সুজনের দেহ উড়াল দিয়েছে। বাংলার মাটি সেই দেহ স্পর্শ করবে ৯ তারিখ ভোরে।
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে / যাব আমি চলে।’ মহানেরা মৃত্যুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবার বিলাসিতা হামেশা করে থাকেন। ঠাট্টা বিদ্রূপও চলে। কিন্তু আমরা যারা অভাজন তাদের কি সেই সাহস আছে! আমার অন্তত নেই। মৃত্যুকে অমোঘ জেনেও আমি তাকে এত ঘৃণা করি যে তার হতে অধিক ঘৃণা আর কোন কিছুকে নয়।
আমাদের সুজনের মৃত্যু চিন্তা সম্পর্কে জানবার অবসর আমার হয়নি। তাকে জানবারই সুযোগ ঘটেনি আমার, মৃত্যু চিন্তা সে তো দূরাহত। এমন বিবর্ণ ভাগ্যের কোন মানুষ আমি এ জীবনে দেখিনি। যে বয়সে সুজনের বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকার কথা, রাজনীতি অর্থনীতি ধর্মচিন্তা নিয়ে বন্ধু মহলে তুখোড় আলোচনা করার কথা, নাটক সিনেমা আর শিল্পের মধ্য দিয়ে ভেতরটা আলোকিত করার কথা, প্রেম করার কথা, সেই বয়সে সীমাহীন ভাগ্যবিড়ম্বিত এই যুবার সময় কেটেছে হাসতাপাতাল থেকে হাসতাপাতালে কর্টক রোগের সাথে যুদ্ধ করে। সে যুদ্ধে ভাগ্য জিতেছে, হেরে গেছে বহু স্বপ্ন আর সাধ।
আমরা যারা বিদেশে আসি কম বেশি সবার এক স্বপ্ন। লেখাপড়া শেষ করে প্রতিষ্ঠা প্রাপ্তি আর বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটানো। জানিনা পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ আর সুখের বাহার এনে দিলেও সেই মায়ের সেই বাবার মুখে এই জীবনে আর হাসি দেখা যাবে কিনা। এমনভাবে মানুষের স্বপ্ন আর সাধ ধূলিস্মাৎ হতে আমার বিগত জীবনে দেখিনি।
পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ পরিপুর্ণরুপে উপভোগের আগেই সুজনকে বিদায় নিতে হয়েছে। দীর্ঘ জীবনপ্রাপ্তি যদি সৃষ্টিকর্তার করুণা হয় তবে সুজনের প্রতি সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপা সুপ্রসন্ন ছিলনা। সাতশো কোটি মানুষের এই পৃথিবীতে আমাদের সুজনকে বিদায় নিতে হয়েছে একাকী। শেষ বিদায়ের অন্ধকার সময়ে একটিবার কপালে হাত রাখার মানুষটি ছিলনা তার পাশে। ভাবতেই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে যায়। তারাশংকরের কবি উপন্যাসের কবিয়ালের মত আফসোস করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘হায়! জীবন এত ছোট কেনে’!
ভাগ্যের দেবী তার প্রতি দু’হাত প্রসন্ন না করলেও হাজার হাজার সুজনের ভালোবাসা নিয়ে সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। এ কম প্রাপ্তি নয়। অজানা অচেনা এক সুজনের জন্য হাজার মাইল দূর হতে মানুষ কাঁদে কেন! কেন সবার মাঝে এই হাহাকার ছড়িয়ে পড়লো, কেন উদার হস্তে মানুষ হাজির হল বুকভরা ভালবাসা নিয়ে! আমি জানি পৃথিবীতে আট হাজার ভাষার কোন ভাষাতেই এই অপরিসীম অকৃত্রিম ভালবাসার কোন তুলনা খুঁজে পাওয়া যাবে না। জগতশ্রেষ্ঠ্য মহাকাব্যিক রচনা দিয়েও এর ব্যাখ্যা অসম্ভব।
কবিগুরু বলেন, ‘যে ক্ষতি পূরণ হইবে না, যে বিচ্ছেদের প্রতিকার নাই, তাহাকে ভুলিবার শক্তি প্রাণশক্তির একটি প্রধান অঙ্গ, শিশুকালে সেই প্রাণশক্তি নবীন ও প্রবল থাকে’। অধিক বয়সে আপন স্বজন হারানোর কষ্ট মানুষ বয়ে বেড়ায় আজীবন। আর সুজনের মা তো সুজনের গর্ভধারিণী। মায়ের মৃত্যুও পারবেনা এই শোক মুছতে। একদিনের মাঝে সুজন ফিরে যাবে মায়ের বুকে। জীবিত থাকলে মায়ের বুকে সে ঝাঁপ দিয়ে পড়তো দশ হাত দূর হতে। সুজন আজ নিশ্চল, ঝাঁপ দেয়ার ক্ষমতা তার নেই, জনমদুঃখিনী সেই মা একাই ঝাঁপ দিয়ে পড়বে সন্তানের নিথর দেহের উপর। সেই দৃশ্য আমরা দেখব ছল ছল চোখে। আহারে আহারে! জীবন এত ছোট কেনে!
[…] ‘হায়! জীবন এত ছোট কেনে’ […]
[…] ‘হায়! জীবন এত ছোট কেনে’ […]
[…] ‘হায়! জীবন এত ছোট কেনে’ […]
[…] ভেবেছিলাম এই এক বছরের মাথায় সুজনের মাকে একবার ফোন দিব। বুকের পাঁজরে অসুন্দরের বজ্রাঘাত ঠেকিয়ে সে কি আজও সুজনের আশায় পথ চেয়ে বসে থাকে? বড়ই জানতে ইচ্ছে করে। বিপন্ন–উদ্বাস্তূ মানুষেরও আশা থাকে, এই মায়ের কী আছে? হায় জীবন এত ছোট কেনে! […]
সেই মনে পড়ে
সুজন আর আমি একি সাথে বাংলাদেশে গ্যেটে ইন: লেখাপড়া করেছিলাম ও ভর্তির দিন আমার সামনে দাঁড়ানো ছিল, কি যেন বলতে চাইছে। আমি বললাম কিছু বলবেন? স্বহাস্যে বলে উঠলো হ্যা জি জি, কিছু বলতে চাইছি। বলেন, উনি বললেন আমার নাম সুজন আমি ও আজ ভর্তি হ্যলাম। আমি আপনার সাথে ক্লাশ, পড়াশুনা করতে চাই। বললাম ঠিক আছে। এভাবে অনেক বন্ধু সম্পর্ক হয়ে উঠে। পরে ও আমার সাথে ভালো রেজাল্ট করে ষ্টডেন্ট ভিসায় চলে আসে।আমি আসি ফ্যামিলি ভিসায়। আমি জার্মানিতে আসতে না আসতেই ও শুনি অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমার সাথে আর দেখা হয়নি এর আগেই মৃত্যু তাকে ছিনিয়ে নেয়।
সুজন এতো ভালো ও মেধাবী ছেলে যা ওকে পাশ থেকে দেখেছি কতটা দিন। ওকে কোনদিন ভুলতে পারিনি।
জাহিদুল জামি
বার্লিন,জার্মানী।
১২.৩.২০