টেকনিশে উনিভার্জিট্যাট ডর্টমুন্ড বা সংক্ষেপে টেউ ডর্টমুন্ড (ইংরেজীতে টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অফ ডর্টমুন্ড বা টিউ ডর্টমুন্ড)| খুব একটা বিশাল বড় জায়গা নিয়ে নয়। কিন্তু স্থাপনা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে যথেষ্ট ভরপুর দুইটি আলাদা ক্যাম্পাস নিয়ে গঠিত এই ভার্সিটিটি। দুটি ক্যাম্পাসের মধ্যখানে গহিন বন। এক ক্যাম্পাস থেকে আরেক ক্যাম্পাসে যাই স্কাইট্রেনে করে, অনেকটা রোপওয়ের মত এই স্কাইট্রেন। প্রথম প্রথম ভাবতাম প্রাকৃতিক এই বনের উপর দিয়ে স্কাইট্রেন বানানোর আইডিয়াটা কার মাথার ভিতর থেকে আসল? দুই পাশে গভীর জঙ্গল আর কখনও মাঝখানদিয়ে বা কখনও বনের উপরদিয়ে বা কখনও ধবধবে চোখ ঝলসান সবুজ মাঠের উপর দিয়ে সাই সাই করে দুলতে দুলতে চলছে এই স্কাইট্রেন। অবাক হয়ে স্কাইট্রেন থেকে নীচের দিকে আর দুপাশে তাকাই আর চিন্তা করি এই বনে তো ৮ থেকে ১০ টা ইলিয়াস আলীকে গুম করে দিলে কেয়ামতের আগের দিন পর্যন্তও তাদেরকে খুঁজে পাওয়া যাবে না…!!
ভার্সিটির গোল চত্বরে রয়েছে একটি সুন্দর পানির ফোয়ারা। ফোয়ারার চারিদিকে গোল করে কংক্রীটের আসন। স্থাপত্যের চতুর নিদর্শণ। আর চারিদেকে চোখ জুড়ানো সবুজ পাতায় ভরা গাছ। নীচে ছায়াঘেড়া একাংশ। কেউ বসে আছে বসার আসনে, কেউ খাচ্ছে, কেউ কেউ গল্প করছে। আমি প্রায়ই আসি এখানে। রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং বা এডভান্সড এনএমপিসি কন্ট্রোলার বা অপটিমাইজেশানের জটীল কঠিন আর মাথার এক হাত উপড় দিয়ে চলে যাওয়া সব ইকুয়েশানের চাপে জর্জরিত আমার ছোট্ট কোমলমতি ব্রেইনটিকে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম দিতে চলে আসি এখানে। গোল চত্বরের একপাশে ১২ তলার ম্যাথ বিল্ডিং আর এক পাশে মেনজা (জার্মানীর ক্যান্টিন)| টিউ ডর্টমুন্ডের মেনজাটা বেশ বড়। একটা হকি খেলার মাঠের থেকেও বড়। দুনিয়াতে নাই এমন কোন খাবার নাই হয়ত। আর জার্মানরা কি না খায়! জানোয়ারের মত খায়! যেখানে সেখানে খায়। যা পায় তাই হয়ত খায়! তবে এরা যেখানে সেখানে বাঙ্গালীদের মত আবর্জনা ফেলে দেয় না। বেশ পরিষ্কার রাখে সবকিছু। তবে বাঙ্গালীর পানের পিক আর চুন শিল্পের মত এরাও রাস্তাঘাটে প্রচুর চুইংগাম এবং সিগারেট ফেলে।
জর্মানীতে ভার্সিটিগুলোকে সংক্ষেপে ‘উনি’ (uni) বলে সম্বোধন করা হয়। এই দেশের উনিগুলোর অপ্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যেগুলো মধ্যে বোধহয় সবচেয়ে প্রধান হচ্ছে টিলা বা ঢিবি টাইপের চোখজুড়ানো সবুজ ঘাসের ছোট ছোট মসৃণ মাঠ। এরকম সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ প্রথম দেখেছিলাম উইন্ডোজ এক্সপির ডিফল্ট ডেক্সটপ ব্যাকগ্রাউন্ডে, ভার্চুয়ালী, কিন্তু বাস্তবে চোখ জুড়ানো এমন ঘন সবুজ উঁচু-নীচু মাঠ দেখলাম এইদেশে এসে। তবে দৃষ্টিকটুর মত এইসমস্ত মাঠের সমস্তটা জুড়েই রয়েছে ছোট ছোট গর্ত, সবই কাঠবিড়ালীর কাজ। সামারে ক্রিষ্টাল ক্লিয়ার নীলাকাশপানে চেয়েচেয়ে আর ছায়াঘেরা এই নরম সবুজ ঘাসের উপর শুয়েবসে সারাদিন পার করে দেওয়া যাবে! জার্মানরা অবশ্য তাই-ই করে। বন্ধু বান্ধব নিয়ে সূর্যস্নানে বসে যায়, ক্যাম্পাসেই। পাশ্চাত্য দেশের সূর্য্যস্নান নিয়ে অনেক ‘মিথলজী’ শুনেছিলাম আর মনে মনে পুলকিত হয়েছিলাম দেশে থাকতেই, কিন্তু এইদেশে এখনও তেমন কিছু দেখতে পাইনি!! আগামী সামারে আমার স্টেটের ‘সি’ জোনে বা নদীর তীরে ঘুড়তে যাওয়ার ইচ্ছা আছে! দেখি কি অভিজ্ঞতা হয় তখন!!
এই দেশের ৬ মাস ব্যাপী সামারের সৌন্দর্য্য আসলেই চোখ ঝলসানো। আমাদের দেশের বসন্ত আর পহেলা বৈশাখের মত। রঙ্গীন, কলকাকলী, চাঞ্চল্যতা আর উদ্যমতায় ভরা চারিদিক। ধবধবে সাদা চামরার রং বেরঙ্গের স্বল্পবসনার ক্লিওপেট্রারা এই সৌন্দর্য্যের আগুনে পিউর ঘি ঢেলে যেন আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দিয়েছে!! (বিশ্বাস করুন! প্লিজ!)…| স্বল্পবসনা হলেও তাদের ক্লীভেজ লিমিট (!) কিন্তু শালীনতার গন্ডিতেই থাকে, অন্ততপক্ষে জার্মানদের। আগে যেমনটা ভেবেছিলাম পোশাক আশাকে তেমনটা অশালীন নয় এই জার্মান জাতি, এদেরকে বেশ কনজারবেটিভই লাগল আমার কাছে। জিন্স কাপড়ের একদম ছোট ছোট শর্টপ্যান্ট আর হালকা ঢিলেঢালা শর্ট স্লীভ বা স্লীভলেজ টি শার্টে আর বিশাল বড় বড় সানগ্লাস পড়ে ধবধবে সাদা চামড়ার শরীরের বেশ খানিকটা উন্মুক্ত করা সামারের জার্মান ললনাদেরকে দেখে আসলেই মনে হয় এরা বোধ হয় অন্য জগতের কেউ! সেই তুলনায় ছেলেরা বেশ ফরমাল ও নরমাল। থ্রিকোয়ার্টার প্যান্ট আর হাফহাতা শার্ট বা টিশার্ট। আমিতো একদিন পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি আমার কোর্স টিউটর গরমের জ্বালায় (!) শটর্স পরেই পরীক্ষাহলে ডিউটি দিতে চলে এসেছেন। ভাগ্যভাল সামারে আমার কোন টিউটরিন ছিল না!… নইলে ‘পিলার’এর সংখ্যা হয়ত আরও একটি বাড়ত!! (জার্মান ভাষায় পুংলিঙ্গবাচক শব্দের শেষে ইন যোগ করতে হয় স্ত্রীলিঙ্গ বুঝাতে)
ঘটনা ১||
বন্ধু প্রতীম জামাল উদ্দিন আদনান। থাকে জার্মানীর নামকরা শহর মিউনিখে। তার সাথে আমার খিটিমিটি লেগেই থাকে বায়ার্ন মিউনিখ আর বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডের খাতিরে। পশ্চিমাদের ভদ্র জাতি হিসেবে জানলেও খেলাধুলার ক্ষেত্রে বোধহয় এটা খাটে না। বেফাউবে’র (BVB) খেলার দিন আমি প্রায়ই দেখি তাদের চরম উগ্র সমর্থকদের চুড়ান্ত পাগলামির বহর! এরা ফুটবল জাতি বলতেই হবে। ডর্টমুন্ডের আনাচে কানাচে হলুদ কাপড়ে কালো করে লিখা BVB এর পতাকা যথেষ্ট পরিমানে উড়তে দেখা যায়। গলার মাফলার, টিশার্ট, হাতের ব্যান্ড, গাড়িতে পতাকা, খেলনা, কফি মগ ইত্যাদি হরেক রকম জিনিষে হরহামেশাই দেখতে পাওয়া যায় তাদের এই লোগো।
জার্মানীর সবচেয়ে বড় বড় ইলেকট্রনিক্সের দোকানগুলো মধ্যে এক হচ্ছে স্যাটুর্ন। একদিন সেখানে গিয়েছিলাম ঘুড়তে। স্যাটুর্নের একটি বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে এলসিডি টিভির সমাহার। বিশাল বড় বড় ক্রিস্টাল ক্লিয়ার টিভির সমাহার চারিদিকে। সেদিন আবার BVB এর খেলা ছিল। আমাদের দেশের মত এরাও ইলেক্ট্রনিক্সের দোকানে এসে ভিড় জমায় খেলা দেখতে। তবে একটু ভিন্ন আমেজে!! আমি দেখলাম তারা পাটি, ম্যাট্রেস আর বালিশ নিয়ে শোরুমের ফ্লোরে দিব্যি আরাম করে শুয়ে আছে, সবাই লাইন করে শুয়েছে, আর আয়েশ করে খেলা দেখছে! খাবার দাবারও খাচ্ছে! চা, কফি বা মদের বোতল সবার হাতে হাতে, আর একটু পর পর লাফিয়ে উঠে চিল্লাচ্ছে!! যেন একটা মিনি স্টেডিয়াম!! সে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা! ভাগ্যিস তারা বেশ ভদ্র, আমাদের দেশে এমন সুযোগ দিলে তো দল হারার পর ভাঙ টেলিভিশন বলে সুন্দর সুন্দর এলসিডি গুলোকে ভেঙ্গে দোকান একেবারে তছনছ করে দিতাম আর পারলে দুই চারটাকে হাসপাতালেও পাঠিয়ে দিতাম!!
ঘটনা ২||
ডাক্তারের ওয়েটিং রুমে বসে আছি। উপরে মাইকে নাম এবং রুম নাম্বার কল করার পর রুগীরা উঠে যাচ্ছে নির্দিষ্ট রুমে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য। আমি বসে আছি কখন আমার নাম ডাকবে। জার্মান নামগুলো বড়ই অদ্ভুত লাগে আমার কাছে। ইংরেজীতে উচ্চারন করলে কিছু নাম হয় আন্না উ(উ)ষ্টার, কাটজা, ব্যারবেল (ভাগ্যিস ডোরবেল না!), ইওর্গ, হেলমিশ ইত্যাদি। এইদেশের শহরের নামগুলোও বেশ মজার। যেমন হাগেন, আখেন, এসেন, হাম, কোন, কিল ইত্যাদি!! যাইহোক, আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে নামগুলো শুনছিলাম আর মনে মনে হাসছিলাম তাদের নামের বাহার দেখে! কেউ কেউ ওয়েটিং রুমে ঝিমুচ্ছে। কেউ মনযোগ দিয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে, কেউ গল্প করছে। তখন নাম ডাকা শুনতে না পারলে নার্স ওয়েটিং রুমে এসে আবার নাম ডেকে যাচ্ছে। আমার বেশ মজাই লাগছে। হটাৎ এক সুন্দরী নার্স এসে ঢুকলেন ওয়েটিং রুমে আর জার্মান ভাষায় বড়ই বিদঘুটে একটা নাম ডেকে এবং সাথে আরও হাবিজাবি কি সব বললেন যার আগা মাথা কিছুই বুঝি নাই। এমন হাসকর নাম শুনে আমি ফিক করে হেসে দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ ধরে কেউ রেসপন্স করে নাই দেখে নার্স আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললেন, হেয়া জুত্রাদা? (মি. সূত্রধর?)
হায়রে জার্মান ভাষা!
ঘটনা ৩||
এইদেশের উনিগুলোতে যেখানে সেখানে নোটিশবোর্ড থাকে। সাধারন ছাত্রছাত্রী থেকে যে কেউ নির্দিষ্ট স্থানে বিজ্ঞাপন দিতে পারে। হরেক রকম বিজ্ঞাপনের বাহার দেখা যায়। টিউশনি, বাসা সাবলেট, এপার্টমেন্ট ভাড়া, ফার্নিচার বিক্রি, কম্পিউটার বা এমনটি গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপনও দেখা যায়। তবে আমার দেখা সবচেয়ে মজার বিজ্ঞাপনটি হচ্ছে ‘গালফ্রেন্ড চাই’ বিজ্ঞাপন! প্রায়ই দেখা যায় এই দেশে! একদম স্কুল বয়স থেকেই এদের প্রেম শুরু হয়। তবে আমাদের দেশের মত প্রেম নয়। দৈহিক সম্পর্কের ভিত্তিটাই এখানে প্রবল। তবে এরা ‘I don’t care who you are, Where you’re from, What you did, As long as you love me!’ নীতেতেই বেশী বিশ্বাসী বোধহয়। পূর্বে কার সাথে কোন আকাম কুকাম (!) করেছে সেটা নিয়ে মেয়েরও কোন মাথাব্যাথা নাই, ছেলেরও নাই!!
রেষ্টুরেন্টে একটি টেবিলে দুই জন বসে আছে এক ঘন্টারও বেশী সময় ধরে। প্রেমিক প্রেমিকা। টেবিলে শুধু একটি প্লেটে হাতেগোনা কয়েকটি আলুভাজির টুকরো, সেগুলোই খেয়ে শেষ করতে পারছে না এক ঘন্টা ধরে। ‘চক্ষুনষ্ট’ করা সুন্দরী দুগ্ধরাঙ্গা ঐ মেয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রিয়তম’র দিকে! আহা! কি প্রেম! কিন্তু আমার চক্ষু আর মস্তক নষ্ট হয়ে গেল ছেলেটাকে দেখে! একদম ১০০% কাল কুচকুচে পিউর আফ্রিকান ছেলে যার চোখের সাদা অংশ আর সামনের পাটির দাঁতগুলো ছাড়া আর কোন কিছুই দৃশ্যমান হবে না রাতের বেলায়! এমন ছেলেকে কিভাবে পছন্দ করল এই মিস ইউনিভার্স মার্কা মেয়েটি সেটা ভাবতেছিলাম, আর নিজের সুশ্রী বাদামী চামড়া পানে কয়েকবার দেখে মনটা চরম দুর্বিষহ হয়ে খটমটে হয়ে উঠছিল বাঙ্গালী ললনাদের প্রতি!!
বিদ্র: বিশাল ইউনিভার্সের মধ্যে ছোট্ট একটি সোলার প্যানেলের ছোট্ট একটি পৃথিবীর ছোট্ট একটি দেশ জার্মানীতে ছোট্ট একটি শহর ডর্টমুন্ড। সেখানে আরও ছোট্ট এই আমি গত দুই বছর ধরে যা দেখেছি তার ভিত্তিতেই উপরের এই লেখা। লেখাটা নিতান্তই ব্যাক্তিগত! এটিকে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরে কেউ জার্মানীকে এবং এই লেখার লেখককে মনে মনে বিভিন্নরূপে কল্পনা করবেনা না কৃপাপূর্বক!!
লেখক
শাওন সূত্রধর
আপনার লেখনিতে আমি নিগূঢ় সাহিত্যরস উপলব্ধি করেছি।
একটা আবদার রইল হাতটা যেন থেমে না থাকে।
jode valo mone karen facebook link ta diben.
অসম্ভব ভাল লাগল। একটি সত্যি কথা বলি। আমার জীবনে আমি এখন একটি সংকটময় অবস্থা পার করছি, যেহেতু ব্যাচেলর শেষ করার দ্বারপ্রান্তে। প্রচন্ড রকমের হতাশার এই দিনগুলোতে অনুপ্রেরণা খুঁজছি আপনাদের লেখাগুলো থেকে। অনেক অনেক ভালবাসা রইল আপনাদের জন্য। ভাল থাকবেন।