গত কয়েকদিন কিভাবে কেটেছে অনেকগুলো মানুষের তা বলে বোঝানো মুশকিল। আর একবার মানুষের ওপর আস্থা অনেক অনেকগুণ বেড়ে গেল আমাদের। মানুষের মন এখনো কত বড় তা আমরা জেনেছি ক্ষণে ক্ষণে। বাংলাদেশের এক ছাত্র সুজন চন্দ্র সরকার গতবছর এসেছিল জার্মানিতে। আজ সে কোথায়? সহপাঠীদের কাছে বলে গিয়েছিল “ভাই আমিতো কোনোদিন মদ-বিড়ি-গাঁজা ধরিনি তবে আমার এমন কে হলো?” এই কথা আমি নিজের কানে শুনিনি কিন্তু কারো কাছে শুনে আমার মনে বারবারই এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে এসেছে। সাথে আরো অনেক নানান গল্প ও তথ্য কানে আসতে থাকে। এক মৃত্যুপথযার্ত্রী তার শেষ সময় গুনছে…তার পরিবারের শেষ আশা, শেষ ভরসা। বারবার আমাদের সকলকে বিষয়টি কাঁদিয়েছে, কত ফোন কল এসেছে এই প্রতিশ্রুতি নিয়ে- “আপু আমার কাছে …এত টাকা আছে, আমি কালকে কাজ করলে আবার টাকা চলে আসবে কিন্তু সুজন যাক তার ঘরে ফিরে”।

প্রবাস জীবন অনেক একাকিত্বের মাঝে কাটে তবু এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে মানুষের মাঝে যে মানবিকতার জাগরণ ঘটেছে আমাদের তা অকল্পনীয়। এই সুজন পরলোকে গিয়েও অনেকগুলো মানুষকে আপন করে গিয়েছে তার প্রবাস জীবনের একাকিত্ব দিয়ে। আমাদের প্রত্যেকের মনে ছিল একটি কথা “আজ সুজনের জায়গায় আমি হতে পারতাম”। হয়ত একথা ভেবেই প্রতিটি মানুষ তার সক্ষমতা, সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য এবং সহযোগিতা করেছে নিঃস্বার্থভাবে। কেবলমাত্র বাংলাদেশি ছাত্র এই পরিচয় থেকেই কারো ভাই, কারো বন্ধু হয়ে গেছে গত কয়েকদিনে। বাংলাদেশি অ্যালামনাই এগিয়ে এসেছেন সুজনের দেহ দেশে পাঠানোর জন্যে বিনা বাক্যব্যয়ে। সবার কথা একটাই- “একজন বাংলাদেশি কেন টাকার জন্যে দেশে যেতে পারবে না?” সবাই গিয়েছেন সবার দ্বারে সাহায্যের আশায়, কেউবা হাতে তুলে দিয়েছেন সারাদিনের পরিশ্রমের অর্জিত অর্থ। মানুষের বিশ্বাসের বড় এক দায়ভার এসেছে আমাদের কাছে। সুজনের জন্যে আমাদের কারো দ্বারে কড়া নেড়ে খালি হাতে ফিরতে হয়নি তা সে ছাত্র, কর্মী হোক কিংবা দেশের প্রতিনিধিত্বকারী যেই হন। মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে না দেবার এই প্রয়াস আমাদের মুগ্ধ করেছে, অবাক করেছে। একজন শিক্ষাথী, মাহীন, মন্ত্রী মহোদয় জনাব শাহরিয়ার আলমকে অনুরোধ করেন বিষয়টি দেখবার জন্যে। সোমবার সকালে মাহিনের কাছে বাংলাদেশ দূতাবাস বার্লিন থেকে কল আসে। নানান তথ্য জানতে চাওয়া হয় ফলশ্রুতিতে আমার কাঁধে দায়িত্ব আসে কথাগুলো জানাবার। দূতাবাস থেকে জানানো হয় মন্ত্রী মহোদয় বিশেষভাবে বলেছেন যেন জরুরি ভিত্তিতে সুজনের ব্যাপারটিতে সহযোগিতা করা হয়। এই ক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো- জার্মানিতে অফিসিয়াল ফর্মালিটি অনেক জটিল এবং যাদের জানা নেই তাদের জন্যে ভয়ঙ্কর একটি বিষয়। পেপার ওয়ার্ক এবং নানান অফিস ঘুরে ফাইল চালান করা। দূতাবাসের সাহায্য এবং সহযোগিতা ছাড়া কয়েকঘন্টার মাঝে আমরা এমন জটিল কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারতাম না। দূতাবাস একটি দেশের মানুষের প্রবাসে আস্থা এবং ভরসা, প্রবাসী মানুষের পরিচয়ের বাহক। আমরা জার্মানিতে বাংলাদেশি দূতাবাসের কাছে একান্তভাবে কৃতজ্ঞ। সেই সাথে সত্যিকার অর্থে আমি গর্বিত যে এমন তরুণ একজন মন্ত্রী আছেন যিনি প্রবাসীদের নিয়ে ভাবছেন এবং সহযোগিতা করছেন। একজন নেতা যখন একটি দেশের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন তখন তার অঙ্গীকার কোনো দলের বা গোত্রের থাকে না, অঙ্গীকার থাকে দেশের মানুষের কাছে। আমাদের এই বিষয়টি নিয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে এতটুকু বলতে পারি, তিনি ঠিক সেই কাজটিই করেছেন। সুজন কোন দলের, কোন গোত্রের এমন কোনো কিছু না চিন্তা করে প্রবাসী বাংলাদেশি ছাত্র হিসেবে বিষয়টি দেখেছেন। আমাদের তরফ থেকে রইলো অনেক শুভকামনা যাতে এই চিন্তা-ভাবনা বাকিদের মাঝেও ছড়িয়ে যায় দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে। একটি মৃত্যু মানুষকে কতটা কাছে এনে দেয় তা আমরা এই ঘটনাটি না ঘটলে বুঝতে পারতাম না। গত কয়েকটা দিন কত নাম না জানা মানুষের সাথে নতুন করে পরিচয় হলো কেবলমাত্র সুজনকে কেন্দ্র করে। এত মানুষ আমাদের বিশ্বাস করে সুজনের জন্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে! এত বিশ্বাস, এত বড় দ্বায়িত্ব কাঁধে তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবার জন্যে। প্রবাসে আমরা কেউ একা নই যতদিন সবাই একে অপরের বিপদে আপদে এগিয়ে আসবেন বিনা বাক্যব্যয়ে আজকের দিনের মত। আমি এতকথা বলার পেছনে একটাই উদ্যেশ্য, আপনারা মানুষ হিসেবে যে পরিচয় আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন তার জন্যে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানানো।

একজন মানুষের গুরুত্বপূর্ণ অবদানঃ আমাদের সবথেকে বড় বিপদে সহায় হয়েছেন জার্মানিতে বসবাসরত বাংলাদেশি অ্যালামনাই CLS কম্পিউটার নামক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, দেওয়ান সফিকুল ইসলাম ভাই। আমরা সবাই যখন অস্থির হয়ে নানান দিকে খোঁজ নিচ্ছি কিভাবে দেশে মৃতদেহ পাঠানো যায়, কতইবা তার খরচ? এমন সময় না ছিল আমাদের হাতে কোনো টাকা, না ছিল কোনো যথেষ্ট তথ্য। এমনি এক সময় আমাদের পোস্টটি দেখে আসিফ ইকবাল ভুইয়া  ভাই এ বিষয়টি তা সফিকুল ভাইকে কে জানাবার সাথে সাথে সম্পূর্ণ দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। কথা ছিল একটাই, টাকা হাতে পেলে দিও-না পেলে দিতে হবে না, আমি দায়ভার গ্রহণ করলাম। এমন মানুষের সন্ধান না পেলে আমরা কিভাবে এতটা পথ পাড়ি দিতাম আমরা ভাবতেই পারিনা। এমন মানুষও আমাদের মাঝে আছে জেনে আমরা গর্বিত। সবকথার শেষে আমাদের আপনজন, এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট ইউসুফ ভাইকে মনে না করলে কথা শেষ হয় না। ঘটনার শুরু থেকে শেষ অব্দি বহুপ্রশ্ন করতে হয়েছে আমাদের এবং ভাইয়া চিরাচিরিত নিয়মেই সবকিছুতে সাহায্য করেছেন। সেইসাথে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক যেভাবে এয়ারপোর্টে সাহায্য করেছেন খুব দ্রুত সবকিছু হয়ে যাবার জন্যে যার জন্যে আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

আমাদের আন্তরিক ধন্যবাদ আপনাদের কাছে যারা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছেন নানান দেশ থেকে। জাতি-ধর্ম-গোত্র এমন কোনো প্রশ্ন কেউ করেননি যেটি আমাদের মনুষ্যত্বকে প্রমাণ করে দিয়েছে। মানুষ মানুষের জন্যে আর মানুষের পরিচয় এবং আত্মীয়তা কেবলই নিজের কাজের মধ্য দিয়ে। আমি গর্বিত গত কয়েকদিনে ছাত্রসমাজের একাত্বতা দেখে, তাদের ভালবাসার প্রতিশ্রুতি দেখে। এ যেন একই মায়ের কোলের সহদর সবাই আমরা।

সুজনের জন্যে আপনারা
‘হায়! জীবন এত ছোট কেনে’
ভালো থাকো সুজন !!!
জার্মানিতে এক হতভাগ্য তরুণের কথাঃ সুজনের মরদেহ পাঠানোর আপডেট- মঙ্গলবার
mm

By Tanzia Islam

Tanzia Islam is an admin of BSAAG, learn german and Germanprobashe.com this is a volunteer work from her side for the Bangladeshi community. She is also an admin of Free Advice Berlin. Her volunteer activities are related to educational development, city development and environmental protection. Tanzia is a freelance writer and researcher. Currently she is a doctoral researcher at Technical University of Berlin.

2 thoughts on “সুজন এবং আমাদের পথচলা আপনাদের ভরসায়”

Leave a Reply