(প্রথম পর্ব; আ বাইসাইকেল স্টোরি)
তিন তলার বাসা। কারো সাড়া শব্দ নেই। এতক্ষণে দিন শেষে লাইটের হালকা আলোতে আরো রহস্যময় মনে হতে লাগলো। বাড়ীর সামনে বাগান পেরিয়ে পেছনের উঠোনে দাঁড়ালাম। আমি জিজ্ঞেস করি, এখানে আর কেউ থাকেনা কেন? ভদ্রলোকের উত্তর শুনে আমি ‘থ’ হয়ে গেলাম। আল্লাহ , আমি কোথায় এলাম! এই লোক ভাড়ায় থাকেন আজকে দুই বছর।একা। পুরা বিল্ডিঙয়ে তিনি একা। নিচের তলা লাশ ঘর! এইখানে শেষকৃত্যের অনুষ্ঠান হয় বলে আমাকে একটা গাছের কাছে নিয়ে গেলেন। আলো-আঁধারীতে দেখা আসাধরন দৃশ্য। সবুজ ঘাসের মখমল গালিচায় ঢাকা চারদিক । কিন্তু এতক্ষণে ধীরে ধীরে আমার মনে নানা প্রশ্ন, শঙ্কা তৈরি হতে লাগলো।গা ভারি ভারি লাগছে।
গাছের নিছে পার্ক করা কালো প্রাইভেট কার। আমি গাড়িতে ট্যাঁস দিয়ে দাড়িয়ে পুরো পরিবেশটাকে যাচাই-বাছাই করি। লাশঘর,নিরবতা,বিছিন্নতা,অজানা শহর- সবকিছু মিলিয়ে আমি চিন্তা করি। কোন কুল-কিনারা পাইনা। মনে মনে বলি, আজকে না অন্যদিন আসি।
আমি কথা বলি। বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আসি। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করি। সাহস করে এগিয়ে যাই। দরজা খুলে সিঁড়ি বেয়ে দুই তলায় আসার পর বলে উঠলেন, ‘দিস ইস মাই রুম’।
রুমে প্রবেশ করার পর পরই তিনি কফি বানাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।
বিশাল রুম। মাঝামঝি দুইটি সোফা। দেয়ালে ইন্দোনেশীয় ও নেপালী চিত্রকর্ম। বিশাল এলইডি মনিটর। বুকশেলফে সব ডাচ বই। আফগান লিখক খালেদ হুছাইনী’র ‘দা কাইট রানার’ বইটি দেখলাম। বইটি পরে সিনেমা হয়েছে। আমার দেখা ছিল। পরে এই বই ধরেই আলোচনা করি।
এতক্ষণে তিনি কফি বানিয়ে নিয়ে আসলেন। আমি বলি এখন নামাজের সময়।মাগরিবের নামাজ… যদি কিছু মনে না করেন। ‘ ইয়েস, অফকোর্স দিস ইস ইউর রাইটস’। আমি নামাজ পড়ি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
এই বুড়ার বয়স এখন আশি বছর। ডাচ বিমান বাহিনীর পাইলট ছিলেন ১৭ বছর। জার্মানিতে ও ছিলেন। পড়াশুনা আমেরিকার টেক্সাসে। এখন অবসর। সরকার থেকে ভাতা পান। মাঝে মাঝে মিউজিয়াম গাইড হিসেবে কাজ করেন। ছেলেমেয়ে সবাই আলাদা থাকে। সবার আলাদা সংসার আছে। সবাই চাকরি করে।
উনার প্রশ্ন, কেন এতো টাকা খরচ করে এতো দূরে পড়াশুনা করছি। আমি ডাচ সরকারের বৃত্তির কথা বলি।
সময় গড়ায়, আলোচনা বাড়ে। আবারো কফি নিয়ে আসলেন।
তাকে বলি, আমি ডাচ ভাষা শিখতে চাই। আপনার পরামর্শ ও সহযোগিতা চাই।“ ডাচ শিখার কী দরকার, অল্প কিছু মানুষ কথা বলে। আর সবাই তো ইংরেজিতে কথা বলতে পারে” । উনার জবাব শুনে একটু থেমে গেলাম।
পারিবারিক বন্ধন নিয়ে খুব জানতে ইচ্ছে হল।
আমি জিজ্ঞেস করি,
-আপনার বউ কই?
ও, এমা, যার সাথে ঐদিন দেখা হয়েছিলো। ও কাছাকাছি একটা বাসায় থাকে।
-তো, একসাথে থাকলে কি ভালো হতোনা…
না, আমি আমার মতো ও ওর মতো আছে। যার যার মতো একটা স্পেস দরকার। আমাদের তো আর কোন প্রবলেম হচ্ছেনা।
-ঠিক আছে, আমি বলছি, এই বয়সে একসাথে থাকলে তো দুই জনেরই লাভ।পরস্পর দেখাশুনা…।
আমার প্রবলেম হলে ওকে ডাকি, ওর প্রবলেম হলে আমি যাই। এমনিতেই প্রতি সাপ্তাহে দেখা হয়। ছেলেমেয়েরা আসে মাঝে মাঝে। এইতো দুইএকদিনের মধ্যেই আসতে পারে।
-আপনার কুকুর নাই?
না, আমার কুকুর ভালো লাগেনা। এমার আছে। দেখনাই ও সারাক্ষণ কুকুর নিয়ে থাকে (হাসি)।
-এমা কি বাসায় একা থাকে?
হুম, একা থাকে। সাথে ওর কুকুর।
আমরা দুইজনই হেসে উঠি। খুব মায়া হচ্ছিল। কী জীবন!
আমার দাদার কথা খুব মনে পরে।
আমি উঠে মগ নিয়ে রান্না ঘরে যাই।টেবিলে দেখি কিছু ম্যাগাজিন। পেপার, সাময়িকী থেকে রেসিপির পাতাটা আলাদা করে রেখেছেন।আমি হাসছি দেখে উনি বলে উঠলেন, ‘এখান থেকে দেখে দেখে রান্না করি’।
আমাদের দেশে বুড়ারা এই বয়সে নাতিদের নিয়ে থাকে। সারাক্ষণ মজা করে শুনে উনি বলেন, ‘দিস ইস অল এবাউট কালচার, ইট ডিফারস’।
আমি বেসিনে মগগুলো ধুয়ে রাখি। উনি পাশে দাড়িয়ে হালকা হেসে বলেন, ‘আমি এমাকে(বউ) সব বলে দিবো’।
আহা, কী নিষ্পাপ হাসি।
কথা বলতে বলতে বের হই। দেখি দরজার পাশে রেকে সাজানো ওয়াইনের বোতল।
এই বুড়া বয়সেও ওয়াইন খায়! হায় আল্লাহ।
তো ওয়াইন খেলে প্রবলেম হয়না? আমি জিজ্ঞেস করি।
না, এখন একা খাইনা। এমা আসলে বা কারো সঙ্গ পেলে খাই।
সিঁড়ির সামনে দেয়ালে মেরিলিন মনরোর ছবি।
“আজিজ, এইটা আমার বউ আমাকে গিফট করেছে…! একটু হসে বললেন, আমার বউ এতে জেলাস ফিল করেনা ।
সিঁড়িতে নামতে নামতে দেখি সাইকেল।
-সাইকেল কি আপনার?
হ্যাঁ,
-দাম কতো?
তুমি বল।
-এক হাজার ইউরো ?
হা…হা… চার হাজার ইউরো! এটা ইলেক্ট্রনিক সাইকেল।
-আইএম প্লানিং টু হ্যভ এ বাই সাইকেল, বাট ইটস টু এক্সপেন্সিভ।
ইয়েস, বায় সেকেন্ড ওয়ান। ইটস চিপার।
রাত বাড়ছে। আমি বিদায় নিই। ভদ্রলোক রাস্তা পর্যন্ত এসে বিদায় দিলেন।
কিছুদিন হল। আমি ক্লাস শেষে ফিরছি। উনি দুতালার বেলকনিতে বসে আছে। আমাকে ডেকে খুব দ্রুত চলে এলেন। রাস্তায় দেখা।
আসেন বাসায় আসেন, আমি বলি।
না , তোমাকে দেখেই আমি চলে এসছি। দরজা- জানালা খোলা। নাও এইগুলো তোমার জন্য।
উনার হাতে গিফট আর চোখের ড্রপ।
আমি তো অবাক।
আমার চোখে সমস্যা করছে, উনাকে কবে বলছি আমার মনে নেই। কিন্তু উনি মনে রেখেছেন!
উনি আমাকে আর অবাক করে দিয়ে বললেন,
তোমার জন্য সাইকেলের কথা বলছি। এক ভদ্র মহিলা তার সাইকেল দিবে!
মানে? আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা।
উনি বলেই দিলেন, ইটস ফ্রি! আই টোল্ড হার অ্যাবাউট ইউ!
সময় থাকলে এখনই চলো।
আমি ব্যাগ রাখতে বাসায় আসি। বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াবো, এমনি গাড়িটি আমার সামনে এসে ঝাঁকুনি দিয়েই থেমে গেলো। কালো রঙের গাড়িটি নিয়ে উনি আমার জন্য ওয়েট করছে, আমি খেয়াল করিনি। বেশ কিছু দূরে। গাড়ি থেকে নেমে আমি দাড়িয়ে আছি। বুড়া ভেতরে গেলেন। সুনসান নীরবতা। বাগান আর গাছের আড়ালে বাসা দেখা যাচ্ছেনা।একটু পরেই ভদ্র মহিলা আসলেন। গ্রিটিংস হল। গ্যারেজ খুলে সাইকেল বের করলেন।
ভদ্র মহিলার অতৃপ্তি। সাইকেলটি আগে থেকে পরিস্কার করে রাখতে পারেননি! আমার পড়াশুনার খোঁজ খবর নিলেন। একটু পরে বললেন, রান্নার আসবাবপত্র লাগবে কি না।
কী লজ্জা! আমি সরাসরি না করি।
বিদায়ের আগে ‘ভালো করে পড়াশুনা কর…’ উপদেশ দিতেও তার ভুল হলনা।
আমি সাইকেল নিয়ে ফিরছি।
নেদারল্যান্ড মানেই সাইকেল। সাইকেল না হলে জীবন অচল।
৭০-৯০ ইউরো খরচ থেকে বাঁচা গেলো।
এই মুহূর্তে বিশাল সহায়।
এই ডাচ দম্পতি কে মাঝে মাঝে গিফট দিই। কিছুদিন আগে খিচুরি রান্না করে বাসায় দাওয়াত দিয়েছি ।
একদিন ফোন দিয়ে বললেন, আমি ফ্রি থাকলে যেন সন্ধ্যেয় আসি।
আমি ক্লাস শেষে বাসায় যাই। খাবার সংস্কৃতি নিয়ে গল্প করি। আমার কী কী খাবার পছন্দ।
কিছুক্ষণ পরে বলেন, আসো, খাবার নিয়ে আসি।
মানে কী ? উনি আমার সাথে কথা বলার ফাঁকে খাবার অর্ডার দিয়ে রেখেছেন !
উনার গাড়ি নিয়ে বের হলাম। থাই খাবার দোকান। চিংড়ি মাছ, সবজি সাথে ফ্রাইড রাইস।
ফেরার পথে বললেন, এটা তার পছন্দের দোকান। সবাই অর্ডার করে, আর নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে নিয়ে আসে।
সেদিন দেখা হলে বললেন, উনার যে মেয়েটি ডাচ বিমান কোম্পানিতে চাকরি করতেন, ক’দিন আগেই মেয়েটির ডিভোর্স হয়েছে। যেদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কাছে নেদারল্যান্ড দল হেরে যায়, উনি ফোন করে শুভেচ্ছা জানালেন। কখনো দেখা হলেই, প্রথম জিজ্ঞাসা, কোন প্রবলেম আছে কি না ।
নতুন দেশ। অচেনা মানুষ। অপরচিত চারপাশ। তবু এই ভালবাসা, এতো আতিথেয়তা!
শোধ করি কীভাবে !
(প্রথম পর্ব; আ বাইসাইকেল স্টোরি)
০৩ জুন,২০১৬
আজিজ মুনির
আরনেম/ নেদারল্যান্ড।