ইউরোপে পদার্পণের দেড় বছর পার হয়ে গেছে, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করে ফেলেছি। তবে পৃথিবীতে সবথেকে বেশি পর্যটক যায় যেই ফ্রান্সে সেই ফ্রান্সের ছোট কয়েকটি শহরে যাওয়া হলেও রাজধানীতে ভ্রমণ করা হয়নি। কথায় আছেনা ভালো খাবার মানুষ সবসময় শেষের জন্যে রেখে দেয়, তাই আমিও প্যারিস আর বার্লিন বাকি রেখেছিলাম। প্যারিস যদিও একদম হাতের কাছেই, আমার শহর জারব্রুকেন ফ্রান্স সীমান্তের লাগোয়া হওয়ায় আইসিই তে ২ ঘণ্টার কম সময় লাগে, তাই সুযোগ এসেছিল কয়েকবার। এইতো গত ডিসেম্বরেই আমার খুব কাছের মানুষ রেদওয়ান ভাই ইতি আপুকে নিয়ে, আর হাসিব ভাই ভাবিকে নিয়ে প্যারিস ঘুরতে গেলেন। আমাকে অনেকবার করে বলেছেন ওনাদের সঙ্গে যাবার জন্যে তবে পারিপার্শ্বিক অনেক কারণেই সেবারও যাওয়া হয়নি।

কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটা কারণ ছিল জানুয়ারির ২৯ তারিখে রেদওয়ান ভাইরা দেশে যাবেন, ওনাদের ফ্লাইট প্যারিস থেকে, তখন ওনাদেরকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আমারও সঙ্গে যাওয়ার কথা। যদিও আমার প্ল্যান ছিল সকালে ওনাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে সারাদিন প্যারিস ঘুরব, এরপরে সন্ধ্যার ট্রেন ধরে জারব্রুকেন ফিরে আসব। ভেবেছিলাম মেইন প্যারিস ট্রীপ পরে দেওয়া যাবে, আপাতত একটা ওয়ার্মআপ হয়ে যাক। তবে হটাত মনে পরল পলিটেকনিক জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এনাম আগের বছর অনেক চিল্লাফাল্লা করেছে প্যারিস যাওয়ার জন্যে, তো এই সুযোগে ওকে নাহয় জ্বালিয়ে আসি। যেই ভাবা সেই কাজ, একবেলার ট্যুর হয়ে গেল চার রাত/তিন দিনের।

প্রতি ট্যুরের আগেই কম/বেশি গবেষণা করে একটা ট্যুর প্ল্যান করে ফেলি, তবে রেদওয়ান ভাইরা দেশে ফিরে যাচ্ছেন দেখে মন খারাপ থাকায় এবার সেসবে কোন আগ্রহই পাচ্ছিলাম না। ডিসেম্বরে হাসিব ভাইদের জন্যে ট্রাভেল পাস দেখতে গিয়ে পেয়েছিলাম সিটি পাস যেখানে মেইন টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন সবগুলোর এন্ট্রি টিকেট এক সঙ্গে দেয়া, ওনাদের সাজেস্ট করবার আগে তখন ওটা একটু ভালমতো দেখে ছিলাম, তাই প্যারিস সম্পর্কে আমার বিদ্যা ওটুকুনই। তবে যাবার দুইদিন আগে পাঁচ মিনিট ল্যুভর মিউজিয়াম আর পাঁচ মিনিট প্যারিসের টুরিস্ট স্পট গুলো আবারো দেখে নিলাম।

জারব্রুকেনে তোলা শেষ গ্রুপ ছবি
জারব্রুকেনে তোলা শেষ গ্রুপ ছবি

সময়ের কথা মাথায় রেখে আমরা একদিন আগেই শুরু করলাম প্যারিসের অভিমুখে যাত্রা, অর্থাৎ ২৮শে জানুয়ারি, ২০১৭ দুপুর ১টায়। বাসে বসে মনটা বেশ খারাপ, কারণ পরদিন আপু, রেদওয়ান ভাই চলে যাচ্ছেন। যাইহোক সাড়ে ছয় ঘণ্টা যাত্রা শেষে সাড়ে সাতটায় আমরা প্যারিসের পোর্তে মালিয়ট এ পৌঁছলাম। এরপর শুরু হল যুদ্ধ। সঙ্গে রেদওয়ান ভাইদের চারটা লাগেজ, ৩টা হ্যান্ড ব্যাগ। রাস্তা ভালো থাকায় টানতে খুব একটা সমস্যা হচ্ছিল না, তবে প্যারিসের মেট্রো গুলোয় লিফট বা চলন্ত সিঁড়ি নেই, তাই সিঁড়ি দিয়ে লাগেজ ওঠানো/নামানোর যুদ্ধ। আমি অনেকবার বললাম, কিন্তু সম্ভবত লাগেজ ফেলে দিতে পারি ( :p ) এই ভয়েই রেদওয়ান ভাই আমাকে সিঁড়িতে লাগেজ নামাতে/উঠাতে দিলেন না। বেশ টানাহ্যাঁচড়া করে প্রায় দুই ঘণ্টা পর আমরা শার্দু গ্যল এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম। আমাদের যেই হোটেলে রিজার্ভেশন ছিল ওদের শাটল সার্ভিস আছে, ওদের শাটল বাসে চড়েই রাত ১০টা নাগাদ আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে সঙ্গে নেয়া খাবার খেয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে ১টা।

পরদিন ভোরে উঠে সাড়ে ছয়টায় হোটেলের বাইরে, এয়ারপোর্ট পৌঁছতে পৌঁছতে সাতটা। ওনাদের থেকে যখন বিদায় নিলাম তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে আটটা পার হয়ে গেছে। বেশ কষ্ট লাগছিল, তবে অনেক সময়ই আমাদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয়। মনের কষ্ট মনে চেপে যাত্রা শুরু করলাম প্যারিস অভিমুখে। এনাম আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে ওর বাসায় যাবার ট্রেন/মেট্রো কোথায় কোনটা চেঞ্জ করতে হবে তা একদম বিশদভাবে দিয়ে দিয়েছিল, তাই ওর বাসার মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত পৌছাতে কোন সমস্যা হয়নি। সেখান থেকে স্কাউট এর অফলাইন ম্যাপে দেখে একবারে ওর বাসায়।

ওর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল ২০০৬ সালে, ১০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে, পুনর্মিলনের অনুভূতিটা সত্যি অন্যরকম। ওর বাসাটা এক রুমের, সঙ্গে আলাদা মাঝারি সাইজের একটা কিচেন আর টয়লেট। বেশ ছিমছাম, ও একাই থাকে, প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গেল। ও একটা স্পেশাল কেক নিয়ে এসেছিল আর সঙ্গে বিস্কিট দিয়ে দুই বন্ধু সকালের নাস্তা করলাম, সঙ্গে চলতে থাকলো দশ বছরের জমে থাকা গল্প। নাস্তা শেষে গল্পের ফাকেই ও শুরু করল দুপুরের খাবারের আয়োজন। সজ্বী আর ডাল আগেই রান্না করা হয়ে গিয়েছিল তাই ও মুরগি কাটা শুরু করল। রান্নার ক্ষেত্রে আমি যেমন একদমই ধীর গতির, ও আবার আমার উল্টো। মুরগি কাটা শেষ করে বেশ চটপট রান্না গুছিয়ে ফেলল। ওর রান্নার স্টাইল দেখেই বুঝলাম একবছরে রান্নায় বেশ হাত পাকিয়ে ফেলেছে। আমার সঙ্গে ইতি আপুর দেওয়া ফ্রাইড রাইস ছিল, তাই সেটার সঙ্গেই এনামের রান্না করা মুরগি ভুনা দিয়ে দুপুরের খাবার খেলাম। খাবার খাওয়ার সময় বুঝলাম ওর শুধু রান্নার স্টাইলই ভালো না, ওর রান্না করা খাবারের স্বাদও অসম্ভব রকম ভালো।

দশ বছর পর এনামের সঙ্গে
দশ বছর পর এনামের সঙ্গে

দুপুরের খাবার খেয়ে দুজনে বের হলাম আইফেল টাওয়ার দেখবার জন্যে। এরমধ্যে ও অবশ্য একচোট আমার উপর চিল্লাচিল্লি করে নিয়েছে। চিল্লাচিল্লি করবার কারণ ও যখন আমার কাছে জানতে চেয়েছে আমি কয়দিন থাকব তখন আমি যেই বলেছি ৩দিন সেই তার চিল্লাচিল্লি শুরু, ক্যান আমি নুন্যতম এক সপ্তাহ পরের ফেরার টিকেট করিনি। বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে প্রথম গেলাম ওর বাসার পাশেই রাস্তার ধারে বসা পুরনো জিনিসের মাসিক বাজার দেখতে, জার্মানিতে যেটাকে বলা হয় ফ্লোহমার্ক্ট। সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরার পরে এনাম আমাকে বলল, চল এবার আইফেল খাম্বা দেখে আসি।

আইফেল টাওয়ার
আইফেল টাওয়ার

প্রতি ২/৩ মিনিট পরপর মেট্রো থাকায় খুব বেশি সময় লাগলো না আইফেল টাওয়ারে পৌঁছতে। মেট্রো থেকে বের হয়ে একটা বিল্ডিং পার হবার পরেই দেখি সামনে সেই মহান স্থাপনা। ছবি তুলতে গিয়েছি দেখে এনাম বলল আরে ব্যাটা এত অস্থির হয়েছিস কি জন্যে, সামনে চলে আরেকটু, আমি জানি ভিউ কোন যায়গাগুলো থেকে ভালো। কিছুক্ষণ পরে বিভিন্ন লোকেশন থেকে ক্যামেরার ভিউফাইন্ডার দিয়ে যখন তাকাচ্ছিলাম বুঝতে পারলাম বান্দা মিথ্যা কথা বলেনি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে আজ গোটা ফ্রান্সের অন্যতম আইকন হয়ে যাওয়া আইফেল টাওয়ার কিন্তু আজ হতে পারত স্পেনের বার্সেলোনার সম্পত্তি। বার্সেলোনা নগর কর্তৃপক্ষ তাদের শহরের জন্যে একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরি করে দেবার জন্যে প্রখ্যাত আর্কিটেক্ট গুস্তাফ আইফেলের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। তাদের চাহিদা মোতাবেক গুস্তাফ আইফেলের প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা মিলে আইফেল টাওয়ারের নকশা প্রণয়ন করে। তবে নকশা তৈরি হবার পরে বার্সেলোনা বাসীর কাছে তা শুধুই লোহার জঞ্জাল মনে হয়েছিল, তাই বার্সেলোনা নগর কর্তৃপক্ষ আইফেলের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করা চুক্তি বাতিল করে। পরবর্তীতে ফরাসী বিপ্লবের ১০০ বছর উদযাপন করবার উপলক্ষে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ফেয়ারের জন্যে  যখন ফরাসী কর্তৃপক্ষ প্রবেশ দাড়ের নকশা আহ্বান করে তখন আরও ১০৬ট নকশার সঙ্গে গুস্তাফ আইফেলের নকশাটিও জমা পড়ে। যাচাই বাছাই শেষে ফরাসী কর্তৃপক্ষ গুস্তাফ আইফেলের নকশাটিকেই নির্বাচন করে। টানা দুই বছর কাজ শেষে ১৮৮৯ সালে শেষ হয় আইফেল টাওয়ারের নির্মাণ কাজ। ৮০% নির্মাণ ব্যয় বহন করায় টাওয়ারের নাম আইফেলের নামেই রাখা হয়। তবে নির্মাণের পর ফ্রান্সের অনেকেই এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি, বেশিরভাগ শিল্পী/চিত্রকর এটাকে লোহার জঞ্জাল হিসাবে মতামত দেয়। তাই বলা চলে জীবনের প্রারম্ভে আইফেল টাওয়ারকে বেশ প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য আইফেল টাওয়ার কিন্তু তৈরি করা হয়েছিল মাত্র ২০ বছরের জন্যে, অর্থাৎ ১৯০৯ সালে এটাকে ভেঙ্গে ফেলার কথা ছিল। গুস্তাফ আইফেল যদিও স্বনামধন্য আর্ক্টিটেক ছিলেন, অনেক বিখ্যাত স্থাপনার সংগেই তার নাম জড়িয়ে আছে, এরপরেও উনি বুঝেছিলেন ওনার মৃত্যুর পরেও আইফেল টাওয়ার জগত জুড়ে ওনার নাম যতটা ছড়াবে তা তার অন্যকোন স্থাপনা পারবেনা। তাই তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলেন আইফেল টাওয়ারকে সদ্য আবিষ্কৃত রেডিওর টাওয়ার হিসাবে ব্যাবহার করবার। তখন যেহেতু আইফেল টাওয়ার শুধু প্যারিস নয় সমগ্র দুনিয়ার সর্বোচ্চ স্থাপনা, তাই রেডিও অ্যান্টেনা হিসাবে এটা বেশ ভালো কাজ করলো। এরপর উনি এর উপযোগিতা আর্মিকে বোঝাতে সক্ষম হন, আর এভাবেই নিশ্চিত মৃত্যুর হাতে থেকে রক্ষ্যে পায় আইফেল টাওয়ার। ভাগ্যিস উনি আইফেল টাওয়ারকে রক্ষ্যে করতে পেরেছিলেন, তাই আজও আমরা এর বিশালতা উপভোগ করতে পারি।

আইফেল টাওয়ার
আইফেল টাওয়ার

সন্ধ্যা সাড়ে ছটা পর্যন্ত উপভোগ করলাম আইফেল টাওয়ারের সৌন্দর্য, এরপরে পা বাড়ালাম বাস্তিয়ের দিকে। বাস্তিয়ে যাবার কারণ আমাদের ফ্রাইরাবান গ্রুপের ইরাসমুস বন্ধু মরগ্যানের সঙ্গে দেখা করা। ওর ইরাসমুস প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যাবার পর থেকে ও যতবার আমার শহরে এসেছে প্রতিবার যোগাযোগ করে দেখা করেছে, তাই প্যারিস যাবার আগেই ওর সঙ্গে আমি যোগাযোগ করেছিলাম, তখন ওই জানিয়েছিল সাতটায় বাস্তিয়েতে দেখা করার কথা। আমরা পৌঁছলাম ৭টা বাজার ৫ মিনিট আগে আর ও পৌঁছল ৭টা বাজার ৫ মিনিট পর। এসে দুঃখ প্রকাশ করল অনিচ্ছাকৃত দেরি হবার জন্যে, জানাল ওর বাসা শহর থেকে বাইরে তাই আসতে ঘন্টাখানেক সময় লাগে, রাস্তাতেই কিছুটা দেরি হয়ে গেছে। ওকে আগেই দায়িত্ব দিয়েছিলাম বসবার যায়গা খুঁজে বের করবার জন্যে, সেই মোতাবেক ও আমাদের একটা বারে নিয়ে গেল। ওখানে বসে আড্ডা দিলাম বেশ কিছুক্ষণ, পুরনো/নতুন কথা বলতে বলতে কখন যে ঘণ্টা দুই পার হয়ে গেল টের পেলামনা। ওখান থেকে বের হয়ে পাশের এক ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে বসে পিতজা খেলাম, যদিও আমার ইচ্ছা ছিল এনামের মুরগি দিয়ে ভাত খাবার তবে বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে পিতজাতেই রাজি হতে হল। খাওয়া শেষে যখন বাস্তিয়ে মেট্রো এর কাছে আসলাম তখন রাত ১০টা পার হয়ে গেছে। ওখানে মরগ্যানের থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর এনাম আগালাম ওর বাসার দিকে। বাসায় পৌঁছে ঘুমবার কথা দুইজনেরই, তবে দশ বছর পর দেখা হওয়া বলে কথা আর তাই ঘুমাতে ঘুমাতে রাত আড়াইটা। এর মাঝে নানা গল্পের সঙ্গে কিছুক্ষণ ছিল জ্বীনের গল্পও।

মরগ্যানের সঙ্গে আড্ডা
মরগ্যানের সঙ্গে আড্ডা

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দুজন একসঙ্গেই বাসা থেকে বের হলাম, আমি আগালাম লূভ্য মিউজিয়ামের দিকে আর ও কাজের জন্যে। মরগ্যান আগের দিন বলে দিয়েছিল ছোট লাইন পেতে হলে কিভাবে দ্বিতীয় গেটে যেতে হয়, তবে আকাশ গোমড়া থাকায় যেয়ে মেইন গেইটে লাইন ছোট পাওয়ায় ওখান দিয়েই ঢুকে পড়লাম। পূর্বে আমার প্রতিটা ফ্রেঞ্চ ফ্রেন্ড বলেছে যে নূন্যতম সাত দিন লাগবে লূভ্য এর সবকিছু ঠিকভাবে দেখতে হলে, অথচ আমার হাতে আছে মাত্র ৬ ঘণ্টা, তাই যেগুলো না দেখলেই নয় সেগুলোর একটা হিট লিস্ট বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। খুঁজে বের করার ঝামেলা এড়াবার জন্যে প্রথমেই পা বাড়ালাম মোনালিসার দিকে, কারণ গেইট থেকেই দিক নির্দেশন দেওয়া ছিল মোনালিসার পেইন্টিং যে হলে কিভাবে সেখানে যেতে হয়।

যাবার পথেই ভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে গেল The Winged Victory of Samothrace, বা the Nike of Samothrace এর সঙ্গে। এটি খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০ অব্দে তৈরি একটি মার্বেল পাথরের ভাস্কর্য। প্রাচীন গ্রীক সমাজে বিজয়ের দেবী ছিলেন নাইক। ধারনা করা হয় একটি নৌযুদ্ধের বিজয় উৎযাপন করবার জন্যে নাইকের উদ্দেশ্যে এই মূর্তিটি নির্মাণ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল বেজে উঠবার পর যেকয়টি শিল্পকর্ম লূভ্য থেকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল এটা তাদের মধ্যে একটি।

The Winged Victory of Samothrace, বা the Nike of Samothrace
The Winged Victory of Samothrace, বা the Nike of Samothrace

সেখানে কিছু সময় কাটিয়ে আবার মোনালিসার দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে হাজির হলাম মোনালিসার সামনে। হয়ত আমার রূচিবোধ খুব সূক্ষ্ম নয় তাই পেইন্টিং আমাকে কম টানে, এর থেকে বরং আমার অ্যান্টিক্স, প্রাচীন ভাস্কর্য, শিল্পকর্ম এগুলোই বেশি ভালো লাগে। তাই অবশ্য পালনীয় কর্তব্য মোনালিসার সঙ্গে দেখা করে পা বাড়ালাম গ্রীক ও রোমান অ্যান্টিক্সের দিকে। তবে যাওয়ার সময় কোনভাবেই খুঁজে পেলামনা সবাই কেন এর জন্যে এত পাগল। আবারো নিজের শিল্পবোধ কে দোষ দিলাম, কারণ কেউ বলে মোনালিসা অসাধারণ এর হাসি এর জন্যে, কেউ বলে রুমের যে কোনায়ই যাওয়া হোক না ক্যান মোনালিসা নাকি সেদিকেই তাকিয়ে থাকে, আবার কেউ বলে মোনালিসার পরিচয় নিয়ে যে ধুম্রজাল তাই একে বিখ্যাত করেছে। তবে পরদিন ওয়াকিং ট্রীপে গাইড আমাদের মোনালিসা বিখ্যাত হবার যেই কারণ বলেছে তা শুনে আমার মুখ এত বড় হা হয়ে গিয়েছিল যে আমার মুখ দিয়ে একটা ডাবল হুপার বোধহয় অনায়াসে ঢুকে যেত। তবে যেটাই হোক আমার মত স্থূল চিত্র বোদ্ধার জন্যে অবশ্য সেই কারণটিই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে। গাইডের মতে ১৯১১ সালের আগে সাধারণ মানুষ মোনালিসা সম্পর্কে তেমন জানত না, মোনালিসা পরিচিত ছিল শুধু চিত্রকর বা চিত্রকলা নিয়ে পড়ালেখা করা ছাত্রছাত্রীদের কাছে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এর আকা ১৫টি ছবি এর মধ্যে একটি ছবি হিসাবে। তো কি হয়েছিল ১৯১১ সালে যার জন্যে মোনালিসা জগত জুড়ে বিখ্যাত হয়ে গেল? তার জন্যে একটু ইতিহাস জানতে হবে।

মোনালিসা
মোনালিসা

বেশিরভাগ ইন্টেলেকচুয়াল মানুষের মত লিওনার্দো দা ভিঞ্চিও খেয়ালি মানুষ ছিলেন, অনেক ছবিই তিনি শুরু করেছেন তবে শেষ করতেন না। তাই তার আকা পরিপূর্ণ চিত্রকর্মের সংখ্যা সাকুল্যে মাত্র ১৫। তিনি ইতালি এর নাগরিক ছিলেন এবং থাকতেন ইতালিতেই। ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিস-১ তার জীবনের প্রথম ১৪ বছর ইতালিতে কাটিয়েছেন, তখনই তার সঙ্গে দা ভিঞ্চি এর পরিচয় হয়। পরবর্তীতে ফ্রান্সিস-১ ফ্রান্সে ফিরে আসেন এবং রাজা হন। কিন্তু তার রাজত্বকালে ফ্রান্স কোন বড় যুদ্ধেই জয়লাভ করত পারেনি, এদিকে উনি জয়ের ক্ষুধায় কাতর। তাই উনি লিওনার্দো দা ভিঞ্চিকে ফ্রান্সে দাওয়াত দেন তার জন্যে একটি যুদ্ধ-যন্ত্র তৈরি করে দেবার জন্যে। ভিঞ্চি শিষ্য সাল্লি কে নিয়ে ফ্রান্সে আসেন এবং যুদ্ধ-যন্ত্র তৈরি করবার কাজে হাত দেন। তবে রাজা ফ্রান্সিসের দুর্ভাগ্য, কাজ শেষ করবার আগেই ফ্রান্সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তার মৃত্যুর পরে তার সঙ্গে আনা সবকিছুর মালিকানা পান তার শিষ্য সাল্লি। সাল্লি এর কাছে থাকা ভিঞ্চি এর ৫টি চিত্রকর্মই কিনে নেন রাজা ফ্রান্সিস-১। তখন থেকে কয়েকবার যায়গা বদল করে লূভ্যে থিত হয় মোনালিসা।

১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে লূভ্যের প্রাক্তন কর্মী ইতালি এর নাগরিক ভিঞ্চেঞ্জো এর হটাত মনে হয় ভিঞ্চিতো ছিলেন ইটালি এর নাগরিক, তার পেইন্টিং থাকা উচিত ইটালিতে, লূভ্য এ নয়। তাই সে পাঁচটা পেইন্টিঙের মধ্যে একটা চুরি করার প্ল্যান করে। সে একদিন দিনের বেলায় ঢুকে সারারাত লূভ্যেই অপেক্ষা করে এবং পরদিন মোনালিসাকে নিয়ে লূভ্য থেকে বের হয়ে যায়। ধারনা করা হয় পাঁচটা ছবির মধ্যে মোনালিসাকে বেছে নেওয়ার কারণ চিত্রগত গুনের কারণে নয় বরং মোনালিসা আকারে ছোট হওয়ায় পাচারে সুবিধা হবে দেখে সে মোনালিসাকে বেছে নেয়। পরদিন চিত্রকর্মটির ছবিসহ খবরের কাগজে চুরি যাবার খবর ছাপা হয়। এই প্রথম ফ্রান্সের সাধারণ মানুষ বিশেষভাবে মোনালিসাকে দেখে। সেই সময় পাবলো পিকাসো ফ্রান্সের বিখ্যাত চিত্রকর। তবে গুজব ছিল তিনি তার বন্ধু আপুলিনেরের সহযোগিতায় লূভ্য থেকে ছোট ছোট স্কাল্পচার চুরি করেন। এদিকে মোনালিসা যেদিন চুরি হয় সেদিন আবার পাবলো পিকাসো বন্ধু আপুলিনেরকে নিয়ে লূভ্য গিয়েছিলেন। তাই ফরাসী গোয়েন্দাদের নজর পরে তাদের দিকে। গ্রেফতার করা হয় আপুলিনেরকে আর জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে তলব করা হয় পাবলো পিকাসোকে। ফলে পরদিন সারা বিশ্বে ফলাও করে প্রচার করা হয় মোনালিসা চুরির প্রধান সন্দেহভাজন বিখ্যাত ফরাসি চিত্রকর পাবলো পিকাসো। আর এর ফলেই সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে পরিচিতি পায় মোনালিসা। যদিও কিছু না পাওয়া যাওয়ায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে দেশপ্রেমী চোর ভিঞ্চেঞ্জো দুই বছর অপেক্ষা করে ১৯১৩ সালে মোনালিসা নিয়ে ফ্লোরেন্স যায়। সেখানে একটি আর্ট গ্যালারিতে সে মোনালিসা বিক্রি করতে চেষ্টা করে। আর্ট গ্যালারির ডিরেক্টর তাকে জানায় আমাদের যাচাই করার জন্যে এবং এত বিরাট অঙ্কের টাকা যোগার করবার জন্যে একদিন সময় দরকার। তুমি এটা এখানে রেখে গিয়ে আগামীকাল আসো। পরদিন ভিঞ্চেঞ্জো সেখানে যায় ঠিকিই তবে তার হাতে নগদ নারায়ণ পরবার পরিবর্তে পরে পুলিশের হাতকড়া। এইসময় বিশ্ব গণমাধ্যম আবার মেতে উঠে মোনালিসাকে নিয়ে। সমগ্র ইটালিতে প্রদর্শন শেষে মোনালিসা আবার ফিরে আসে তার আবাস লূভ্যে। এরপর লূভ্যে মানুষের ভিড় নামে দেখবার জন্যে যে মোনালিসা কি এমন চিত্রকর্ম যার জন্যে এত হইচই। আর যত দিন গেছে মানুষের ভিড় শুধু বেড়েই গেছে আর সেই সঙ্গে এর অসাধারণত্ব নিয়ে আবিষ্কার হয়েছে নানা থিউরি (আমার ব্যক্তিগত মত)।

Great Sphinx of Tanis (Old Kingdom, 2600 BC, Old Kingdom)
Great Sphinx of Tanis (Old Kingdom, 2600 BC, Old Kingdom)

মোনালিসার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ করে একে একে খুঁজে বের করলাম মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর Dying Slave যেটা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো তৈরি করেছিলেন ১৫১৩ থেকে ১৫১৬ সালে, Venus de Milo যেটা ১০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন গ্রিসে তৈরি করা হয়েছিল, Great Sphinx of Tanis যেটা ২৬০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ফারাও সম্রাজ্যের নিদর্শন। হিট লিস্ট শেষ হবার পরে শুরু করলাম আমার আগ্রহ যেই বিষয়গুলোতে ম্যাপ দেখে সেই হলগুলো ঘুরে দেখা। লূভ্যের একটা জিনিস আমার বিরক্তিকর লেগেছে যে প্রতিটা আইটেমের টাইটেল বা বর্ণনা ফ্রেঞ্চে লেখা (শুধু নতুন সেকশন গুলোতে ফ্রেঞ্চের পাশাপাশি ইংরেজিতে লেখা)। ইংরেজি বর্ণনা খুঁজে বের করতে হলে হল নাম্বার এবং আর্টিকেল নম্বর দেখতে হবে প্রথমে, এরপরে প্রতিটা হলের কোনায় যেয়ে একটা বক্স থেকে নম্বর মিলিয়ে সেই আর্টিকেলের ডিটেল লেখা লেমিনেটেড কাগজ বের করতে হবে, যা অত্যন্ত সময় সাপেক্ষ ও বিরক্তিকর, তাই বর্ণনা না বুঝেই ঘুরে দেখলাম নেয়ার ইস্টার্ন, ইজিপশিয়ান, গ্রিক, রোমান সেকশনগুলো। শেষ ৪০ মিনিট রেখেছিলাম নতুন করা ইসলামিক সেকশনের জন্যে। ওখানে ওপরের ছোট ফ্লোরটা ভালো লাগলো যেখানে মোজাইক, সিরামিক, মিনিয়েচার সহ নানা ইসলামিক সাম্রাজ্যের শিল্পকর্ম রয়েছে তবে নিচের বড় ফ্লোরে যেয়ে যখন দেখলাম বেশিরভাগই অস্ত্রশস্ত্র তখন আমার কাছে ব্যাপারটাকে ইচ্ছাকৃত মনে হয়েছে এবং ব্যাপারটা আমাকে বেশ আহতও করেছে। ওদের ভাব দেখে মনে হয়েছে আমদের ইতিহাস মানেই যুদ্ধ বিগ্রহ, মুসলিম মানেই হিংস্র।

Venus de Milo (100 BC, Cyclades, Greece)
Venus de Milo (100 BC, Cyclades, Greece)

যাইহোক, ওখান থেকে বের হয়ে আবারো বাস্তিয়েতে। এনাম একটা ইতালিয়ান রেস্টুরেন্টের মেইন শেফ, ওকে সঙ্গে নিয়ে বের হওয়ার জন্যের ওর রেস্টুরেন্টের দিকে যাত্রা। ওখানে যেয়ে পরিচিত হলাম রেস্টুরেন্টের মালিক আর ওর এক কলিগের সঙ্গে। আন্তরিক মালিক দুপুরের খাবার খেতে বললেন, তবে ইতালিয়ান নয় আমাদের ইচ্ছা বাঙালি খাবার খাওয়া তাই তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমরা দুজনে সেখান থেকে বের হয়ে আগালাম গাঁড়ে দ্যূ নর্দের দিকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে প্যারিস যাবার ১৫ দিন আগে পলিটেকনিক জীবনের আরেক বন্ধু রেজা ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানিয়েছে ও সম্প্রতি দুবাই থেকে পরিবার নিয়ে প্যারিসে এসেছে, আমি যদি কখনো প্যারিস যাই ওকে যেন যানাই। তখনি ওকে জানিয়েছিলাম আসছি ১৫ দিন পর তখন দেখা হবে বন্ধু। এনাম ওর সঙ্গে আগের রাতে কথা বলে রেখেছিল গাঁড়ে দ্যূ নর্দে কখন আসতে হবে সে ব্যাপারে। আমরা পৌঁছোবার কিছুক্ষণ পরে বান্দা হাজির, সঙ্গে বৌ তো আছেই বোনাস হিসাবে সাড়ে আট বছরের ছেলে নাফী।

রেজার সঙ্গে দেখা ১২ বছর পর, সঙ্গে বোনাস ভাস্তে নাফী
রেজার সঙ্গে দেখা ১২ বছর পর, সঙ্গে বোনাস ভাস্তে নাফী

আমার সঙ্গে ওর শেষ দেখা ১২ বছর আগে, তখন বাচ্চা তো দূরে থাক বিয়েই করেনি। সেই সময়ের রেজা ছিল বদ প্রকৃতির (খারাপ অর্থে নয় অবশ্যই :p ) , আমাদের ক্লাসে যেই কয়টা বদ ছিল ও ছিল তার মধ্যে অন্যতম, আর এখনকার রেজা মাশাআল্লাহ সুন্নতী জীবন যাপনকারী। ফেসবুকে ওর সঙ্গে সংযুক্ত অনেক দিন ধরেই তাই পরিবর্তন বা আপডেট সবই দেখেছি, তবে সামনে দেখে ভালোলাগার পরিমাণটা অনেক বেশি লাগলো। পুনর্মিলনের পরে সবাই মিলে একসঙ্গে গেলাম এক বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেতে, তখন যদিও ঘড়ির কাটা ৪টার কাছে। নান, ডাল আর গরু ভূনা দিয়ে বেশ জম্পেশ একটা খাওয়া দিলাম। খাবার খাওয়ার মাঝে কার এলাকার লোক ডাকাত সেটা নিয়ে চলল এনাম আর রেজার বউ এর মধ্যে মিষ্টি মধুর যুদ্ধ, ওরা আবার প্রতিবেশী থানার/জেলার লোক কিনা। আর সেই সঙ্গে পুরানো দিন নিয়ে রেজাকে এনামের ননস্টপ পচানো তো ছিলই, আমি যতই বোঝাই সঙ্গে ভাস্তে আছে কিন্তু কে শোনে কার কথা :p । খাবার শেষে আমাদের তিনজনের মধ্যে যথারীতি বাঙালি নিয়ম অনুযায়ী যুদ্ধ হল কে বিল দিবে সেটা নিবে, তবে মালিক পরিচিত থাকায় বিজয়ী হল এনাম।

বাজিলিক দু স্যাক্রিকা
বাজিলিক দু স্যাক্রিকা

রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এনাম গন্তব্য ঠিক করল বাজিলিক দু স্যাক্রিকা, গাঁড়ে দ্যূ নর্দ থেকে ১৫ মিনিটের হাটা পথ। উঁচু স্থান থেকে প্যারিসের সৌন্দর্য উপভোগ করবার জন্যে হাতে গোনা যে কয়টি বার্ডস আই ভিউ পয়েন্ট আছে বাজিলিক দু স্যাক্রিকা তার একটি, উপরি পাওনা এখানে যেতে কোন টিকেট লাগেনা (ডোম ব্যতীত)। যাবার সময় পায়ে হেটে সিঁড়ির ৯০ ধাপ অতিক্রম করে ওপরে উঠলাম। ওপর থেকে কিছুক্ষণ উপভোগ করলাম রাতের প্যারিস। ওখান থেকে পাঁচ মিনিট হেটে একটা প্লাজা এর মত যায়গায় পৌঁছলাম যেখানে চিত্রকরেরা তাৎক্ষণিক পোট্রেট একে দেয়। কিছুক্ষণ ছবি আঁকা দেখে ফিরতে চাইলাম কিন্তু ভাস্তে নাফী চায় আরও কিছুক্ষণ ছবি আঁকা দেখতে, তাই আরও কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে ফিরলাম বাজিলিক দু স্যাক্রিকাতে। আমার ইচ্ছা ভেতরে যাবার কিন্তু এনাম যাবে না, তাই আমরা বাকি সবাই ভিতরে যেয়ে কিছুক্ষন ঘুরে আসলাম। ফেরার সময় নাফী প্রতিবাদ জানাল সে আর সিঁড়ি বাইবে না। আমি ইতোমধ্যে ২ দিনের ট্র্যাভেল পাস কিনেছি তাই আমি চাইলে ফানিকুলার নামক কেবল কার দিয়ে নিচে নামতে পারি, তাই এনামের মান্থলি টিকেট দিয়ে রেজা পত্নী কলি আর আমার টিকেট দিয়ে আমি আর নাফী ফানিকুলারে চরলাম। নিচে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবার পরে এনাম আর রেজা চলে আসল। রেজা ওর বাসায় ফিরবে আর আমরা এনামের বাসায়। এনাম রেজাকে জানাল ওখান থেকে সহজে মেট্রো দিয়ে কি করে যেতে পারবে, কিন্তু রেজা জানাল ও প্যারিসে নতুন ও চেনে শুধু বাস স্টপ থেকে কিভাবে ওর বাসায় যেতে হয় তাই ওকে বাসেই যেতে হবে। এরপর শুরু হল অনির্দিষ্ট এর উদ্দেশ্যে যাত্রা, ওর কাঙ্ক্ষিত ও পরিচিত বাস ছাড়ে যেই স্টপ থেকে সেখানে পৌছতে আমাদের হাটতে হয়েছে মোটামুটি ৮ টা মেট্রো স্টপের সমান দুরুত্ব।

ছবি আঁকা উপভোগে মগ্ন নাফী
ছবি আঁকা উপভোগে মগ্ন নাফী

তবে মধ্যের সময়টা আমার বেশ ভালো কেটেছে নাফী এর সঙ্গে গল্প করতে করতে। ফেসবুকের কল্যাণে বই এর প্রতি ওর অনুরাগ সম্পর্কে আগেই জেনেছি, তাই ওকে অনুরোধ জানালাম আমকে গল্প শোনাবার, পুরোটা রাস্তা আমাকে শুনিয়ে গেছে একের পর এক গল্প। তবে মাঝে ওর একটা কথা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। আমি আমাদের কথোপকথনটা নিচে দিচ্ছি-

– অনিম চাচ্চু তুমি কি সৌদিআরব চেন?

= আমি ওখানের নাম শুনেছি কিন্তু কখনো যাইনি, তুমি তো হজ্জ করতে গিয়েছিলে?

– হ্যাঁ চাচ্চু, তুমি ওখানে যেও তোমার ভালো লাগবে।

৮ বছরের বাচ্চার মুখে এমন কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম, তবে আবার গল্প শুরু করে ও নিজেই আমার হতভম্ব ভাব কাটাতে সাহায্য করেছিল। পথে রেজা অনুরোধ জানাল পরদিন দুপুরে বা রাতে যেন ওর বাসায় যাই, আমি জানালাম আমার এখনো অনেক কিছু ঘুরে দেখা বাকি তাই আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব না, তবে এর পরেও সে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছে রাজি করাতে কিন্তু রাজি হওয়াটা আসলে কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। রেজাকে ওর বাসে উঠিয়ে মেট্রো দিয়ে আমরা ফিরলাম এনামের বাসায়। বাসায় পৌঁছে এনাম জানিয়ে দিল আজকে যেন আমি কোন জ্বীন/পরীর গল্প না করি, আগের রাতে নাকি ওর ঘুমাতে সমস্যা হয়েছে। জ্বীন/পরীর গল্প ব্যতীত অন্য গল্প করে সেদিনও ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ২টা।

বাজিলিক দু স্যাক্রিকা থেকে রাতের প্যারিস
বাজিলিক দু স্যাক্রিকা থেকে রাতের প্যারিস

পরদিন সকালে উঠে এনাম চলে গেল ওর কাজে আর আমি ফ্রেশ হয়ে রওনা হলাম গাঁড়ে দ্যূ নর্দের দিকে। ওখানে যেয়ে বিরিয়ানি দিয়ে জমিয়ে একটা খাওয়া দিলাম। খাবার পরের গন্তব্য সেইন্ট মাইকেল ক্যাথেড্রালের সামনে সেইন্ট মাইকেল ফোয়ারা, উদ্দেশ্য তিন ঘণ্টার একটি ওয়াকিং ট্রিপে অংশগ্রহণ করা। ওখানে পৌঁছে গিয়েছিলাম সময়ের আগেই তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করত হল। আমাদের ট্রিপ শুরু হল দুপুর একটায়। গাইড জানাল আমারা যেই চত্বরে দাড়িয়ে আছি সেটা যে কোন কিছু উদযাপনের জন্যেই প্যারিস বাসীর খুব পছন্দের যায়গা। অজুহাত পেলেই সব এখানে এসে জড় হয়। মজার একটা উদাহরণ দিল। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জেতবার পর সব এখানে এসে জড় হয়েছিল, তখন এক পাগলা সমর্থক ২০ ফিট ভাস্কর্য বেয়ে উঠে সেইন্ট মাইকেলের মূর্তিতে ফ্রান্স জাতীয় দলের জার্সি পরিয়ে দিয়েছিল। সেইসময় ভিড়ের মধ্যে ঢোকে ব্রাজিলিয়ান এক সমর্থক, তার গা থেকে ব্রাজিল জাতীয় দলের জার্সি খুলে নিয়ে সেটা সেইন্ট মাইকেলের মূর্তি যেই দানবকে পদদলিত করছে সেই দানবের গায়ে পরিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত এই ধরনের পাগলামি প্রায়ই হয় তাই সিটি কর্পোরেশন পরদিন এসে সব পরিষ্কার করে, তবে কথিত আছে ফ্রান্স জাতীয় দলের জার্সি সেইন্ট মাইকেলের গায়ে ছিল ১ মাস।

সেইন্ট মাইকেল
সেইন্ট মাইকেল

গাইড আমাদের ট্রিপ শুরু করল প্যারিস নগরীর জন্মগাথা শুনিয়ে। আমাদের পেছনেই ছিল পুলিশের প্রধান কার্যালয়, জানাল আরও কয়েকটি সরকারী অফিস আছে ওখানে। জানাল অফিসগুলো যেই যায়গার উপর, সেইন নদীর মধ্যে ওটা একটা দ্বীপ যার নাম ইল দে লা সাইট, আর ঐ দ্বীপ থেকেই যাত্রা শুরু করে আজকের মহানগরী প্যারিস। প্রায় ২৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে গল অঞ্চলের সেল্টিক জাতীর একটি উপজাতি যাদের নাম ছিল পারিসি তারা এই দে লা সাইট দ্বীপে প্রথম বসতী স্থাপন করে। সহজ নৌযোগাযোগ থাকায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র হয়ে যায়। তবে তারা খুব বেশিদিন এই যায়গা নিজেদের দখলে রাখতে পারেনি। ৫২ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রোমানরা এটা দখল করে নিয়ে সেখানে একটি গ্যারিসন স্থাপন করে এবং এর নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেয় লুতেসিয়া। ৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় এর নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় প্যারিস।

সেইন নদীর মাঝে ইল দে লা সাইট
সেইন নদীর মাঝে ইল দে লা সাইট

প্যারিসের জন্মগাথা শুনে আমরা পরবর্তী গন্তব্য নটরডেম ক্যাথেড্রালের দিকে অগ্রসর হলাম। যাবার পথে গাইড আমাদের দেখাল যে হাতের ডান পাশে যে সড়কটা গেছে সেটা বিখ্যাত ল্যাটিন কোয়ার্টার এরিয়াতে পরেছে। ল্যাটিন কোয়ার্টার নামটা প্যারিস সম্পর্কে খোজ নিতে গিয়ে শুনেছি, তখন ধারনা করেছি এই এলাকাতে সম্ভবত স্প্যানিশ ভাষাভাষীর প্রাধান্য বেশি, তাই এমন নাম। তবে গাইড এর কাছে জানলাম আমার ধারনা ভুল। প্রায় ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দে এই এলাকার কাছেই প্যারিসের প্রথম ইউনিভার্সিটি লা সাবর্ণ (ইউরোপেরও প্রথমদিককারগুলোর মধ্যেও একটি বটে) প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্র/ছাত্রী এই ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসত, ভার্সিটি কাছে হওয়ায় তাদের থাকবার সুবিধার জন্যে এই এলাকাতে গড়ে উঠে অসংখ্য লজিং হাউস। একেকজনের ভাষা একেকরকম হওয়ায় যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কমন ল্যাঙ্গুয়েজ ল্যাটিনকে বেছে নেয় সবাই। তখন এই এলাকার রাস্তাগুলো সব সময় মুখর থাকতে ল্যাটিন শব্দে, আর এভাবেই এ এলাকার নাম হয়ে যায় ল্যাটিন কোয়ার্টার।

নটরডেম ক্যাথেড্রাল
নটরডেম ক্যাথেড্রাল

অল্প একটু হেটেই আমরা পৌঁছে গেলাম নটরডেম ক্যাথেড্রাল। এটা শুধু ফ্রান্সেরই না পৃথিবীর বৃহত্তম ও বহুল পরিচিত ক্যাথেড্রালের একটি, যার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১১৬৩ খ্রিষ্টাব্দে এবং নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ। ফ্রেঞ্চ রাজতন্ত্র এর সঙ্গে এই নটরড্যাম ক্যাথেড্রালের সম্পর্ক সুগভীর। সিংহাসনে আরোহণের পূর্বে রাজাদের রাজ্যাভিষেক এই নটরড্যাম ক্যাথেড্রালেই হত। খুব অল্প কথায় বললে নিয়ম ছিল সবথেকে মাঝের দরজা দিয়ে পায়ে হেটে হবু রাজা ক্যাথেড্রালে প্রবেশ করবেন এবং সোজা অল্টারের দিকে হেটে যাবেন। ওখানে রাজমুকুট হাতে তার জন্যে অপেক্ষা করতেন পোপ। পোপের সামনে একটি কুশন থাকতো, রাজা সেই কুশনে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে পোপের সামনে বসতেন। এরপরে পোপ রাজাকে রাজ মুকুট পরিয়ে দিতেন। এই প্রথা দিয়ে বোঝানো হত সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ঈশ্বর, তার কাছ থেকে ক্ষমতা ন্যস্ত হয় চার্চের কাছে আর চার্চ থেকে ক্ষমতা ন্যস্ত হয় রাজার হাতে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে তখন চার্চ বেশ ক্ষমতাশালী ছিল, রাজকার্যে প্রায়ই প্রভাব বিস্তার করত। চার্চের এই মাতব্বরি সম্রাট নেপোলিয়নের পছন্দ হয়নি। তিনি নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করবার পরে তার অভিষেকও নটরড্যাম ক্যাথেড্রালেই হয়েছে। তিনিও মাঝের দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন তবে পোপের সামনে গিয়ে না বসে তিনি সরাসরি মুকুটের দিকে হাত বাড়ান। পোপ অবশ্য মুকুট ছাড়তে চাননি, ফলে তাদের মধ্যে মুকুট নিয়ে টানাটানি হয়। ৭২ বছরের বৃদ্ধ পোপ খর্ব সহজেই যুবক নেপোলিয়নের কাছে হেরে যান। এক ঝটকায় তার কাছ থেকে মুকুট কেড়ে নিয়ে সম্রাট নেপোলিয়ন নিজ হাতেই তা পড়েন, আর এর মাধ্যমে তিনি বুঝিয়ে দেন চার্চের দিন এবার শেষ।

রাজা হেনরি-৪
রাজা হেনরি-৪

নটরড্যাম দর্শন শেষ করে কিছুক্ষণ হাঁটলাম সেইন নদীর পার দিয়ে এবং পাড়টা নদীর মাঝখানে, অর্থাৎ আমরা হেঁটেছি আজকের প্যারিস মহানগরী যাত্রা শুরু করেছিল যেই দ্বীপ ইল দে লা সাইট থেকে সেই দ্বীপের একটা পাড় দিয়ে। হাটতে হাটতে পথে দেখা হয়ে গেল রাজা হেনরি-৪ এর সঙ্গে। জী হ্যাঁ, সত্যিকারের ফরাসী রাজার সত্যিকারের মূর্তি। বলা হয়ে থাকে হেনরি-৪ ফরাসী রাজতন্ত্রের শেষ রাজা যিনি সর্বদা প্রজাদের সুবিধা/অসুবিধার কথা চিন্তা করতেন। তিনি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে রাজ্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেন। এই জন্যেই তাকে “The Good King” নামেও ডাকা হত। অবশ্য ভালোবাসাবাসির ক্ষেত্রেও তিনি অসম্ভব পটু ছিলেন তাই তাকে “The King of Love” নামেও ডাকা হত। জনশ্রুত, সবসময় তার হাতে দেখা যেত একটা ওয়াইনের গ্লাস আর মুখে লেগে থাকত একটুকরো হাঁসি, যদিও তিনি মাতলামি কখনই করতেন না। তার মূর্তিটা রাখা হয়েছে পুন নউফ বা নতুন ব্রিজের মাঝামাঝি। এই ব্রিজটা পাথরের তৈরি প্যারিসের প্রথম ব্রিজ যেখানে ব্রিজের উপর কোণ ঘরবাড়ি ছিল না। তবে তৈরি হবার অল্পদিন পরেই অন্য একটি দলের দখলে চলে যায় ব্রিজের পার্শ্ব অংশ। সেই সময়ের দাঁত তোলার কারিগরেরা এখানেই রাস্তার উপর মানুষের নষ্ট হয়ে যাওয়া দাঁত তুলত। সেই সময় অ্যানেস্থাশিয়ার ব্যবস্থা না থাকায় মদ খাইয়ে বা মাথায় বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে দাঁত তোলা হত, তবে মাতালদের কারণে অবস্থা এতই ভয়াবহ হয়ে যায় যে সরকার ঝেটিয়ে সব ডেন্টিস্ট বিদায় করে। বর্তমানে, হেনরি-৪ এর  নামের প্রতি সুবিচার করবার জন্যেই হয়ত তার ভাস্কর্যের চারপাশে ব্রিজের রেলিঙে প্রেমিক যুগল তালা লাগিয়ে তাদের ভালোবাসা আজীবনের জন্যে গিট দিয়েছে। ফলে এটা হয়ে উঠেছে প্যারিসের নতুন ভালোবাসার সেতু। উল্লেখ্য আসল ভালোবাসার সেতু পুন দে আর্টস এ তালার ওজন এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যে সেখান থেকে সব তালা খুলে ফেলে সেখানে লোহার রেলিঙের পরিবর্তে প্লেক্সি গ্লাসের রেলিং দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ভালোবাসার সেতু পুন দে আর্টস
ভালোবাসার সেতু পুন দে আর্টস

রাজদর্শন শেষ করে একটু হেটে পৌঁছে গেলাম একাদেমি ফ্রঁসেজ এর সামনে। এই একাডেমীকে বলা হয় ফ্রেঞ্চ ভাষার অভিভাবক আর এর সদস্যদের বলা হয় ইমমর্টাল। ইনাদের কাজ ফ্রেঞ্চ ভাষাকে রক্ষা করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন আনা। একাডেমী এর সামনে যেই সেতু সেটাই আদি ভালোবাসার সেতু পুন দে আর্টস। সেতু পার হয়ে পৌঁছে গেলাম লূভ্য মিউজিয়ামে। লূভ্য মিউজিয়াম এখন যেখানে অবস্থিত ১২শ শতকে রাজা ফিলিপ-২ প্রথম ওখানে একটি দুর্গ তৈরি করেন, অবস্থানগত কারণে দুর্গের প্রয়োজনীয়তা লোপ পেলে পরবর্তীতে ১৫৪৬ সালে রাজা ফ্রান্সিস-১ দুর্গটিকে প্রধান রাজপ্রাসাদে পরিবর্তন করেন। তবে ১৬৮২ সালে রাজা লুইস-১৪ ভার্সেই রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করবার পরে লূভ্য রাজপ্রাসাদের মর্যাদা হারায়, তখন এটাকে রাজকীয় সংগ্রহশালা হিসাবে ব্যাবহার করা হত। প্রায় একশ বছর পর ফরাসী বিপ্লবের পরে ১৭৯৩ সালের ১০ই আগস্ট লূভ্য মিউজিয়াম হিসাবে তার যাত্রা শুরু করে। এরপরে গাইড আমাদের শোনাল মোনালিসা বিখ্যাত হবার পেছনের ঘটনা যেটা আমি আগেই বলেছি। সেখানে থেকে একটু এগিয়ে পেলাম আর্ক ডি ট্রিউম্প দু কারুজ্জেল্লে, এটার নিচ দিয়ে পার হবার আগে গাইড শোনাল পেছনের কথা। এটা মূলত তৈরি করা হয় ঠেকা কাজ চালাবার জন্যে। নেপোলিয়ন তার বিজয়গুলোকে উৎযাপন করবার জন্যে একটি তোরণ তৈরি করবার আদেশ দেন। সঞ্জে লিজিতে শুরুও করা হয় আর্ক ডি ট্রিউম্প তৈরি করবার কাজ, তবে এটা এত বিশাল যে অল্প সময়ে এটি তৈরি করা সম্ভব ছিলনা। তাই এক বছরের মধ্যে আর্ক ডি ট্রিউম্প দু কারুজ্জেল্লে তৈরি করা হয় লূভ্য প্রাসাদের সামনে যেন নেপোলিয়ন তার নববধূকে নিয়ে এর নিচ দিয়ে প্রবেশ করতে পারেন। নেপোলিয়নের মত আড়ম্বরে না হলেও আমরাও পার হলাম এর নিচ দিয়ে। এরপরে ওখান থেকেই দেখা যাচ্ছিল আইফেল টাওয়ার, গাইড আমাদের শোনাল এটা তৈরি করবার গল্প যেটাও আমি প্রথমে বলেছি। আর এই গল্পের মধ্যেই শেষ হল আমাদের তিন ঘণ্টার ওয়াকিং ট্রিপ।

লূভ্য এর পিরামিড
লূভ্য এর পিরামিড

ঐদিন সন্ধ্যায় আমার সেইনে ক্রুজ ট্রিপ দেওয়ার কথা, গাইডের কাছে ১৫ ইউরোর টিকেট ১৩ ইউরোতে পাওয়া যাচ্ছিল, খারাপ কি? তাই ওর থেকেই টিকেট একটা নিয়ে রাখলাম। এরপরে আমার গন্তব্য আর্ক ডি ট্রিউম্প। ও যখন জিজ্ঞেস করল এরপরে কোথায় যাচ্ছ, পাশের মেট্রো স্টেশন দেখিয়ে আমি বলেছিলাম মেট্রো নিয়ে আর্ক ডি ট্রিউম্প। ও আমকে বলে তুমি কি পাগল নাকি? তোমার অবশ্যই উচিত এখান থেকে সোজা হেটে যাওয়া, সঞ্জে লিজি হচ্ছে প্যারিসের সব থেকে সুন্দর রাস্তা, আর তুমি হেটে না যেয়ে সেটা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে চাও? অভিজ্ঞতার দাম দিতেই হয়, তাই ওর পরামর্শ মেনে নিয়ে হাটা শুরু করলাম আর্ক ডি ট্রিউম্প এর দিকে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম আলবার্তো একদম বাড়িয়ে বলেনি, তবে সামারে বোধহয় এখানে হাটার মজা আরও কয়েকগুণ বেশি। যাইহোক সঞ্জে লিজির সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে সম্ভবত ২০ মিনিটের মাথায় পৌঁছে গেলাম আর্ক ডি ট্রিউম্প। আগেই বলেছি নেপোলিয়ন ক্যান এটা তৈরি করতে বলেছিলেন। অবশ্য তিনি তার জীবদ্দশায় এর নির্মাণকাজ এর সমাপ্তি দেখে যেতে পারেননি। তবে তার আদেশ সম্পর্কে ফরাসীরা এতই ভীত ছিল যে এর নির্মাণকাজ শেষ হবার পরে তার শবাধার এর নিচ দিয়ে নেওয় হয় তিন তিন বার।

আর্ক ডি ট্রিউম্প
আর্ক ডি ট্রিউম্প

আর্ক ডি ট্রিউম্প এ কিছু সময় কাটিয়ে রওনা হলাম আইফেল টাওয়ার এর দিকে। পথে বির হাকিম নামের একটা মেট্রো স্টেশনে বসে আছি মেট্রো লাইন চেঞ্জ করবার জন্যে এমন সময় ব্রিটিশ এক নারী (উচ্চারণ শুনে তাই মনে হয়েছে) বাচ্চা কোলে নিয়ে এসে তার গন্তব্যের কথা জানিয়ে জানতে চাইলেন এটা ঠিক স্টেশন কিনা, আমি একটু সময় নিয়ে তাকে জানালাম স্টেশন ঠিক হলেও উনি ভুল পাশে এসেছেন, ধন্যবাদ জানিয়ে অন্য পাশে চলে গেলেন। শুধু ওনার ক্ষেত্রেই না আমি নিজে যতক্ষণ প্যারিসে একা চলাচল করেছি আমাকে একবারের জন্যেও কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়নি আমাকে কোথা থেকে কোন মেট্রো নিতে হবে বা কোথায় লাইন চেঞ্জ করতে হবে। আর এর পুরো কৃতিত্ব “Next Station Paris” নামের একটা অ্যাপ যেটাকে আমার কাছে মনে হয়েছে টুরিস্টদের জন্যে শ্রেষ্ঠ অফলাইন পাবলিক ট্রান্সপোর্ট রাউট প্ল্যানার, এর বড় একটা সুবিধা মেইন অ্যাট্রাকশনগুলোর নাম দেওয়া, সেটা সিলেক্ট করলেই হয়।

শিপের আপার ডেক থেকে
শিপের আপার ডেক থেকে

আইফেল টাওয়ারে পৌঁছে নদীর পাড়ে গেলাম আমার কাঙ্ক্ষিত ক্রুজ খুঁজে বেড় করবার জন্যে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল তবে তাতে ভালোই হয়েছে কারণ আমার ট্রিপ শুরু হয়েছিল সন্ধ্যা ৬টায় যখন চারদিকে অন্ধকার হওয়া শুরু হয়েছে, এতে করে শিপ থেকে রাতের প্যারিসের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পেরেছি ভালোভাবে। শুরুতে কিছুক্ষণ আপার ডেকে বসে ছিলাম তবে মিনিট ৩০ পরে ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করায় বাকি ৩০ মিনিট লোয়ার ডেকে কাচের ভেতর থেকে প্যারিসের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম আর সেই সঙ্গে শুনলাম ইংরেজিতে ধারাবর্ণনা। দেখতে দেখতে কেটে গেল ১ ঘণ্টা, শিপ থেকে নেমে রওনা হলাম গ্র্যান্ড মস্কের দিকে। তবে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হয়ে যাওয়ায় ভেতরে আর ঘোরা হল না। এনাম গাঁড়ে দ্যূ নর্দ থেকে সিম কিনে দিয়েছিল, বিকাল থেকে সেখানে ও কয়েকবার ফোন করে খোজ নিয়েছে। গ্র্যান্ড মস্কে ঢোকার আগে মনে পরল আমার জন্যে ও ওদিনের সন্ধ্যার সার্ভিস ক্যান্সেল করেছে, তাই বাসার ফেরার ব্যাপারে একটা তাড়া অনুভব করলাম। তবে গ্র্যান্ড মস্ক থেকে হাটা পথে প্যান্থিয়ন এর দূরত্ব যেহেতু বেশি না তাই ভাবলাম আর অল্প একটু বেশি দেরি করে ওখান থেকে ঘুরেই যায়।

যেই ভাবা সেই কাজ, মিনিট দশেক হেটে পৌঁছে গেলাম প্যান্থিয়ন। এটাকে রাজা ফ্রান্সিস-১৫ তৈরি করে ছিলেন গির্জা হিসাবে তবে ফরাসী বিপ্লবের পরে এটাকে সমাধিস্থলে রূপান্তর করা হয়। ওখানে কিছু সময় কাটিয়ে মেট্রোর দিকে পা বাড়ালাম। পথে একটা স্যুভিনির শপ দেখে সেখানে ঢুকে পড়লাম, উদ্দেশ্য হাসিব ভাইয়ের জন্যে মোনালিসার ছবি সম্বলিত প্লেট কেনবার শেষ চেষ্টা করা। শেষ চেষ্টা এই জন্যে বললাম কারণ প্রথম দিন থেকে শুরু করে প্রতিদিন খুঁজেছি কিন্তু পাইনি, ওনার ভাগ্য ভালো শেষ চেষ্টায় আমি সফল।

প্যান্থিয়ন
প্যান্থিয়ন

ওখান থেকে এনামের বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন রাত প্রায় ৯ঃ৩০। ভেবেছিলাম খেয়ে একটু গল্প করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরব, তবে যথারীতি ঘুমাতে ঘুমাতে রাত আড়াইটা। পরদিন ভোরে উঠে তৈরি হয়ে গেলাম ফেরার জন্যে। সত্যি কথা বলতে বিগত তিনদিন এনাম যেভাবে আপ্যায়ন করেছে এটা কল্পনাতীত, বিশেষ করে বড় শহরে যারা থাকে তাদের জন্যে সময় বের করাটা সত্যি কষ্টসাধ্য। ওর কাজ বাদ দিয়ে সময় দেওয়া বা বাসায় আমার কমফোর্টনেসের দিকে সবসময় খেয়াল রাখা, এগুলো আসলে শুধুমাত্র আমাদের বাংলাদেশের কাছের বন্ধুদের পক্ষেই সম্ভব। ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাঁড়ে দ্যু ইষ্ট থেকে ফেরার ট্রেন ধরলাম, টীজিভি হওয়ায় ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিটেই আমার ট্রেন ভ্রমণ শেষ হয়ে গেল, আর সেই সঙ্গে পরিসমাপ্তি হল অসম্ভব সুন্দর একটা ট্রীপের।

পূর্ববর্তী পর্বঃ লুক্সেমবার্গ, বেলজিয়াম, নেদারল্যাণ্ড
পূর্ববর্তী উপপর্বঃ লুক্সেমবার্গ সিটি, ব্রাসেলস, রটারড্যাম, অ্যামস্টারডাম এবং একটি সারপ্রাইজ

পরবর্তী পর্বঃ পোর্তুগাল // উপপর্বঃ লিসবন, কাছকাইছ, সিন্ত্রা

mm

By Munshi Arif Rashid

জন্ম বাংলাদেশের ছোট্ট একটি মফঃস্বল শহর ফরিদপুরে, শৈশব-কৈশোর সেখানেই। জন্মেছি সাংবাদিক মুনশী হারুন-অর-রশীদ ও আফরোজা রাশীদ দম্পতির পরিবারে বড় দুই বোন জিতা ও তানিমের পরে। SSC ২০০২ সালে, এরপরে ঢাকা আসা, উদ্দেশ্য ঢাকা পলিটেকনিক ইনিস্টিটুটে কম্পিউটার কৌশল বিষয়ে পড়ালেখা। ২০০৬ সালে যখন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হল জ্ঞান কতোটুকু অর্জিত হয়েছে জানিনা তবে অসম্ভব কাছের কিছু বন্ধু অর্জন করতে পেরেছি। কিছুদিন MGH Group এ চাকরী করার পর bracNet এর চট্টগ্রাম অফিস এ যোগদান। এই সময় চট্টগ্রামে থাকা চার বছর আমার জীবনের সোনালি সময়। Southern University তে Electornics & Communication Engineering এ B.Sc করার সময় আজব কিছু ছেলের সঙ্গে পরিচয়। মজা করতে করতে কখন যে ওদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক তৈরি হল বুঝতে পারিনি। B.Sc শেষ করার পরে UITS এ MBA, সেখানেও কিভাবে কিভাবে যেন বেশ কিছু কাছের বন্ধু জুটে গেল। ২০১০ সালের শেষে মাছরাঙা টেলিভিশন থেকে যখন ডাক পেলাম আবারো ঢাকায় ফিরে এলাম। মাছরাঙা টেলিভিশন এর তথ্য প্রযুক্তি বিভাগে সহকারী ব্যবস্থাপক হিসাবে কাজ করার পাশাপাশি কাজ করেছি স্কয়ার গ্রুপের আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানে। শীর্ষে ওঠার সিঁড়ি মসৃণ ই ছিল, কিন্তু নিজের মনেই ভয় ছিল শীর্ষ পদে শক্ত পায়ে দাঁড়াবার মত বিদ্যার কিছুটা ঘাটতি আছে, তাই অনেক কঠিন হলেও ২ বছরের জন্যে সব ছেড়ে জার্মানি আসার সিদ্ধান্ত নেই। তারই প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাস থেকে জারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলোজিতে মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়ন করছি।

2 thoughts on “সাধ ও সাধ্যের ইউরোপ ভ্রমন/ পর্বঃ ফ্রান্স// উপপর্বঃ প্যারিস”
  1. […] বাসায় পোঁছালাম সন্ধ্যার কিছু পরে। ঐদিন রাতেই আবার ছিল লিসবন কাউচসার্ফিং গ্রুপের উইকলি মীটিং, কাফি যাবে না তাই আমি আর শাকিল রাতের দিকে বের হলাম কাউচসার্ফিং মিটিঙে অংশগ্রহণ করবার জন্যে। ওখানে গিয়ে পরিচয় হল পর্তুগীজ, ইতালিয়ান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। ভালোই আড্ডা চলছিল তবে কাফি বাসা থেকে বাড়াবার ফোন দিচ্ছিল খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে দেখে। তাই ১০টার দিকে সবার থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে গেলাম মামাদের বাসায়। বাসায় গিয়ে দেখি পুরো শাহী খানাপিনার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। পোলাও, বিরাট স্যামন ভাজি, রুইমাছ ভুনা, মুরগির রোষ্ট, গরুর মাংস, খাসির মাংস দিয়ে এলাহি একটা খাওয়া দিলাম। খাওয়ার পর কিছুক্ষণ আড্ডা দিলাম তবে পরদিন ভোরে আমাদের পোর্ত তে যাবার ফ্লাইট ধরতে হবে তাই ১২টার দিকেই শুয়ে পরলাম। পরদিন ৫টায় সবার থেকে বিদায় নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রার মাধ্যমে শেষ হল আমাদের লিসবন অভিযান। পূর্ববর্তী পর্বঃ ফ্রান্স পূর্ববর্তী উপপর্বঃ প্যারিস […]

Leave a Reply