“পোলিৎছাইলিশ ফুরুংসয়েগনিশ” এই জার্মান শব্দটা এ যাবৎকাল পর্যন্ত আমার জানা সবচেয়ে দুর্বোধ্য শব্দ ৷ ইংরাজী অর্থ “পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট” ৷ জার্মান জীবনের প্রথমাবস্থায় ইবে তে (ebay) একটা ছুটা কাজের জন্য এই কাগজের দরকার পড়লো ৷
জার্মান জীবনে প্রথমাবস্তায় ডাংকে বিটে, গুটেন টাগ পর্যন্ত ছিল আমার দৌড় ৷ বড় জোর এনশুলডিগুং (সরি, এক্সকিউজ, পারডন) কোন রকমে চালাইতে পারতাম ৷ একজন বাংলাদেশী ছেলে প্রথম অবস্থাতে আমাকে শিখিয়ে দিয়েছিল, কারো সাথে গুতা টুতা খাইলেই, সাইড মাইড চাইলে চোখ বন্ধ করেই হড়হড় করেই এটা বলে দিতে হবে, এরপর কোন রকমে বাচ্চাদের মত শব্দটা মুখস্ত করে নিয়েছিলাম ৷ পরে যখন ভিড়ের মধ্যে বা অপ্রস্তুত হয়ে পাব্লিকের সাথে গুতাটুতা খেতাম বা পথ ছাড়তে বলতাম, চোখের পলকেই এনশুলডিগুং বলে দিতাম ৷ কাজ হয়ে যেত ৷
ফিরে আসি পোলিৎছাইলিশ ফুরুংছয়েগনিশে ৷ তো কাগজ টা নেবার জন্য গেলাম রাটছ্ হফে (সিটি রেজিশট্রেশন সেন্টার) ৷ পুরা বানান টা কাগজে লিখে নিলাম, ইশ ব্রাউখে আইনে পোলিৎছাইলিশ ফুরুংছয়েগনিশ (আই নিড এ পুলিশ ক্রিমিনাল সার্টিফিকেট) ৷ তখন সকাল বেলা রাটছ্হফে অনেক ভিড় ৷ সাদা, কালো, শ্যামলা, ভুষা কালো চামড়া, বেটে, লম্বা, বড় চুল ওয়ালা, মোরগের টিকি মার্কা চুল ওয়ালা, ছেড়া প্যান্ট ওয়ালা (ফ্যাশান), কোটপ্যান্ট ওয়ালা, কানে বড় ফুটা ওয়ালা, ছোট ফুটা ওয়ালা, সারা শরীরে হায়ারোগ্লিফিক টাইপের ছবি আকা, পরিস্কার শরীর ওয়ালা ইত্যাদি ইত্যাদি.. সব মিশিয়ে নানান রকমের চামড়া নানান রকমের গড়নের, নানান রকমের ঢংয়ের মানুষের মিলন মেলা ৷ কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে বুর্গার সার্ভিসের জন্য আমার সিরিয়ালের জন্য টোকেন নিলাম ৷
টোকেনের উপরে লেখা বার্গার সার্ভিস মানে আর কি জার্মান উচ্চারনে দাড়ায় বুরগার সার্ভিস ৷ বাংলা মানে নাগরিক সেবা ৷ জার্মানীতে প্রথম যখন সিটি রেজিস্ট্রেশন করতে এসেছিলাম, বার্গার সার্ভিস লেখা দেখে বিভ্রান্তিতে পড়েছিলাম ৷ ভেবেছিলাম, বার্গার টার্গার খেতে দিবে, সে কি টেনশন আমার, হালাল হবে তো বার্গার? হালাল না হলে এত মানুষের সামনে ক্যামনে কি করি, পর্ক মর্ক না খেতে দেয় আবার, আমি আবার হালাল ছাড়া খাইনা ৷ যাই হোক বার্গার খেতে দেয়নি ৷ ঘর বাড়ি রেজিস্ট্রেশন করে ছেড়ে দিয়েছিলো ৷
আবারো ফিরে আসি পোলিৎছাইলিশ ফুরুংছয়েগনিশে ৷ একটা কোনার চেয়ারে ফাকা পেলাম চট করে বসে পরলাম, পাশে খালাম্মা বয়সের এক আপা ৷ খালাম্মা বয়সের আপা কেন? কারন ওনাকে দেখে মনে হলো বয়স অনেক তবুও বয়স ছেটে ফেলার জন্য তার অক্লান্ত পরিশ্রম, বেজায় কৃত্রিম সাজ সজ্জা ৷ যাই হোক অপেক্ষার পালা ৷ এই সময়টাতে সবাই গল্প গুজব করছে আর আমি পড়া মুখস্ত করছি পোলিৎছাইলিশ ফুরুংছয়েগনিশ (রিপিট ফর ইনফিনিটি টাইমস) ৷ পাশের খালাম্মা আপাও খুব কিউরিয়াস, আমি গুন গুন করে কি মুখস্ত করি, আমার উচ্চারন খেয়াল করে নিজেই সংশোধন করে দিলেন ৷ সংশোধিত পরিমার্জিত পুলিৎছইলিশ ফুরুংছয়েগনিশ নিতে কখন ডাক আসবে অপেক্ষার পালা ৷ আমার কনফিডেন্ট লেভেল বেড়ে গেল, পকেটে কাগজ ঢুকিয়ে ফেললাম ৷ ইটস ওকে পোলিৎছাইলিশ ফুরুংছয়েগনিশ ৷ ইশ ব্রাউখে আইনে পোলিৎছাইলিশ ফুরুংছয়েগনিশ ৷ আমার ওপারের ডাক এসে গেল, টোকেন নিয়ে ছুটে গেলাম, ছোটার গতিতে মস্তিস্ক থেকে পোলিৎছাইলিশ ফুরুংছয়েগনিশ টপাস করে বেরিয়ে গেল, পড়ে রইলো শুধুই পোলিৎ টুকু ৷ কাউন্টারের সামনে দাড়ালাম, একজন বয়স্ক মহিলা ৷ তারপাশে একটা পুচকি মেয়ে, মনে হয় ইন্টার্নশিপ করতেছে ৷ মহিলার হাতে টোকেন দিয়ে হালো (হ্যালো) বলেই মুখস্ত পড়া বলতে চেষ্টা করলাম, ইশ ব্রাউখে আইনে পোলিৎ পোলিৎ পোলিৎ পোলিৎ পোলিৎ, ততক্ষনে দুজনই মিটমিট করে হাসছে, বিব্রতকর অবস্থা ৷ আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মাঝখানে পকেট হাতড়ানো শুরু করেছি, সেই চিরকুট কোন পকেটে গুজেছি ভুলে গেছি, হাতড়ায়ে বের করার আগেই ঐ পুচকি মেয়ে আমার হাব ভাব দেখে বুঝে গেছে, নিজেই বলে দিলো পোলিৎছাইলিশ ফুরুংছয়েগনিশ ৷ আরো গুজু গুজু করে ঐ মহিলাকে কি যেন বললো ৷ আমি আবেগে বলে ফেললাম, হুম হুম, ঠিক ঠিক ইয়া (হ্যা) রিশটিশ (সঠিক) ৷ ইশ ব্রাউখে আইনে পোলিৎশাইলিশ ফুরুংছয়েগনিশ ৷ইয়া পোলিৎছাইলিশ ফু…….রুংছয়েগনিশ ৷ আইনে পোলিৎছাইলিশ ফুরুংছয়েগনিশ ৷😃
মাহবুব মানিক
গবেষনা সহকারী
ইউনিভার্সিটি অফ এপ্লাইড সাইন্স, মারসেবুর্গ ৷
হালে (জালে)
স্যাক্সোনী আন হাল্ট
জার্মানী ৷
Facebook ID:www.facebook.com/mahbub.manik1