একটা স্বপ্ন এবং কিছু নির্ঘুম রাতের গল্প 🙂 😉

জার্মানির জন্য প্রথম ভাবা শুরু করি ২০১৫ সালে। প্রথম থেকেই আমার সাথে সব প্রবলেম লেগেই ছিল। ২০১৫ তে যখন এপ্লাই করব ভেবেছিলাম তখন এপ্লাই করতে গিয়ে দেখি বেশিরভাগ ভার্সিটির এ্যাপ্লিকেশন ডেডলাইন পার হয়ে গেছে। খুবই হতাশ হয়ে পড়লাম। রাতেই জার্মানিতে থাকে এক বন্ধুকে ফেবুতে নক দিলাম। সে সাহস দিল । বললো জবটা কন্টিনিউ করতে পাশাপাশি আইএলটিএস এর প্রিপারেশন নিতে। মনে মনে ভাবলাম এক বছরই তো দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে কিন্তু হতাশা বলে কথা !!! সে তো আর আমাকে ছাড়তে চাচ্ছেনা ।

যাই হোক এর মাঝে আইএলটিএস পরিক্ষা দিয়ে দিলাম। রেজাল্ট যতটা আশা করেছিলাম তা কিন্তু হয় নাই। তাও আশা ছাড়ি নাই কারন অবশ্য আমার একাডেমিক রেজাল্ট আর মনের সাহস। কারন এইটুকু সাহস ছিল এম্বাসিতে যেই প্রশ্নই করা হোক না কেন আমি উত্তর দিতে পারব। আগেই একটু ধারনা ছিল যে ভার্সিটিতে এ্যডমিশন পেলে এম্বাসিতে নিজেকে শো করতে পারলেই পাঙ্খা 😛

২০১৬ সালের শুরুতেই ভাবলাম যেহেতু ব্যাংক একাউন্ট খোলাই লাগবে সো আগেভাগেই কিছু কাজ করে ফেলি। কিন্তু বিধিবাম এখানেও!!! যেইদিন এম্বাসিতে গেলাম কিছুক্ষন বসে থেকে যখন কাউন্টারে গেলাম ভদ্রলোক বলে দিল ওনার সামনে নাকি ফরমে সাইন করা লাগবে। আমিতো আগেই সাইন করে বসে ছিলাম। 😛 যাইহোক সময় না থাকাতে আর ওইদিন একাউন্ট খোলার ফরমে এম্বাসির সিল লাগানো হলোনা। পরে আরেকদিন গিয়ে সব কিছু ঠিক করে এসেছিলাম।
এবার পুরোদমে DAAD এ ভার্সিটি খুঁজা শুরু করলাম। যতগুলি ফ্রি পেলাম সবগুলিতে এপ্লাই করেছিলাম। সাবজেক্ট ১০০% মিলুক আর না মিলুক। ফ্রি বলে কথা 😛 । প্রায় ১৪ , ১৫ টা ভার্সিটি সিলেক্ট করে ফেলেছিলাম এক মাসের মাঝেই। যার মধ্যে দুইটায় শুধু টাকা দিয়ে এপ্লাই করেছিলাম। বাকি গুলি ছিল ফ্রি। এর মাঝে আমার ভার্সিটির এক বড় ভাই জার্মানি থেকে বাংলাদেশে আসে। আমার সে বন্ধু বললো সব কাগজ পত্র ওই ভাইয়ের কাছে দিয়ে দেওয়ার জন্য যাতে ভার্সিটিগুলির ডকুমেন্টস ও জার্মানি থেকে কম খরচে পাঠাতে পারে। সব কাগজপত্র ভার্সিটির রিকুয়ারমেন্টস অনুযায়ী গুছিয়ে পাঠিয়ে দিলাম । সাথে কিছু ইউরো করে দিলাম যাতে ইউনি এসিস্ট এর দুইটা ভার্সিটিতে আমার বন্ধু পে করে দিতে পারে। বাংলাদেশ থেকে টাকা ইউনি এসিস্টে পে করাটা ভেজাল মনে করায় এই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছিল।

ভার্সিটিতে এপ্লাই শেষ করে এখন শুধু অপেক্ষার পালা। দিনের মাঝে ৪০ থেকে ৫০ বার ইমেইল চেক করি , এই বুঝি ভার্সিটির মেইল আসল !!! মাস চলে যায় ইমেইল আর আসেনা। একদিন বিকালে ১ম ইমেইল আসে । অনেক আশা নিয়ে খুলে দেখি – রিজেক্টেড ইমেল  আহা আবার হতাশা। মেইল চেক করেই যাচ্ছি বাট গুড নিউজ আর আসেনা। তারপর আবার ইমেইল আসল । এইবার একটা ভার্সিটি থেকে কনফার্মেশন করল এডমিশনের। মনে এইবার একটু আশা জাগলো। যাক একটা থেকে তো কনফার্মেশন ফেলাম। তার কিছুদিনের মাঝেই আরেকটা ভার্সিটি থেকে কনফার্মেশন পেলাম। দুইটাতে এডমিশন পেয়ে এইবার কিছুটা টেনশনে পড়ে গেলাম ।কোনটার জন্য এম্বাসি ফেইস করবো !!! শেষে বন্ধুদের সাথে কথা বলে একটা ডিসিশনে আসলাম।

এবার টাকা পাঠানোর পালা। আইএফআইসি ব্যাংকে আমার পরিচিত অফিসার ছিল ওনাকে কল দিলাম।উনি পরের দিন যেতে বললো ।পরের দিন টাকা নিয়ে চলে গেলাম ব্যাংকে। সাথে করে ভার্সিটি এর অফার লেটার, পাসপোর্ট আর ব্যাংকে কত টাকা পাঠাতে হবে সেটা প্রিন্ট করে নিয়ে গেলাম। একদিনেই সব কাজ শেষ করে বাসায় আসলাম। পরের দিন ব্যাংক থেকে ইমেইল দিল টাকা রিসিভের। ব্যাংকের কাজটা এতো অল্প সময়ে সম্ভব হয়েছিল আমার পরিচিত সেই লোকের জন্য। আমার সাথের অনেকেরই ব্যাংকে গিয়ে প্যাঁড়া খেতে হয়েছিল।

এর মাঝেই এম্বাসিতে ইন্টারভিউ ডেইট নিলাম। ডেট নেওয়ার আগে থেকেই শুনলাম এম্বাসি আর ডয়েস ব্যাংকের মাঝে ঝামেলা হচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম অভাগা যেদিকে যায় সাগরও শুকিয়ে যায়  ডেইট নিয়ে ফেললাম কারন মনে মনে ভাবলাম এম্বাসি আর ব্যাংকের প্রবলেম সমাধান হবেই ।
নির্ধারিত দিনে ফরমাল ভাবে এম্বাসিতে গেলাম। সব কাগজপত্র তিন কপি করে ফটোকপি করে নিয়েছিলাম সাথে যদিও দুই কপি করে লাগে। ২০ মিনিট পরে আমার ডাক পড়লো ৩ নাম্বার কাউন্টারে। এই সেই ৩ নাম্বার কাউন্টার যেখানে কেউ একবার ঢুকলে ২০ মিনিটের আগে বাহির হতে পারেনা। মনে মনে দোয়া করেছিলাম যাতে ৩ নাম্বার কাউন্টারে না পড়ে। বাট আবারো সেই পোড়া কপাল !!! ভিতরে ঢুকা মাত্র ভিসা অফিসারের হাসি মাখা মুখ কিছুটা সাহস দিলেও এক মিনিট পরেই বুঝতে পারলাম আমি যে প্রশ্নবানে জর্জরিত হতে যাচ্ছি। মনে থাকা প্রশ্নগুলি নিচে দিলাম বাংলায় ঃ
১. আপনি বাহারুল আলম ?
২. কি কি কাগজপত্র আছে আপনার? ( যা যা জমা দিলাম তার বিবরন দিলাম )
৩. কি করেন এখন?
৪. আপনি IT এর ছাত্র কিন্তু কাজ করছেন প্রোগ্রামিং এ ? কেন?
৫. কোন প্রোগ্রামিং নিয়ে কাজ করেন? শিখলেন কিভাবে? কতদিন লেগেছিল?
৬. এখন কি নিয়ে কাজ করছেন?
৭. আচ্ছা PHP and HTML টা একটু বুঝিয়ে বলেন আমাকে।
৮. IT কি? ইন্টারনেট কি ?
এবার উনি আমার BSc এর সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে কোর্সের নাম দেখে দেখে প্রশ্ন করা শুরু করলো ।
৯. মাক্রোওয়েভ কি ?
১০. ইলেক্ট্রনিক এবং ইলেক্ট্রিকাল এর মধ্যে পার্থক্য কি ?
১১. ডিজিটাল কমিনিকেশন কি ?
১২. ডিজিটাল সিগন্যাল আর এনালগ সিগন্যাল কি?
১৩. নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি কিভাবে কাজ করে ? বাংলাদেশে নেটওয়ার্ক সিকিউরিটি কেমন ?? এইটার উত্তর টা আমি নেগেটিভ দেওয়ার পরে উনি বলেন আশা করি তুমি এইটার উপর পড়ালেখা করবা। পুরা বিশ্বে সিকিউরিটি একটা বড় প্রবলেম । আমি হেসে বললাম ওকে স্যার।
১৪. তোমি জার্মানিতে যেই ভারসিটিতে যাচ্ছে তার নাম কি?? এইটায় কেন যাচ্ছ?
১৫. আর কোন কোন ভার্সিটি থেকে অফার লেটার পেয়েছ ?? বলার পর বলল বাকি গুলি আছে সাথে। আমি হা বলার পর দেখলো ।
১৬. তুমি বাকি দুইটায় যেতে চাচ্ছ না কেন? ওইগুলি তো অনেক ভাল ভার্সিটি? বললাম ।
১৭. কত ক্রেডিট ? কয় বছর লাগবে?
১৮. কত মডিউল ? এইটার উত্তর আমি দিতে পারি নাই।
১৯. ১ম ইয়ারে কি কি কোর্স করা লাগবে? সবগুলির নাম বললাম।
আরো কিছু প্রশ্ন ছিল বাট মনে নাই ।
বাহির হওয়ার সময় ভিসা অফিসার একটা মানি রিসিট ধরাইয়া দিয়া বললো ফি টা জমা দিয়ে রিসিট টা দিয়ে যেতে আর ব্যাংকে আরো ৬০০ ইউরো জমা দিয়ে দিতে। বাসায় এসে পরেরদিন আবার বযাংকে গিয়ে টাকা জমা দিলাম।

বাসায় এসে আবার চিন্তা শুরু করে দিলাম ব্যাংক যে কবে আবার এই ৬০০ ইউরো এর কনফার্মেশন দিবে। যাক শেষমেষ ১২ দিন পরে ব্যাংক থেকে কনফার্মেশন পেলাম । পরের দিন গিয়ে এম্বাসিতে ব্যাংক কনফার্মেশন, ব্যাংকের রিসিট , আর পাসপোর্ট এর ফটোকপি একটা খামের ভিতর করে ফ্রন্ট ডেস্কে জমা দিয়ে চলে আসলাম।
সব শেষ করে এবার শুরু হলো ভিসার চিন্তা। কবে কল আসবে সেই চিন্তা শুরু হলো। তার মাঝে পরিচিত এক আপু ছিল তিনি পাচ দিনের মাঝে রিজেক্ট হয়েছিল। ৭ দিন পার হওয়ার পর কিছুটা চিন্তা দূর হলো। কারন শুনেছিলাম রিজেক্ট করলে নাকি সাত দিনের মধ্যে করে দেয়। একদিন বিকালে আসলো সেই দিন। এক কোকিল কন্ঠি কল দিয়ে বললো পরেরদিন দুপুর দুইটায় পাসপোর্ট কালেক্ট করার জন্য। সাথে মেইল এর কনফার্মেশন এর জন্য ইমেইল এর পাসওয়ার্ড নিয়ে যেতে। আমি কিছু বলার আগের উনি কল কেটে দিল। সারারাত চিন্তায় ঘুম আসলো না। মাঝরাতে ঊঠে কয়েক রাকাত নামাজ পড়ে ফজরের নামাজ পড়ে শুয়ে ছিলাম কিছুক্ষন । কিন্তু ঘুম আর হলো না। সময় যেন শেষ হচ্ছেনা। ১২ টার দিকে বাসা থেকে বাহির হয়ে ১ টায় বান্দা হাজির এম্বাসিতে। ২টায় ভিতরে ডুকলাম। তারপর সেই তিন নাম্বার কাউন্টারে ডাক পড়লো। ভিতরে ডুকে সেই ভিসা অফিসারকে দেখে হাসি দিলাম। উনি আমাকে চিনতে পারলো। বললো আপনি আমার কাউনটারে ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন? আমি বললাম জী স্যার। তারপর মেইল চেক করে শিউর হলো ব্যাংকের কনফার্মেশনটা। উনি হাসি দিয়ে বললো পরের দিন এসে পাসপোর্ট কালেক্ট করার জন্য। আমি সাহস নিয়ে জিজ্ঞাস করলাম স্যার ইজ ইট অ্যা পজিটিভ রেজাল্ট অর নেগেটিভ। তিনি হাসি দিয়ে বললো অভিয়াসলি পজিটিভ। আমি ধন্যবাদ দিয়ে কাউন্টার ত্যাগ করলাম। পরের দিন দুপুরে গিয়ে উনার থেকে পাসপোর্ট কালেক্ট করলাম কিন্তু বললাম না অভাগা যেদিকে যায় সাগর শুকিয়ে যায় । রুম থেকে বাহির হয়ে যখন খুশিতে পাসপোর্ট এর দিকে তাকালাম দেখলাম পাসপোর্টে নিজের নামের বানান ভুল । সাথেসাথে কাউন্টারে গিয়ে বললাম। উনি চেক করে বললো পাসপোর্ট রেখে যান ।দুইদিন পরে কল দিয়ে আসবেন। ভিসা পেয়েও শেষ কয়দিন আরো টেনশনে ছিলাম। বুঝেনই তো পাসপোর্ট হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না । তিনদিন পরে কল দিলাম। পরের দিন যেতে বললো । পরের দিন গিয়ে পাসপোর্ট কালেক্ট করলাম। যারা ভিসা পাচ্ছেন দয়া করে খুশি হওয়ার আগে নিজের নাম আর জন্ম তারিখ পরখ করে নিন তারপর লাফ দিবেন। ইন্টারভিউ দেওয়ার পর ভিসা পেতে আমার সময় লেগেছিল ২৮ দিন ।
শুরু থেকে ভিসা পাওয়া পর্যন্ত এই ছিল আমার টেনশনের গল্প। আমার মনে হয় বাসার সব আরাম ছেড়ে আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন বাস্তবের মুখামুখি হতে যাচ্ছি। দোয়া করবেন সবাই।
বিসাগ নিয়ে কিছু লিখার নাই। ধন্যবাদ দিয়ে আপু আর ভাইয়াদেরকে ছোট করতে চাইনা। ট্রাই করবো উনাদের মত ডেডিকেটেড হয়ে সাহায্য করার জন্য। তবে এটা ঠিক গ্রুপে সব কিছুরই উত্তর দেওয়া আছে । একটু খুজলেই সব কিছুর উত্তর পাওয়া যায়। তাই একটু চোখ খোলা রাখুন 🙂 ভালো থাকুন সবাই।

mm

By Baharul Alam Beelton

অতীত : Electronics and Telecommunication Engineering , East West University. বর্তমান : Information Technology , Frankfurt University of Applied Sciences. ভবিষ্যৎ : অজানা :)

Leave a Reply