জার্মান প্রবাসেতে যারা আমার ট্রাভেল ব্লগ সিরিজ “সাধ ও সাধ্যের ইউরোপ ভ্রমণ” পরেছেন তারা ইতোমধ্যে যেনে গেছেন বিগত এপ্রিল ২০১৫ থেকে ইউরোপের কয়েকটি শহর ঘোরা হয়েছে। সেগুলোতে পরিবহন মাধ্যম ছিল প্লেন, ট্রেন বা বাস। তবে সেই কবে “ইউরো ট্রীপ” মুভিটা দেখেছিলাম, আর তখন থেকেই শখ ইউরোপে একটা ক্রসকান্ট্রী রোড ট্রীপ দেবার। তবে নিজের বা কাছের বন্ধুদের কারো ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় শখটা অধরাই থেকে গেছে।
আমার শখের আগুনে ঘি পরে ভার্সিটি এর ফ্রেন্ড সাফায়েত ভাইয়ের একটা ফোনে। নভেম্বরের শেষের দিকে হটাত একদিন ফোন দিয়ে জানাল ডিসেম্বরের শেষদিকে ফিনল্যান্ড থেকে ওনার এক কলেজ ফ্রেন্ড আসবে যার কিনা ইউরোপিয়ান ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে, জানতে চাইছে থার্টী ফার্স্ট উৎযাপন করতে গাড়ী নিয়ে অ্যামস্টারডাম যেতে চাই কিনা। আমি তো শোনার সঙ্গে সঙ্গে দুই লাফ দিয়ে রাজি। ফোন রেখেই ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেলাম গবেষণা করতে, দেখলাম আমার শহর থেকে অ্যামস্টারডাম যাবার পথে লুক্সেমবার্গ, ব্রাসেলস, অ্যান্টর্প, রটারড্যাম পরবে। ঐ শহর গুলোর থিংস টু ডু গুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম তখনই। চিন্তা করে দেখলাম বড় শহরে রাতে থাকতে গেলে খরচ বেশী তাই অ্যান্টর্প আর রটারড্যামে ইয়ুথ হোস্টেল খুঁজতে থাকলাম, রটারড্যামে পেয়েও গেলাম সব মিলিয়ে ১২ ইউরো প্রতি বেড।
তবে বড়সড় একটা ধাক্কা খেলাম দুইদিন পরে, সাফায়েত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পরে জানাল ওনারা শুধু অ্যামস্টারডাম যেতে চান, ৩১ তারিখ সকালে রওয়ানা হয়ে ওখানে মধ্যরাতের পর পর্যন্ত থেকে রাত ২/৩টা নাগাদ ফেরার পথ ধরতে চান। মানসিক ভাবে অনেকটাই দমে গেলাম, মূল কারণ এক যায়গায় যেহেতু দ্বিতীয় বার যাবার সুযোগ কম তাই ব্রাসেলস, রটারড্যাম হয়ত আজীবনের জন্যে বাদ পরে যাবে। এর কিছুদিন পরে জানতে পারলাম ৩১ তারিখেও যাওয়া হবে না যেতে হবে ৩০ তারিখ কারণ যেখান থেকে গাড়ি ভাড়া নেওয়া হবে সেটা ১ তারিখ বন্ধ থাকবে তাই গাড়ি ফেরত দিতে হবে ২ তারিখ, কিন্তু সাফায়েত ভাইয়ের বন্ধু ১ তারিখ সন্ধ্যায় ফিরতে প্লেনে উঠবেন তাই সফর একদিন এগিয়ে আনা। এটা শোনার পরে না যাবার ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নিলাম, জানিয়েও দিলাম সেটা। ওনারা কিছুটা মন খারাপ করলেন, কয়েকবার আবারো চিন্তা করে দেখতে বললেন, তবে শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন।
সাফায়েত ভাইয়ের বন্ধু সাজ্জাদ ভাই আসলেন ২৪শে ডিসেম্বর, তবে সেদিন আমি হাইকিঙে যেয়ে ২৫ কিমি হাটায় ওইদিন আর দেখা করতে পারলাম না, দেখা হল পরদিন। বিকালটা একসঙ্গে ঘুরে সারারাত চলল সাফায়েত ভাইয়ের বাসায় আড্ডা। আমি যেহেতু চট্টগ্রামকে আমার সেকেন্ড হোম টাউন বলি ফলে ওখানকার মানুষকে আমার ভালো লাগে, আর তাছাড়া সাজ্জাদ ভাইও আমার মত আড্ডাবাজ হওয়ায় ওনাকে ভালো লেগে গেল অল্প সময়েই। এরপরে পরদিন দুপুরে আরেক বন্ধু সালমান ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত, খেতে খেতে সন্ধ্যা। রাতের বেলা বিকালের নাস্তা করে আমি আর সাজ্জাদ ভাই বারান্দায় গেলাম মুক্ত বায়ু সেবনের জন্যে। ঐখানে সাজ্জাদ ভাই আমকে আবারো যাবার কথা বললেন, জানালাম এত স্বল্প দৈর্ঘ্যের ট্রিপে শুধু অ্যামস্টারডাম যেয়ে আমার পোষাবেন। ওনার প্রশ্ন, যদি ঘুরতে ঘুরতে দুই দিনের জন্যে যাওয়া হয়? আমি পরে গেলাম মাইনকা চিপায়। উনি বললেন ভেতরে যেয়ে উনি বাকি দুইজনের সঙ্গে কথা বলবেন।
ভেতরে যাওয়ার পরে সাজ্জাদ ভাই কিছু বলার আগেই বাকি দুইজন আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন যদি ঘুরতে ঘুরতে দুই দিনের জন্যে যাওয়া হয় তাহলে আপনি যাবেন কিনা এবার বলেন? তখন আর না করার কোন কারণ নেই। রাত বাজে একটা, ব্রেমেন থাকা বন্ধু হাসনাইন কে ফোন দিয়ে বললাম তুই কাল সকালের বাসে উঠে রওয়ানা হয়ে যা জারব্রুকেনের উদ্দেশ্যে। দেশে থাকতে আগের দশটা বছর একসঙ্গে আমরা এমন অনেক পাগলামি করেছি, তাই রাত একটায় ফোন দিয়ে ওকে পরদিন সকালের বাস ধরতে বলতে আমার যেমন অস্বস্তি লাগে না, তেমনি বিস্তারিত কিছু জানতে না চেয়ে বাসের টিকেট খুঁজতে ওর ও অস্বস্তি লাগে না। পরদিন সকাল দশটার বাসে উঠে হাসনাইন জারব্রুকেন এসে পৌঁছল রাত ৮টায়। তার পরদিন মানে ২৮ তারিখ বাকিরা অয়রোপা পার্কে যাওয়ায় আমরা দুজন ঘুরতে গেলাম পাসের ফ্রেঞ্চ শহর সারেগুমিন্সে। এর মাঝে ট্যুরের জন্যে কিছু শুখনো খাবার কিনে রাখলাম আমার বাসায়।
রাতে বাসায় ফিরে চুলোয় গরু চড়িয়ে দিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসলাম ট্যুর প্ল্যান করার জন্যে। অন্য ট্যুরে যেখানে ডে ওয়াইস আইটেনারী হয়ে যায় নূন্যতম ১৫দিন আগে সেখানে এই ট্যুরের প্ল্যান করতে বসলাম আগের দিন। এর মধ্যে রাতে থাকার যায়গাও ঠিক করা হয়নি। ২৭ তারিখ রাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে একবার দেখেছিলাম, কিন্তু কোন ইয়ুথ হোস্টেল খালি পাইনি। হোটেল যেগুলো আছে জনপ্রতি নূন্যতম ৫৫ ইউরো। গাড়ীতে রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত নিলাম, সেইভাবে খোজা শুরু করলাম। স্প্যানিশ ফ্রেন্ড মীরেইয়্যা কয়েকবছর জার্মানি আছে, ওর কাছে জানতে চাইলাম গাড়িতে থাকা লিগ্যাল কিনা? জানাল স্পেনে ইল্যিগ্যাল, জার্মানি এর ব্যাপারে ও জানেনা, তবে অনেককেই দেখেছে রাস্তা থেকে একটু ভেতরে বনের মধ্যে গাড়ি নিয়ে থাকতে। সাহস পেয়ে গেলাম, খুঁজতে থাকলাম নানা ফোরামে। বেশ কিছু সাজেশন দেখলাম, হাইওয়ের পাশে ট্রাক স্টপ, পেট্রল পাম্পের পার্কিং অথবা রাস্তা থেকে একটু ভেতরে জঙ্গলের মধ্যে। সিদ্ধান্ত নিলাম এগুলোর মধ্যে যেটা পাওয়া যায় সেখানেই গাড়ি দাড় করিয়ে ঘুম দিব।
এরপর শুরু করলাম ট্যুর আইটেনারী। লুক্সেমবার্গ, ব্রাসেলস, রটারড্যাম শেষ করে যখন অ্যামস্টারডাম নিয়ে বসেছি তখন দেখলাম অনেকের কাছেই অ্যামস্টারডামে কার পার্কীং একটা প্যারা। শুরু করলাম পড়ালেখা, দেখি একদিনের জন্যে পার্কিংই শুধু ৫৬ ইউরো। মাথায় হাত, অল্টারনেট খুঁজতে শুরু করলাম। হাসনাইনকেও বললাম ওর ফোন থেকে খুঁজতে। কিন্তু সুবিধাজনক কোন কিছুই পাই না। অনেকেই P+R এর কথা বলছে কিন্তু সেগুলো সব শহরের বাইরে। প্রায় দুই ঘণ্টা খুঁজেও P+R এর থেকে ভালো কিছু পেলাম না। কিছুদিন আগে ঘুরে আসা অঞ্জল ভাইকে ফোন দিলাম, উনি জানালেন ওনারা শহরে মাত্র ১ ঘন্টা ছিলেন তাই শহরেই ১ ঘণ্টার জন্যে রেখেছিলেন, তবে উনিও লম্বা সময় হলে P+R এর কথাই বললেন। এর পরে P+R নিয়ে বিস্তারিত পড়ালেখা করে সব তথ্য জেনে নিলাম।
অবশেষে ২৯ তারিখ সকাল ৯টায় শুরু হল আমাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত রোড ট্রীপ। আমি শুরুতে কিছুটা ভয়ে ছিলাম সাজ্জাদ ভাই আগের দিন ৩ ঘণ্টা গাড়ী চালিয়ে অয়রোপা পার্কে গেছেন সারাদিন নানা রাইডে চরেছেন, আবার রাতে গাড়ী চালিয়ে ফিরেছেন, এরপরে একা এতটা লম্বা সময় ড্রাইভ করতে পারবেন কিনা সেটা নিয়ে। কিন্তু আমি তখনো যানতাম না স্টিয়ারিং হুইলের পিছেনে এক অতিমানব বসেছে। ব্যক্তিগত ভাবে উনি অস্থির প্রকৃতির কিন্তু হুইলের পিছেনে একদম স্থির। শহর থেকে বের হয়ে আমরা রওয়ানা হলাম লুক্সেমবার্গের দিকে, ওটাই আমাদের প্রথম গন্তব্য।
লুক্সেমবার্গে যখন পৌঁছলাম ঘড়ির কাঁটা তখন ১১টা পার হয়ে গেছে। পৌঁছেই প্রথম প্যারা পার্কিং খুঁজে বের করা। প্ল্যান ছিল নটরড্যাম ক্যাথেড্রাল যাবার, কিন্তু আশেপাশে কোথাও পার্কিং খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাজ্জাদ ভাই বাসের পার্কিং এ গাড়ী রেখে নেমে দেখতে বললেন কোথাও পাওয়া যায় কিনা। আমি নেমে একটু সামনের দিকে এগিয়েছি, এদিকে সাফায়েত ভাই আর সালমান ভাই গাড়ি থেকে নামার পরপরই একটা বাস চলে আসলো ফলে সাজ্জাদ ভাইকে আবারো চলতে শুরু করতে হল। ওনাকে আগানো দেখে আমিও গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে হেটে/দৌড়ে আগাতে থাকলাম, একটু পরে বাকি দুইজনের জন্যে পেছনে তাকিয়ে দেখি তাদের কোন খবর নেই। যাইহোক কিছুদূর আগাবার পরে পুলিশের সাহায্য নিয়ে পার্কিং এর সন্ধান বের করে পার্ক করে আমরা আবার ফিরে চললাম নটরড্যাম ক্যাথেড্রালের দিকে যেখানে বাকি দুজনকে ফেলে গেছি। যেয়ে দেখি বান্দা দুজন গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু যাবার পরে সেলফি কিং সাফায়েত ভাই যখন জানতে পারলেন পার্কিং বেশ খানিকটা দূরে ব্যাচারার মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। কারণ সকাল থেকে এক ক্যাপ পরেই উনি সেলফি তুলছেন, প্ল্যান ছিল লুক্সেমবার্গে পৌঁছে ক্যাপ চেঞ্জ করার। তবে ভেতরে ঢুকে হাসনাইন যখন জানাল ফ্রি ওয়াইফাই আছে সঙ্গে সঙ্গে ওনার মন ভালো হয়ে গেলো। আমরা ব্যস্ত হয়ে পরলাম ঘুরে দেখতে আর উনি ব্যস্ত হয়ে পরলেন ভাইবারে ভাবীকে ছবি পাঠাতে। বাঙ্গালির চিরায়ত রীতি অনুযায়ী কিছুক্ষণ ছবি তোলা চলল। এরপরে ঘুরে ঘুরে দেখলাম পুরো ক্যাথেড্রাল। একপাশে মোম রাখা, চাইলে নিজের মত মোম নিয়ে দানবাক্সে কয়েন ফেলে যীশু খ্রিষ্টের জন্যে মোম জ্বালান যায়। বের হবার আগে হাসনাইন মোম একটা পকেটে চালান করে দেবার পরে আমাদের কেউ একজন ওকে জিজ্ঞেস করল কয়েন ফেলেছে কিনা? ওর ত্বরিত জবাব, যীশুর মোম এটা, আর আমি যীশুর কাছে বলেই নিয়েছি, তাই আমার কয়েন ফেলতে হবে না :p ।
ওখানে থেকে বের হয়ে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে একটা গ্রুপ ফটো তুলে ফেললাম। মূলত আমাদের সব ট্যুরেরই অংশ হয়ে গেছে এটা, উদ্দেশ্য বাংলাদেশের পক্ষে ঐ শহর বা দেশকে দখল করা 😉 । এরপরে এডলফ ব্রিজের পথে পাহাড়ের ঢালে অসম্ভব সুন্দর কিছু সময় কাটিয়ে পা বাড়ালাম গ্র্যান্ড র্যুয়ের দিকে। সেখানে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে ফটো সেশন চলল। আর ঐদিকে সেলফি কিং এর অনবরত সেলফি আর লুক্সেমবার্গ জুড়ে থাকা ফ্রি ওয়াইফাইয়ের কল্যাণে সেগুলো ভাইবারে দেশে পাঠানো তো ছিলই। এটা অবশ্য এক দিক দিয়ে ভালো হয়েছে, কারণ প্রতি ৩/৪ ঘণ্টায় একবার কথা না বললে দুপক্ষই অস্থিরতায় ভোগে, তাই ট্যুরের আগে আমরা একটু চিন্তায় ছিলাম ওই দুইদিন ওনারা থাকবেন কিভাবে।
যাই হোক গ্র্যান্ড র্যুয়ে ঘুরে পা বাড়ালাম পার্কিং এর দিকে। সেখানেও স্ট্যাচু এর সামনে ফটো সেশনের পরে আমরা যখন নিচে নামবো দেখি সেলফি কিং আমাদের একটু অপেক্ষা করতে বলছে। ব্যাপারকি জানতে চাওয়ায় জানালো শেষ সেলফি পাঠিয়ে ভাবি এর থেকে বিদায় নেওয়ার জন্যেই এই অপেক্ষা। এই ছেলেকে আমি যত দেখি ততই অবাক হই। ওনাদের সম্পর্ক আট বছরের ওপর, এরপরেও কথা বলার জন্যে সাফায়েত ভাইয়ের খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে যাওয়া অথবা ভাবীর গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকা, দুজন দুজনের প্রতি গভীর ভালোবাসা আসলে অবাক হতে বাধ্য করে। তাই “বেঁচে থাকুক সাফায়েত-যূথী এরা, বেঁচে থাকুক ভালোবাসা” এই মহান বানীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা লুক্সেমবার্গ ত্যাগ করলাম।
পরের গন্তব্য ব্রাসেলস, হাইওয়েতে ওঠার কিছু পরে মনে পরল সঙ্গে খাবার থাকার পরেও উত্তেজনায় আমরা সকালের নাস্তা খাবার কথা ভুলে গেছি। ট্রাক স্টপে গাড়ি দার করিয়ে ব্রেড, কলা, সিদ্ধ ডিম, কমলা, কেক, সফট ড্রিঙ্ক দিয়ে আমরা আমাদের ব্রাঞ্চ শেষ করে মুভিতে দেখা দূর দিগন্ত রেখায় বিলীন হওয়া হাইওয়ে ধরে আবারো রওয়ানা হলাম ব্রাসেলসের পথে। মাঝে একবার কফি খাবার জন্যে এক পেট্রল পাম্পে দাঁড়ালাম, কিন্তু সাজ্জাদ ভাইয়ের অক্সিজেন না থাকায় সেখান থেকে বের হয়ে পরেরটাতে গেলাম। পরেরটায় যাওয়ার একটু পরে খেয়াল করলাম আমার পকেটে মোবাইল নেই। থিংস টু ডু এর লিস্ট শুধু আমার ফোনেই। কেউ একজন গাড়িতে চেক করতে বলল। খুব ভালোভাবে দেখলাম। সাফায়েত ভাই বললেন আগের পাম্পে বোধহয় ফেলে এসেছি। সাজ্জাদ ভাই সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যেতে চাইলেন, কিন্তু হাসনাইন দেখি যেতে চায় না, বলল ওখানে ফেলে আসলে আর পাওয়া যাবে না সো যেয়ে লাভ নেই। ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে খোজা বাদ দিলাম। সাফায়েত ভাই নানাভাবে আমাকে খোজার ব্যাপারে উৎসাহ দিল কিন্তু কাজ হচ্ছে না দেখে কিছুটা অবাক। তখন জানালাম এর আগে যতবার এভাবে কিছু হারিয়েছি সবসময় আমার থেকে বেশি চিন্তিত ছিল হাসনাইন, হয়ত আমি বসে থেকেছি কিন্তু ও খোজা থামায় নি, এখন ও যেহেতু নির্ভার তাই আমার আর টেনশন না করলেও চলবে। পরে ব্রাসেলসে পৌঁছাবার পরে সাফায়েত ভাই আমার ফোন বের করে, যেটা গাড়ির মধ্যে আমার পাশে বসে থাকার সময় উনি পকেটে চালান করেছিল।
ব্রাসেলসে শহর কেন্দ্রে পার্কিং না পেয়ে ১.৫ কিমি দূরে পার্ক করে গ্র্যান্ড প্লেসের দিকে পা বাড়ালাম। পথে আর্মি ট্যাঙ্ক, এপিসি দেখলাম বেশ কয়েকটা। একটা বিল্ডিঙের পাশ দিয়ে যাবার সময় দেখলাম আর্মি, পুলিশের জটলা, আর আর্মি এর দুইজন রশি দিয়ে ঐ বিল্ডিং এ ঝুলছে। খুব একটা গায়ে লাগালাম না, ভাবলাম এত কিছু প্যারিস এ্যাটাকের জের ধরে। গ্র্যান্ড প্লেসের দিকে যাবার পথে পরল থিয়াটার রয়াল ডি লা মন্নে। সামনের প্লাজায় আইস স্কেটিং এ্যারিনা করা হয়েছে আর চারপাশে মেলার মত নানা জিনিসের স্টল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের স্কেটিং উপভোগ করলাম। এরপর মেলায় ঘুরে আগালাম গ্র্যান্ড প্লেসের দিকে। নোকিয়া হেয়ার অফলাইন ম্যাপের সহযোগিতায় বেশ কিছু গলি/উপগলি যেগুলোর দুইপাশে শুধুই খাবারের দোকান সেগুলো পার হয়ে পৌঁছলাম গ্র্যান্ড প্লেসে।
গ্র্যান্ড প্লেস বা গ্রোটে মার্ক্ট মূলত ব্রাসেলসের কেন্দ্রবিন্দু যেটা কিনা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এর উৎপত্তি মূলত ১১শ শতকে একটি ওপেন এয়ার মার্কেট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। ধীরে ধীরে এই স্কয়ার এর চার পাশে কাঠের ঘর বানানো হতে থাকে সময়ের বিবর্তনে ১৪শ শতক থেকে যা পাথরের দালানে পরিবর্তন হতে থাকে। তবে এখন স্কয়ারের চারপাশে সিটি হল, মিউজিয়ামসহ যত দালান দেখা যায় সেগুলো মূলত ১৭ শতকের। ১৭ শতকে ফ্রেঞ্চ গোলন্দাজ বাহিনী আগের দালান গুলো গুঁড়িয়ে দেওয়াই সেগুলো নতুন করে নির্মাণ করার মূল কারণ।
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গ্র্যান্ড প্লেস অবশ্য একটু অন্য কারণেও বিখ্যাত। এই সময়টাতেই প্রতিদিন সন্ধ্যায় দালানগুলোর গায়ে বিখ্যাত লাইট অ্যান্ড সাউন্ড প্রদর্শনী হয়। আমরা সৌভাগ্যবান পার্কিং দূরে হওয়ায় একটু দেরী করে পৌঁছেছি ফলে আমাদের টাইমিং টা ভালো হয়েছে, আমরা পৌছনোর পরপরই বলা চলে প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। যদিও প্রদর্শনী প্রতি ঘণ্টায়ই হয়, তবে টাইমিং এ না মিললে অপেক্ষা বোধহয় করা হত না। প্রদর্শনীটির ব্যাপ্তিকাল ১৫ মিনিট, তবে ভালো লাগার ঘোর কাটতে আরও কিছুটা সময় লেগে যায়।
প্রদর্শনী শেষে ঘোরের মধ্যেই আগালাম মূত্র বিসর্জন দেখতে। অনেকেই ধারনা করতে পারছেন আমি ম্যানিকেন পিসের কথা বলছি। এটা মূত্র বিস্ররজনরত এক বাচ্চার মূর্তি। এই মূর্তি সম্পর্কে অনেক গল্প প্রচলিত আছে তবে সেগুলোর মধ্যে ডিউক গডফ্রে তিন সব থেকে আকর্ষণীয়। কথিত আছে ১১৪২ সালে ডিউকের বয়স যখন ২ বছর তখন তার বাহীনির সঙ্গে ডিউক বের্থহাউটের বাহীনির যুদ্ধ বাধে। গডফ্রের সৈন্যদলকে উজ্জীবিত করার জন্যে তাকে একটি বাস্কেট রেখে বাস্কেটটি একটি গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বাস্কেট থেকে ডিউক গডফ্রে বের্থহাউটের সৈন্যদের গায়ে মূত্র বিসর্জন করে, যারা পরে ঐ যুদ্ধে পরাজয় বরন করে।
ম্যানিকেন পিস দেখে ফেরার সময় হাসনাইনের নাকে ওয়াফেলের ঘ্রাণ ধাক্কা মারায় ও দাঁড়িয়ে পরল ওয়াফেল খাবার জন্যে। আমি মিষ্টি খাইনা দেখে আমি বাদে বাকিরা সবাই ওয়াফেলের অর্ডার করল। বেশ মনকাড়া ঘ্রাণে চারিদিক প্লাবিত। ওয়াফেল নিয়ে হাটতে থাকলাম ফিরতি পথে। হাসনাইন আমাকে একরকম জোর করেই ওর থেকে একটু ওয়াফেল খাওয়াল। এখনো আফসোস হয় কেন নেই নি, আজ দুপুরেও যখন সাফায়েত ভাইয়ের সঙ্গে অন্য একটা প্রসঙ্গে ওয়াফেলের কথা উঠলো, দুজনেই স্বীকার করলাম ব্রাসেলসের ওয়াফেলের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
গাড়ির কাছে ফেরার পথে একটা কার্নিভাল পরল, সেখানে ঘুরে বেড়ালাম কিছুক্ষণ। এরপর গাড়ী নিয়ে আগালাম খাবারের সন্ধানে। কার ন্যাভিগেশন থেকে একটা চাইনিজ খাবারের দোকান নির্বাচন করে ন্যাভিগেশনের দেখানো পথ ধরে এগুতে থাকলাম। ৫ কিমি এর মত পথ, এর মাঝে একটা গলিতে ঢুকে অর্ধেক পার হবার পরে বুঝতে পারলাম ওটা ওয়ান ওয়ে। মড়ার ওপর খাড়ার ঘা এর মত গলির প্রায় অন্য মাথায় যখন পৌঁছে গেছি তখন বিপরীত দিক থেকে পুলিশের গাড়ী এসে সাইরেন বাজানো শুরু করে গাড়ী সাইডে নিতে ইশারা করল। এরপর সাজ্জাদ ভাই এর পাশে ওদের গাড়ি দাড় করাল। লাকিলি আমাদের কে রাস্তাটা দেখাচ্ছিল কার ন্যাভিগেশন, ওদেরকে ব্যাপারটা বলা হল। ওরা বুঝতে পারলো, আমাদের পরামর্শ দিল ন্যাভিগেশনের পাশাপাশি আমরা যেন রোড সাইন ও খেয়াল করি, এরপরে গুড ইভনিং জানিয়ে চলে গেলো আর আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম, এত জলদি মেনে নেবে এটা ভাবিনি। এরপর নির্ঝঞ্ঝাট ভাবেই খাবার কিনে হাইওয়েতে উঠলাম। পথে এক পাম্পের পার্কিং এ গাড়ী দার করিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম।
খাবার শেষ করে আবারো হাইওয়ে, গন্তব্য রটারড্যাম। রটারড্যাম যাবার মূল উদ্দেশ্য কাউচ সার্ফিং এর উইকলি মিটিং এ ঢু মারা। মিটিং এর জন্যে নির্দিষ্ট পাবে যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় দশটা বাজে। যেয়ে পরিচয় হল ডাচ আর ইজিপ্টের দুই ছেলের সঙ্গে। ওদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম। পরদিন ইচ্ছা ছিল সকালে কান্ট্রি সাইড কোথাও যাওয়ার। ডাচ ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় যাওয়া যায়? ও জানাল এখন যেহেতু উইন্টার কান্ট্রি সাইড কোথাও ন্যাচারাল ভিউ তেমন ভালো পাবে না, পাশেই একটা ছোট্ট হিস্টোরিক্যাল সিটির কথা বলল, কিন্তু খুব একটা আগ্রহ পেলাম না তাই বিস্তারিত আর কিছু জানতে চাইলাম না। এরপরে একটু ভেতরের দিকে গেলাম, ওখানে পরিচয় হল জার্মান আর ডাচ দুইটা মেয়ে, মেসিডোনিয়ান আর ডাচ দুইটা ছেলের সঙ্গে। গল্পে গল্পে জার্মান মেয়েটা জানাল ওর মা ওকে জানিয়েছে ঐদিন বিকেলে ব্রাসেলসে আইএসআইএস এর দুই সন্দেহভাজন জঙ্গি কে গ্রেফতার করা হয়েছে। তখন বিকেলে দেখা ঘটনা আমাদের কাছে পরিষ্কার হল। ওখানে আমাদের আড্ডা চলল রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত।
আড্ডা ভেঙ্গে ঐখানে থেকে বের হয়ে শহরের মধ্যে, নদীর পার দিয়ে হেটে বেড়ালাম ঘণ্টা খানেক। শীতের কাছে পরাজয় মেনে নিয়ে ঘণ্টা খানেক পরে গাড়ীর কাছে ফিরে এলাম। গাড়ীতে বসে সাজ্জাদ ভাই জানালো উনি একবার ঘুমিয়ে পরলে বিপদ তাই আমাদের এখনই রাতের জন্যে যায়গা খুঁজে বের করতে হবে। সকালে কোথায় যাবো তখনো ঠিক করিনি, তাই তখন ম্যাপটা মনের মধ্যে নিয়ে একটু চিন্তা করলাম, মনে পরল অ্যামস্টারডাম যাবার পথে সমুদ্র পরে। এরপরে কার ন্যাভিগেশন হাতে নিলাম, উদ্দেশ্য ম্যাপ দেখে বিচ আছে এমন কাছের সিটি খুঁজে বের করা। ২৫ কিমি দূরে পেয়েও গেলাম একটা শহর। তখনও জানিনা নিজের অজান্তেই ইতিহাসের সাক্ষী নেদারল্যান্ডের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত এক শহরকে নির্বাচন করে ফেলেছি, যেটা জেনেছি পরবর্তীতে অ্যাডমিরাল মুভিটা দেখার সময়। যাইহোক আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ঐ শহরের পথে উঠে হাইওয়েতে কোন ট্রাক স্টপ বা পেট্রল পাম্পে গাড়ী দাড় করানো।
কিছুদূর যাবার পরে বেশ বড়সড় একটা পাম্প দেখে সাজ্জাদ ভাই মাথা ঢুকিয়ে দিলেন। রাত তখন তিনটা। পার্ক করে যে যেখানে ছিলাম সেখানেই ঘুমাবার প্রিপারেশন নিলাম। বাইরে যেহেতু টেম্পারেচার মাইনাস ৪ তাই ইঞ্জিন চালু রেখে হিটার অন করে রাখা হল। একটা ফোরামে পড়েছিলাম দীর্ঘ সময় গাড়ীর ইঞ্জিন চালু রেখে গ্লাস আটকে রাখলে কার্বন মনোক্সাইড জমে যায়। গল্পের বইতে কোন এক সময় পরেছিলাম কার্বন মনোক্সাইড এ আক্রান্ত হলে ঘুম পেতে থাকে, এবং সেই ঘুম আর কখনো ভাঙ্গে না। তাই ঘুমাবার আগে সবার মনে ভয় টা ঢুকিয়ে দিলাম যেন কেউ না কেউ মাঝে মাঝে কিছু সময়ের জন্যে গ্লাস খুলে দেয়। হাসনাইন যেমন দ্রুত ঘুমাতে পারে তেমনি দ্রুত জাগতে পারে, ও মাঝে মাঝে গ্লাস খোলার দায়িত্ব নিলো। ৭টায় যখন ঘুম ভাঙ্গল সাজ্জাদ ভাই দেখি স্টিয়ারিং এর ওপরই ঘুম। সবার ঘুম ভাঙ্গার পরে পাশের বার্গার কিং এ গেলাম সকালের নাস্তা করার জন্যে। নাস্তা করে আবারও পথে।
অবশেষে সকাল সাড়ে নটা নাগাদ উপস্থিত হলাম সেই শহরে, ডেন হাগ বা দ্য হাগ। তখনও এটার অতীত বা বর্তমান সম্পর্কে কিছুই জানিনা। পরবর্তীতে পড়ালেখা করে জানতে পেরেছি এই শহরের জন্ম ১২৩০ সাল নাগাদ। মূলত কাউন্ট ফ্লোরিস-চার পুকুর সহ ঐ যায়গা কিনে নেন তার শিকার কালীন বাসস্থান নির্মাণ করার জন্যে। পরবর্তীতে তার পুত্র রাজা উইলিয়াম-দুই এই বাসভবনকে প্রাসাদে পরিবর্তন করার পরিকল্পনা করেন যা এক সময় বাস্তবায়ন করা হয়ও। এই প্রাসদের পাশে যেই গ্রাম গড়ে উঠেছিল তাই কালের বিবর্তনে আজকের দিনের দ্য হগ শহরে রূপান্তর হয়।এর আগেও একবার বলেছিলাম এই শহরের মজার একটা বৈশিষ্ট্য আছে, বেশ কয়েকশো বছর যাবত অ্যামস্টারডাম নেদারল্যান্ডের রাজধানী হলেও রাজ্য শাসন করা হয় দ্য হগ থেকে। সংসদ, সুপ্রিম কোর্ট, স্টেট কাউন্সিল সব কিছুই দ্য হগ এ যদিও এটা নেদারল্যান্ডের রাজধানী নয়।
তখন অবশ্য এতকিছু জানার সময় নেই, আমাদের সামনে তখন অনিন্দ্য সুন্দর এক বীচ, বীচ দেখে তো সবার মাথা খারাপ অবস্থা। সব কটার মাথায় কিশোর বয়সের চপলতা ভর করেছিল। সাফায়েত ভাই তো দৌড় কম্পিটিশনের ঘোষণাই দিয়ে ফেললেন। ২৫ কিমি হাইকিং করে পায়ে কিঞ্চিত ব্যথা থাকায় আমি জাজের ভূমিকায় নাম লেখালাম। দৌড় শুরু হওয়ার পরে গ্রুপের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য সালমান ভাই না দৌড়ে দাঁড়িয়ে পরলেন যা দেখে পাশ দিয়ে যাওয়া এক ডাচ ললনা হেসে দিল এবং যাহার ফলে সালমান ভাইও ব্যাপক লজ্জা পেল না দৌড়োবার জন্যে। এদিকে ভুঁড়ি নিয়ে পিছে পড় গেল হাসনাইন, তবে হাড্ডাহাড্ডি কম্পিটিশন হল সাজ্জাদ ভাই ও সাফায়েত ভাই এর মধ্যে এবং শেষ হাসিটা হেসেছিল সাফায়েত ভাই।
বেশ খানিকটা সামনে দেখলাম প্রায় পাশাপাশি দুটো লাইটহাউস, বিচ দিয়ে হাটতে হাটতে আগালাম সেদিকে। পিয়ারের উপর দিয়ে হেটে যখন লাইটহাউসের কাছে যাচ্ছি তখন দেখলাম অনেকেই বর্ষী দিয়ে মাছ ধরছে। মাছ ধরাটা আমার ছোটবেলার শখ, তাই এক বৃদ্ধের পাশে দাঁড়িয়ে গেলাম দেখার জন্যে। তাকে হ্যালো বলার পরে সেও হেসে হ্যালোর উত্তর জানালো। এরপরে নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করল বেড়াতে গেছি কিনা। বুঝে গেলাম আড্ডাবাজ তাই আমিও আড্ডা জুড়ে দিলাম। জানাল বাসা পাঁচ কিলোমিটার দূরে, প্রতি বন্ধের দিনেই এখানে চলে আসে মাছ ধরতে। কি মাছ বেশি পাওয়া যায় জিজ্ঞেস করতে বিদঘুটে এক নাম জানাল, তবে ভদ্রলোক অবশ্য জানালেন মাছটার স্বাদ নাকি অসাধারণ। কতগুলো পাওয়া যায় জানতে চাইলে হাসতে হাসতে বললেন দুইজনের ডিনার বেশ ভালো ভাবে হয়ে যায়।
এরপরে লাইটহাউসের কাছে যেয়ে কিছুক্ষন ফটো-সেশন চলল। লাইটহাউসের ওখানেও দেখি এক ভদ্রলোক তার তিন ছেলে নিয়ে এসেছেন মাছ ধরতে, ছেলেগুলোর বয়স ছয় থেকে দশের মধ্যে। টোপ লাগানোর কাজ ছেলে গুলোই করছিল। কাছে গিয়ে দেখলাম সেন্টীপেড টাইপ কীট, কোথা থেকে এনেছে জানতে চাওয়া খুব অবাক হয়ে বলল দোকান থেকে কিনে এনেছে, মনে পরে গেলো এটা ইউরোপ, এখানে শিশুরা ডোবার পারে কেঁচো খুঁজতে যায়না। ইতোমধ্যে ও দেখি একটা টোপ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে জানতে চাইছে আমিও লাগাতে চাই কিনা, আমি এক লাফ দিয়ে পেছনে যেয়ে হাসতে হাসতে বললাম এগুলো ধরতে আমার গা ড়ি ড়ি করে। পরে সেখানে ঘুরেফিরে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরতি পথে পা বাড়ালাম।
রঙ্গিন শহর অ্যামস্টারডামে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় তিনটা বাজে। পার্কিং নিয়ে পড়ালেখা করার সময়ই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পার্ক অ্যান্ড রাইডের (P+R) বস এন লোমার যেহেতু কম জনপ্রিয় ফলে ওখানে ভিড় কম হবে, সেই অনুযায়ী সরাসরি সেখানেই চলে গেলাম। যেয়ে দেখি বিশাল লাইন, লাইনে আছি এমন সময় দেখি পার্কিং এর সিকিউরিটি গার্ড লাইনের সব গাড়িতে এসে যেন কি বলছে। আমাদের কাছে আসার পরে ভাঙ্গা ইংরেজিতে জানাল P+R ডিসকাউন্টেড পার্কিং খালি নেই, রাখতে হলে রেগুলার পার্কিং করতে হবে অথবা P+R অ্যারিনাতে খালি আছে সেখানে যেতে হবে। P+R ডিসকাউন্টেড পার্কিং যেটার দাম ২৪ ঘণ্টার জন্যে ১ ইউরো সেটার সঙ্গে ৫ জনের সিটি তে যাওয়া আসার খরচ ৭.৭০ ইউরো মানে ৯ ইউরো এরও কম খরচ। অথচ রেগুলার পার্কিং খরচ প্রথমত ১৫-২০ ইউরো ১০ ঘণ্টার জন্যে, এরপরে সিটি তে যাওয়া আসার জন্যে ওভি চীপ কার্ট কিনতে হবে ৭.৫০ ইউরো দিয়ে প্রতি জনের জন্যে, এরপরে প্রতিটা কার্ড মিনিমাম ১০ ইউরো করে রিচার্জ করতে হবে। মানে সবমিলিয়ে প্রায় ১০০ ইউরো খরচ। তাছাড়া এত সময় নিয়ে পড়ালেখা করে এই সমাধান বের করলাম তাই এত সহজে হার মানতে রাজী হলাম না। সাফায়েত ভাই, সালমান ভাই এখানেই রাখতে চাইল কিন্তু আমি জিদ ধরলাম অ্যারিনাতে যাবার, হাসনাইন আর সাজ্জাদ ভাইও আমার পক্ষে মত দেওয়ায় রওনা হলাম সেখানে। সেখানে যেয়ে দেখি কোন পার্কিং এ খালি নেই। তাই আবারো ফিরে যাওয়া বস এন লোমার, এদিকে সাফায়েত ভাই, সালমান ভাই তো চরম বিরক্ত বারবার আসা যাওয়া করায়।
পৌঁছে আবারো বিশাল লাইন, লাইনে যখন গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে আমি বের হয়ে সামনে আগালাম। গেইটের কাছে যেয়ে দেখি একটা ব্যারিয়ার অকেজো হয়ে যাওয়ায় ম্যানেজার কাচের ঘর থেকে হয়ে ব্যারিয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে ফোনে কন্ট্রোল রুমে কথা বলছেন। ম্যানেজার আরব, মাঝে একটু সময় ব্যস্ত না থাকায় এগিয়ে গেলাম। দেখি ইংরেজি ভালোই জানেন আবার বেশ হেল্প ফুলো। P+R এ কি সমস্যা জানতে চাইলাম, জানাল এমন না যে খালি নেই মানে আজকে সারাদিন আর পাওয়া যাবে না, নির্ভর করে P+R কেউ বের হয়ে গেলো কিনা তার উপর। ব্যারিয়ারের কাছে আমাকে দুটো লাইট দেখাল, বলল দেখ ওখানে উপরের টা P+R আর নিচের টা রেগুলার। এখন ব্যারিয়ারে কোন গাড়ি আসলে দেখো শুধু রেগুলার এই সবুজ লাইট জ্বলছে মানে P+R খালি নেই। এভাবে ওখানে দাঁড়িয়ে একটা করে গাড়ি বের হওয়া আর তার এগেন্সটে একটা গাড়ি ঢোকা দেখছি। ইতোমধ্যে হাসনাইনো আমার কাছে চলে এসেছে। আমাদের গাড়ির সিরিয়াল আসার চার গাড়ি আগে দেখলাম P+R এর লাইট জলে উঠেছে। আমরা দুজন তো ব্যাপক খুশি, সঙ্গে যেগুলো ঢুকছে সেগুলো কি পার্কিং নিচ্ছে সেটা দেখছি। আমাদের আগের তিনটা গাড়ি রেগুলার নিলো, কিন্তু সব আশায় পানি ঢেলে আমাদের আগের গাড়ি P+R এর পার্কিং নিলো। তখনো জানি না যেই তিনটা গাড়ি বের হয়েছে সেগুলো কি ছিল। আমাদের সময় আসার পরে গাড়ী ব্যারিয়ারের কাছে নেওয়ার পরে দেখি কোনটাতেই সবুজ লাইট জলে না, বুজলাম সেন্সরে সমস্যা। রেগুলার খালি আছে সেটাতো শিওর তবে সাজ্জাদ ভাইকে বললাম আল্লাহর নাম নিয়ে আগে P+R এ প্রেস করতে। আমাদের অবাক করে টিকেট বের হয়ে এলো। ম্যানেজার তখনো বাইরে দাঁড়ানো, সাজ্জাদ ভাই এর হাত থেকে টিকেট নিলেন শিওর হওয়ার জন্যে, দেখে একটা হাঁসি দিয়ে বললেন পেয়েছ তোমরা। আর গাড়ি থেকে নেমে গ্রুপ টিকেট কেটে সাফায়েত ভাই, সালমান ভাই এর দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাঁসি দিলাম আমি :p ।
গ্রুপ টিকেট দিয়ে বাসে করে সিটি সেন্টার গেলাম, যেতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লেগেছিল। এদিকে দুপুরের খাবার তখনো খাইনি, পেটে ছুঁচোর দৌড় শুরু হয়ে গেছে। ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান খুজছিলাম, পেয়েও গেলাম “গান্ধী রেস্টুরেন্ট”। বিরিয়ানি, তন্দুরি চিকেন, বাটার মাখনী, নান দিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়ার পরে সবাই শান্ত। এরপরে শহর প্রদক্ষিণ এ বের হলাম। কিছুক্ষন ঘোরাফেরার পরেই সবাই উসখুস করতে লাগলো, কারণ আর কিছুই না, সবারই উদ্দেশ্য রেডলাইট ডিসট্রিক্ট গমন। গণতান্ত্রিক ব্যাপার স্যাপার, সবার ইচ্ছাই এক হওয়ায় সেদিকেই পা বাড়ালাম।
ওখানে মূলত খালের দুই পাশে গড়ে ওঠা দলান গুলোয় দেহ কেন্দ্রিক ব্যবসার হরেক রকম পসরা সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে। আর সেই সঙ্গে আছে বিখ্যাত ক্যাফে। খালের পার দিয়ে বানানো পায়ে চলার পথ দিয়ে এক চক্কর দিয়ে ফেললাম। চিন্তা করে দেখলাম পাপের নগরীতে এসে কিছু পাপ না করলে ব্যাপারটা খারাপ দেখা যায় :p । মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক বিবর্জিত আদি রস আস্বাদন করবার মত রুচির অধঃপতন কারোরই হয়নি তাই সেটা বাদ, তবে ক্যাফেতেতো যাওয়াই যায়। তাই সাজ্জাদ ভাইকে অনুসরণ করে ক্যাফেতে ঢুকলাম আমি আর হাসনাইন, আর অতি ভদ্র সাফায়েত ভাই আর সালমান ভাই বাইরেই রয়ে গেলো।
রসদ সংগ্রহ করে ক্যাফে থেকে বের হয়ে অগ্নি সংযোগ করা হল। রেড লাইট ডিসট্রিক্টের পথে হাটতে হাটতে বায়ু সেবন। বায়ু সেবনের একটু পরে হাসনাইন জানাল ওর খারাপ লাগছে। একটু পরে রাস্তার পাশে বসে পরে জ্যাকেট সব খুলে ২ ডিগ্রি টেম্পারেচারে জাস্ট একটা গেঞ্জি পরা। তখন আমারও একটু একটু খারাপ লাগছে, কিন্তু ওর অবস্থা দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেলাম। বারবার জিজ্ঞেস করছি, “কিরে কি অবস্থা?” কিন্তু বান্দা কোন কথা বলেনা। ভয়ে আমার নিজের খারাপ লাগা তখন মাথায় উঠেছে। মিনিট পাঁচেক পরে হটাত কথা বলে উঠল, আমাকেও জ্যাকেট খুলতে বলল। যখন জিজ্ঞেস করলাম এখন ভালো লাগছে কিনা, জানাল “দেখছিস না এতক্ষণ পরে কথা বলছি, তুইও জ্যাকেট খোল, ভালো লাগবে”। আমি জ্যাকেট এর চেইনটা জাস্ট খুললাম আর মাথা থেকে কান-টুপি খুলে ফেললাম। কানে ঠাণ্ডা লাগার কথা, কিন্তু ওখানে যে কান আছে সেই অনুভূতিই পেলাম না। কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে কানের অস্তিত্ব অনুভব করতে শুরু করলাম, খারাপ লাগাটাও কেটে গেলো।
এরপরে সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা, এক অন্য রকম অনুভূতি। চারদিকের সব কিছু অনেক বেশি রঙ্গিন মনে হচ্ছিল, সময়ের হিসাব যেমন বুজতে পারছিলাম না তেমনি বুঝতে পারছিলাম না আমি কোন দিকে যাচ্ছি। এই পর্যন্ত আমিই ন্যাভিগেটর ছিলাম, তবে দিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় সাফায়েত ভাইকে বললাম এখন থেকে আপনি ঠিক করেন কোন দিকে কোন দিকে যাব, আমি আপনার পেছনে পেছনে আছি। এর মধ্যে আমি একবার সবাইকে ব্যাপক বিনোদন দিলাম, সাফায়েত ভাই জিজ্ঞেস করলেন সালমান কোথায়? আমার কেন যেন মনে হল সালমান ভাই হয়ত সামনের দিকে গেছে, সেই অনুযায়ী সামনে তাকিয়ে দেখলাম ৩০ মিটার সামনে উনি আমাদের দিকেই হেটে আসছেন। আমি হাত উঁচু করে সালমান ভাই, সালমান ভাই বলে ডাকতে ডাকতে দুই কদম আগেও বাড়ালাম, তখন পেছন থেকে সাফায়েত ভাই আমাকে টেনে বললেন আরে সালমান তো আমাদের পেছনে। সবাই তো হা হা করে হাঁসি, এর মধ্যে হাসনাইন আর সাজ্জাদ ভাই এর হাসির মাত্রাটা ছিল অন্য দুজনের থেকে অনেক বেশি, কারণটা সঙ্গত 😉 ।
এরপরে কিছুক্ষণ এদিকে ওদিক ঘুরে ফিরে রেড লাইট ডিসট্রিক্ট থেকে বের হলাম। সাফায়েত ভাই জানালেন “আইঅ্যামস্টারডাম” এর সঙ্গে ছবি না তুললে এখানে আসাই বৃথা। আমার থিংস টু ডু তে ছিল না, তাই ঠিকানা জানি না। রাস্তার লোকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ওটা কিছুটা দূরে। সিদ্ধান্ত হল ফেরার সময় ওখানে ঘুরে যাব। তাই এরপরে পা বাড়ালাম নিউওডাইক এর দিকে যেটা মূলত শপিং এরিয়া। ওখানে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে ফিরে টুকটাক কেনাকাটা এবং খাওয়া দাওয়ার পরে রাত সাড়ে এগারোটায় পা বাড়ালাম ফিরতি পথে পার্কিং এর দিকে।
পার্কিং থেকে গাড়ী বের করে রওয়ানা হলাম ভ্যান গগ মিউজিয়ামের দিকে, কারণ আই অ্যাম অ্যামস্টারডাম সাইন ঐ মিউজিয়ামের পাশেই। সেখানে যেয়ে ছবি তোলার হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো, দুই/একজনের মধ্যে তো বাঁদরামিই মাথা চাড়া দিয়ে উঠল যার ফলস্বরূপ অক্ষরগুলোর মাথায় চড়ে বসলেন। অন্যদিকে সাজ্জাদ ভাই আর সাফায়েত ভাই এর মধ্যে তো তীব্র প্রতিযোগিতা কার ছবি বেশি ভালো এসেছে সেটা নিয়ে। ছবি তোলার পরে আমার কাছে এসে নিজের ছবি এবং প্রতিদ্বন্দ্বীর ছবি কম্পেয়ার করে আমাকে কারেকশন দিচ্ছিলেন কতটুকুন কি তুলতে হবে। যখন আমার ছবি তোলা শেষ হল দুইজনেই ব্যাপক খুশি, কারণ দুইজনের মতেই তার ছবিটাই বেশি ভালো হয়েছে :p ।
ছবি তোলা শেষ হবার পরে আবারো পথে, এবারের গন্তব্য ডুসেলডর্ফ হফবাহানফ (মেইন ট্রেন স্টেশন)। ওখানে যাবার কারণ পরদিন সকালে ওখান থেকেই হাসনাইন ব্রেমেন যাবার বাস ধরবে। গাড়ী চলা অবস্থায় তখন পর্যন্ত একবারও না ঘুমানোর রেকর্ড শুধু আমার, তাই সাজ্জাদ ভাই আমাকে বললেন সামনে ওনার সঙ্গে বসতে। প্রথম দুই ঘণ্টা ভালোই গেলো, এরপরে ক্যাফে এর বায়ু ইফেক্টের জন্যেই হোক অথবা ক্লান্ত হবার জন্যেই হোক চোখ খোলা রাখাটা অসম্ভব মনে হচ্ছিল। আমি বুজতে পারছি মাঝে মাঝে চোখ একদম বন্দ হয়ে যাচ্ছে আবার লাফ দিয়ে জেগে উঠছি। ডুসেলডর্ফের কাছাকাছি গিয়ে সাজ্জাদ ভাই ব্যাপারটা খেয়াল করলেন, আমার সঙ্গে মজা নেওয়ার জন্যেই স্পীড একদম স্লো করে হটাত স্পীড বাড়িয়ে দিলেন, আর সেই সঙ্গে আমিও ধড়ফড় করে উঠে গেছি, তাই দেখে সাজ্জাদ ভাই আর হাসনাইন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি। ডুসেলডর্ফ হফবাহানফে যখন পৌঁছলাম তখন রাত সাড়ে তিনটা, ওখানে আড্ডা দিলা এক ঘণ্টার মত। এদিকে গাড়ি ফেরত দিতে হবে সকাল নটার মধ্যে, তাই হাসনাইনের থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা হলাম জারব্রুকেনের উদ্দেশ্যে।
সাজ্জাদ ভাই যখন আমার বাসার সামনে আমাকে নামিয়ে দিলেন তখন ৩১ শে ডিসেম্বর সকাল ৮টা। ম্যানেজার সাফায়েত ভাইকে জিজ্ঞেস করতে জানাল খরচ সব মিলিয়ে ৮০/৮৫ ইউরো এর মত :O । তাই বলা যায় সব দিক দিয়ে অসম্ভব ভাল লাগা নিয়ে অসম্ভব ভাল একটা ট্যুরের সমাপ্তি হল। এরপর আমি যখন বাসার দিকে হাঁটছিলাম, খুব অবাক হয়ে চিন্তা করছিলাম সাজ্জাদ ভাই কিভাবে পারলেন টানা দুই দিন এরকম লম্বা সফরে ড্রাইভে করতে সেই সঙ্গে আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজা করতে, আপনারাও নিশ্চয় এখন বুঝতে পারছেন শুরুতে ক্যান ওনাকে অতিমানব বলেছিলাম।
পূর্ববর্তী পর্বঃ ফ্রান্স
পূর্ববর্তী উপপর্বঃ ফোরবাক
পরবর্তী পর্বঃ ফ্রান্স
পরবর্তী উপপর্বঃ প্যারিস
vlo likhechen….tnx