন্তব্যে জানাতে পারেন কিংবা আরেকটা ব্লগ পোস্ট লিখতে পারেন। ধন্যবাদ।
১, জার্মান ভাষা
জার্মানিতে থেকে জার্মান শিখবেন না। চাকরি করবেন, কিন্তু জার্মান! না! না! না! তাহলে ৯০ ভাগ জায়গায় আপনার সফল হওয়ার সম্ভাবনাও নাই! নাই! নাই! বাকি ১০ ভাগে প্রচুর প্রতিযোগিতা করে তবেই টিকে থাকতে হবে। (আইটি স্পেশালিস্ট বা প্রোগ্রামার হলে ভিন্ন কথা।)
২, জার্মান কালচার
জার্মানি বা অন্য ইউরোপিয়ান দেশগুলোর ইন্টিগ্রেশন প্রক্রিয়া ইউএসএ কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মত ইমিগ্র্যান্টবান্ধব দেশ থেকে একটু ভিন্ন। জার্মানরা চায় আপনি তাদের আচার ব্যবহারকে শিখে নিবেন, আপন করে নিবেন। সবার সাথে মিশে যাবেন। এই ব্যাপারটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে না হতে পারে, কিন্তু in the long run, it will play a role. 🙂
৩, ল্যাক অব ভিশন
লেখাপড়া করার সময় থেকে চাকরির বাজার এর দিকে চোখ রাখতে হবে। কোন বিষয়ে থিসিস বা ইন্টার্নশিপ এর অভিজ্ঞতা চাকরি পেতে সাহায্য করবে সেটা আমলে রাখতে হবে। চাকরি নিয়ে অনেক ওয়েবসাইট আছে। জার্মান ব্লগ আছে। সেখানে ধারণা পাওয়া যাবে।
৪, ল্যাক অব প্রিপারেশন
মনে করুন আপনি হার্ডওয়্যার প্রকৌশলী। এজন্য আপনার কী কী সফটওয়্যার জানা উচিত, কী কী ডিভাইস নিয়ে কাজ করা উচিত সে ব্যাপারে পরিকল্পনা থাকতে হবে। শিক্ষাজীবন শেষে কম সময়ে চাকরি পেতে হলে এর কোন বিকল্প নেই। কিংবা আপনার সিভিতে যে সফটওয়্যারের নাম শুনেছেন সেটাও লিখে দিয়েছেন পারি বলে। খুব খারাপ কাজ। এজন্য পস্তানোর সম্ভাবনা খুব বেশি। সৎ থাকুন। যা পারেন তা লিখুন। অতিরিক্ত লিখে বিপদে পড়বেন না। চাকরির চাহিদা অনুযায়ী সিভি, কাভার লেটার কাস্টমাইজ করুন। ফল পাবেন।
৫, কোম্পানি সম্পর্কে আইডিয়া না থাকা
আপনি যে কোম্পানিতে ইন্টার্ভিউ দিতে যাবেন, ভাল করে পড়ে যাবেন তাদের ব্যাপারে। আপনাকে এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে। তাদের প্রোডাক্ট এর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হবে। তাদের প্রজেক্ট এর ধাপগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা হবে। এই জিনিসটায় অনেকেই উদাসীন থাকেন। সাবধান।
৬, ওভার কনফিডেন্স/স্মার্টনেস, এরোগেন্স
এই জায়গাটা মারাত্মক। ”আমি কি জিনিস!”, ”শুধু একবার ডাকলেই দেখবে!” টাইপ এটিটুড থেকে বের হতে হবে। আবার কলিমুদ্দিন-রহিমুদ্দিন বড় ভাই থেকেও দূরে থাকতে হবে, যারা বলবে কোনকিছুই সম্ভব না। বাস্তবতা কী এবং সে অনুযায়ী কতটুকু কাজ করা উচিত তা বোঝার বয়স আপনার হয়েছে। নিজেকে সততার সাথে এনালাইসিস করুন। তাহলেই আর কারো বুদ্ধি নিতে হবে না। জানেন তো, ‘নিজের বুদ্ধিতে ভাত, পরের বুদ্ধিতে হাত’!
৭, এইচ আর প্রশ্ন (Human Resources questions)
কিছু নির্দিষ্ট প্রশ্ন তারা করে থাকেন। ঠিকমত খুঁজে দেখলে প্রতিটা প্রশ্ন অনলাইনে পাওয়া যায়। এই প্রশ্নগুলো দিয়ে মানুষ হিসেবে আপনি কেমন তা বের করার চেষ্টা করা হয়। টিমের সাথে কাজ করতে পারবেন কিনা, সমালোচনা সহ্য করতে পারেন কিনা ইত্যাদি এই আলোচনার মূখ্য বিষয়।
৮, প্রফেশন্যালিজম
এটায় জাতিগতভাবে আমরা বেশ পিছিয়ে। ওয়ার্ক ইথিক্স বলে যে একটা জিনিস আছে এটাও আমরা ভুলে যাই। বস্, কাজ দিলে তা যদি কোন কারণে করা সম্ভব না হয়, আগেভাগে জানিয়ে দিতে আমরা ভয় পাই। অথচ এটা একটা স্বাভাবিক ঘটনা। জার্মানরা সাহায্য পরায়ণ। কিন্তু তারা তো আপনার মনের ভেতর ঢুকে দেখতে পারবে না, আপনার কী লাগবে। আপনাকে প্রশ্ন করতে হবে। সমস্যা হয়ে যায়, যখন আপনি শেষ মূহুর্তে বলেন। তখন আর রিকভার করার সময় থাকে না। নিজের প্রতি সৎ থাকুন। এর কোন বিকল্প নেই।
৯, সময়ানুবর্তীতা
আর যা কিছু করুন, সময়ের ব্যাপারে অসচেতন হয়েছেন তো আপনি গেছেন। মিটিং এর টাইম ১০টা মানে ঠিক ১০টা। ১০টা বেজে ১ সেকেন্ড পড়ে আসলে সাথে সাথে বলুন, ‘এনশুল্ডিগুং’। এই দিকটার কোন ক্ষমা বা বিকল্প নাই।
১০, হ্যান্ড শেইক/বডি ল্যাংগুয়েজ
একবার কোন একটি ব্লগে পড়ছিলাম এই ঘটনা। সেখান থেকে বলছি। কোন একটা বিশাল কোম্পানির ইন্টার্ভিউতে দুইজন ক্যান্ডিডেট এর মান একই। তাদের কোয়ালিটি একই। এখন কীভাবে তাদের দুজন থেকে একজনকে বেছে নিলেন? এই প্রশ্নের জবাবে, ইন্টার্ভিউয়ার উত্তর করেছিলেন, ‘যার হ্যান্ডশেক শক্তিশালি ছিল, তাকে।’
এই ঘটনাটা দিয়ে এটা বোঝাতে চাই, ইন্টার্ভিউ এর সময় বডি ল্যাংগুয়েজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। চেস্টা করুন একটা ভাল সময় কাটাতে। কনফিডেন্ট থাকুন। লুতুপুতু না। কারণ আপনি কয়টা প্রশ্ন পেড়েছেন সেটার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল আপনার সাথে কথা বলে ইন্টার্ভিউয়ারের কেমন লেগেছে? এটাই শেষ পর্যন্ত মনে থাকে তার। তাই ভাল একটা ফিলিংস দেয়ার চেষ্টা করুন।
”বুন্ডেস আগেনটুর ফুর আরবাইট” এর একটি বিজ্ঞাপন
দায়টা আসলে কার?
ভুলটা আপনি করে ফেলার আগেই ছোট্ট ছোট্ট কিছু কথা বলার বা পুনরায় মনে করিয়ে দিতে চাই। একই ভুলের বৃত্তে বারবার না ঘুরে ভুল থেকে শিখে সামনে আগানোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আপনারা অনেকেই এসব জানেন। যাঁরা জানেন, তাঁরা তাঁদের অভিজ্ঞতা যদি আমাদের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভাগ করে নেন তবে অনেকের অশেষ উপকার হবে।
১, জার্মানিতে আপনাকে কেউ পড়তে আসতে বলে নি। আপনি নিজেই পড়তে এসেছেন। স্বেচ্ছায়। তাই প্রথম কাজ হবে ‘স্টপ কমপ্লেইনিং’, ‘ট্রাই টু ব্লেন্ড ইন’। 🙂
২, জার্মানরা কেন ইংরেজি বলে না, এটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল “আপনি কেন জার্মান বলেন না?” নিজেকে এই প্রশ্নটি করুন।
৩, জার্মান কালচার, সংস্কৃতিকে আপনার ভাল লাগে না। সেটা ভাল না লাগতেই পারে। কিন্তু ব্যবহারে এতটুকু ডিসেন্সি থাকা চাই, যাতে আপনার সামনের সহকর্মী “অফেন্ডেড” না বোধ করেন।
৪, বিনয়ী হতে চেষ্টা করুন। এতে আপনি ছোট হবেন না। আমার মা সবসময় এই কথাটা বলতেনঃ “বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।”
৫, সবশেষ কথাঃ লেখাপড়া শেষে অনেকেই চাকরি খুঁজবেন। এবং চাকরি খুঁজতে গিয়ে একটা বড় ধাক্কা খাবেন আপনার জার্মান লেভেল নিয়ে। এটা মোটামুটি ৯০ ভাগ (আই টি স্পেশালিস্ট, প্রোগ্রামার ইত্যাদি ছাড়া) ক্ষেত্রে ঘটবে। এতে ভয় বা বিচলিত না হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবেন, দায়টা আপনার। যিনি ইন্টার্ভিউ নিচ্ছেন তিনি কত খারাপ সেটার চেয়ে আপনি কতটা ভাল এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজের কাজের বা অক্ষমতার বা অর্জনের দায় নিজেই নিন। দেখবেন অনেক কিছুই সহজ হয়ে যাচ্ছে।
আরো পড়তে পারেনঃ
- বাংলাদেশে থেকে জার্মান ব্লু কার্ড এবং ভিসা পেতে হলে
- চাকরি এবং জার্মানি – পর্ব – ০০ – এপ্লিকেশন প্রিপারেশন (১০টি টিপস)
- চাকরির জন্য কাভার লেটার – চাকরি এবং জার্মানি – পর্ব – ০১
- চাকরি এবং জার্মানি – পর্ব – ২ – এপ্লিকেশন এবং রিপ্লাই
- চাকরির জন্য সিভি/লেবেন্সলাউফ – চাকরি এবং জার্মানি – পর্ব – ০৩
- জার্মান সিভি/লেবেন্সলাউফ/CV/Lebenslauf (২০ টি উদাহরণ)
- ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটদের বেতন কত বা কোন অঞ্চলে চাকরি বেশি? – চাকরি এবং জার্মানি – পর্ব – ৪
- ট্যাক্স(Income Tax) হিসাব করা – চাকরি এবং জার্মানি – পর্ব – ০৫
- জার্মান প্রবাসে কীভাবে চাকরি খুঁজতে হবে? (হাসিব মাহমুদ)
- জার্মান কোন কোম্পানিতে চাকরি পেতে হলে কোন লেভেল পর্যন্ত জার্মান শেখা উচিত?
- জার্মান ইনকাম ট্যাক্স পদ্ধতি – Lohn- und Einkommensteuer!