সুন্দরবনের পাশে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিলের দাবিতে সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে জার্মানির বার্লিন শহরে জার্মান প্রবাসে এবং বাংলিশে কালচার ফোরাম এর উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। সমাবেশে বক্তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের বিরোধিতা করেন। এ ধরনের প্রকল্পের ফলে সুন্দরবনের আশপাশের প্রাণ-প্রকৃতি কিভাবে হুমকির মুখে পড়বে, তা যুক্তিসহ তুলে ধরেন প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীরা। এছাড়া কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রচারণা চালাতে ও জনমত তৈরিতে জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পোস্টারিং ও লিফলেট বিতরণ করা হয়। জার্মানির পরিবেশ বিষয়ক অর্গানাইজেশন উমভেল্ট বাউন্ডস, জার্মান ফেডারেল এজেন্সি এবং জার্মান সংবাদ মাধ্যমে এ বিষয়ে অবগত করা হয়। জার্মান প্রবাসীরা বাংলা, ইংলিশ ও জার্মান ভাষায় ‘আমার জীবন সুন্দরবন, কয়লা হতে দেব না’ ,‘Yes to Life, No to Coal, Save Sundarban’ স্লোগানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। এছাড়াও স্লোগানটি সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইংরেজি ছাড়াও জার্মান , ফ্রেঞ্চ , ইটালিয়ান, স্পানিশ, পর্তুগীজ, চাইনিজ, টার্কিশ, হিন্দি, কোরিয়ান, বসনিয়ানসহ প্রায় ২৫ টির মত ভাষায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রবাসী বাংলাদেশীদের প্রতিবাদ কর্মসুচিতে ব্যানার ও প্লাকার্ড এ শোভা পায়। প্রচন্ড বৈরি আবহাওয়ায় , তীব্র ঠাণ্ডা ও তুষার পাত উপেক্ষা করে বার্লিনে এই প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ পালিত হয়।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো যখন সম্মিলিত ভাবে কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ও ক্লিন এনার্জি নিয়ে নানারকম পদক্ষেপ নিচ্ছে সেখানে বাংলাদেশের কার্বন বা কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এর মত আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের ভাবমুর্তিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাই এই আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে সচেতন মানুষ নানারকম প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করছে । এ সময় দেশে তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলনে সংহতি জানান বক্তারা।
প্রথম বারের মত বিশ্বনেতারা ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে (ডিসেম্বর, ২০১৫) চুক্তি সাক্ষর করে যে তারা বিশ্ব তাপমাত্রা কমাতে কার্বন নিঃসরণ কমাবে । সেই লক্ষে তারা জীবাশ্ম জালানী যেমন ঃ তেল, কয়লা যুগ এর অবসান এর মাধ্যমে ক্লিন এনার্জি বা পরিবেশ বান্ধব টেকসই উন্নয়নে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদন কারি দেশগুলোও চুক্তিতে সাক্ষর করে।বাংলাদেশ সেই জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে এবং বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৫০ টি দেশের নেতারা সেই চুক্তিতে সাক্ষর করে। সেখানে বাংলাদেশের কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উতপাদন ফ্রান্সের এই ঐতিহাসিক জলবায়ু সম্মেলনে চুক্তির বিপক্ষে।কেননা কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাতাসে কার্বন নিঃসরণ বাড়াবে যেটা সরাসরি গ্রিন হাউজ এফেক্ট এর জন্য দায়ী এবং সেটা পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বৃদ্ধির ধনাত্মক নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। ফলে বাংলাদেশের খুব কাছেই হিমালয় এর বরফ গলা পানি বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নিচু অংশগুলোকে বন্যা ও লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতার ঝুঁকিতে পড়বে ।
জলবায়ু চুক্তির শর্ত অনুযায়ী উন্নত দেশ গুলো উন্নয়নশীল দেশকে রিনিউয়েবল এনার্জি যেমন সোলার বিদ্যুৎ,পানিবিদ্যুৎ, উইন্ডমিল ইত্যাদি থেকে ক্লিন এনার্জি উৎপাদনে ১০০ বিলিয়ন ডলার সহায়তার চুক্তি করে, এছাড়া ক্লিন এনার্জি উৎপাদনের বিনিয়গে ২৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এর কথা বলে কিন্তু ইতিমধ্যে জাতিসংঘের সবুজ জলবায়ু তহবিলের (জিসিএফ) নীতিনির্ধারণী ফোরাম বা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যে পরিষদ, সেই পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ হারিয়েছে বাংলাদেশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম সবার ওপরে, আর জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলো—বিশ্বে ক্রমেই যখন এ দাবি প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে, ঠিক তখন বাংলাদেশ জাতিসংঘের সবুজ জলবায়ু তহবিলের (জিসিএফ) নীতিনির্ধারণী ফোরাম বা সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে যে পরিষদ, সেই পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদ হারায়।যেটা পরবর্তিতে বিশ্বব্যাপী যে সাড়ে ছয় মিলিয়ন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে সেখানে বাংলাদেশিদের প্রবেশ বাধাগ্রস্থ করবে।
সুন্দরবন এর কয়লা বিদ্যুৎ এর নেতিবাচক দিক নিয়ে জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা পত্রের রিপোর্টঃ
ছবিটি সুন্দরবনের ২০০০-১০ সালের ট্রি কভার পরিবর্তনের ছবি, যেখানে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের দিকের সুন্দরবনের অবস্থা ভারতের চেয়ে অনেক বেশি খারাপ। বিশেষ করে ব্লক ০২, ১০, ১২, ১৫ এবং ৩৫ এ অবস্থা শোচনীয়। এই ব্লকগুলোর পাশ দিয়েই শেলা এবং পশুর নদী বহমান, যেখান দিয়ে তেল, কয়লা বা অন্যান্য আমদানিকৃত জিনিসবাহী কার্গো শিপ চলাচল করে। চলার সময় এই শিপগুলো থেকে ক্রমাগত তেল দূষিত পানি বের হতে থাকে। এই অল্প পরিমাণ তেলই ম্যানগ্রোভের কাদায় জমা হয় এবং পরে আস্তে আস্তে নদীর জোয়ার ভাটার মাধ্যমে জঙ্গলের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তেল দূষণ বাদেও আমরা আরও কিছু প্রাকৃতিক (স্যালাইনিটি, সাইক্লোন) এবং মানবসৃষ্ট কারণ (তেল দূষণ, আগুন) যেগুলো এই ক্ষতির জন্য দায়ী।রামপাল প্রকল্পের জন্য বছরে ৪০০-৫০০ ট্রিপ দিতে হবে জাহাজগুলোর। দূর্ঘটনা বাদেই এসব জাহাজ থেকে ক্রমাগত যে তেল, দুষিত পানি পড়তে থাকে তাতেই সুন্দরবন অনেক বেশী ঝূকির মধ্যে পড়বে।এছাড়া শব্দদূষণ তো থাকবেই, (আসিফ ইশতিয়াক, ২০১৬)
বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রত্যাশা এই আত্মঘাটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প দেশের জনগনের আর বড় ধরনের ক্ষতির আগে বাতিল করে দেশে সম্ভাবনাময় ক্লিন এনার্জি ও পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুৎ প্রকল্প সেই সাথে টেকসই উন্নয়ন নিয়ে যুগোপযুগি ও মানব কল্যাণ কর পদক্ষেপ নেওয়া ।
সুত্রঃ
১। বিজ্ঞান গবেষনাপ্ত্র ২০১৬
Asif Ishtiaque, PhD student in School of Geographical Sciences and Urban Planning, Arizona State University, USA
Examining the ecosystem health and sustainability of the world’s largest mangrove forest using multi-temporal MODIS, Science of the Total Environment, 569–570 (2016) 1241–1254
https://www.researchgate.net/publication/304815340_Examining_the_ecosystem_health_and_sustainability_of_the_world%27s_largest_mangrove_forest_using_multi-temporal_MODIS_products)
২। COP21 (n.d.) United Nations conference on climate change. Learn act follow. Available at: http://www.cop21.gouv.fr/en/
৩। বাংলাদেশের স্থায়ী সদস্য পদ বাতিল করা হয়েছে।
লিংক ঃ http://www.kalerkantho.com/print-edition/…/2016/12/18/442024