জার্মান বাচ্চাদের স্কুল শুরু হয় খুব ভোরে, সকাল ৬টা থেকে ৮টার মধ্যে। ইংরেজি মাধ্যম আর মর্নিং শিফটের স্কুল বাদ দিলে বাংলাদেশের ছেলে মেয়েরা বলতে হয় অনেক আরামে স্কুলে যায়। প্রচন্ড শীতের দিনেও যখন সূর্য উঠে বেলা ১০টা ১১টায়, তখনও এই বরফমাখা ভোর সকালে পুরো শহরের স্কুল ঘেঁষা এলাকাগুলো বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামিচিতে ভরে উঠে।

খুব সকালে যেহেতু সাধারণ মানুষের যাতায়াত কম এবং শহরও তুলনামূলক ছোট, তাই আমার মত সাধারণ যাত্রীদের জন্য আর আলাদা বাস দেয়া হয় না। যাতায়ত করতে হয় স্কুল বাসেই। না, দেশের ছেলেমেয়েদের মত বাসে এরা বানর ঝুলাঝুলি করে স্কুলে যায় না। সবাই যার যার যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে, মানে মোবাইল, আইপড ইত্যাদি। এক এক জনের তাও অনেক দামি দামি যন্ত্রপাতি।

এক বাচ্চাকে দেখতাম সবসময় ব্যতিক্রম। তার কানে হ্যাডফোন থাকলেও চোখে ভারী চশমা লাগিয়ে একটা বুদ্ধিজীবী ভাব নিয়ে সবসময় বাসে দাড়িয়ে থাকত। অন্য বাচ্চাদের সাথেও খুব একটা কথাবার্তা বলত না। শুধু এদিক ওদিক উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকাত। আর আমার মত কালা বা বাদামী দেখলে তো চোখের পলকও ফেলত না। কি জানি হয়ত ভয়ে। আর না হয় ভাবত, মানুষ এত কালা কেমনে হয়। 😀

কাছে পেয়ে একদিন বাতচিত শুরু করলাম। আজাইরা প্যাঁচালে আবার আমার জুড়ি নাই। জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হে বাবু, হোয়াটস আপ ?”

দেশে হলে অবশ্য দুই গালে কিছুক্ষন টেনে জিজ্ঞাসা করতাম, কি বাবু তোমার নাম কি ? কে বেশি আদর করে ? বাবা নাকি মা?

দেশের পোলাপাইনদের এসব জিজ্ঞাসা করা ফরজ। না হয় ওরা রাগ করে 😀 । পরের দেশ বলে গাল টানলাম না। এদেশে নাকি এসব অঘোষিত নিষেধ; গাল টানাটানি, বাচ্চাকে কোলে নেয়া। নিজের মায়েরাও বাচ্চাকে কোলে নেয় না, গাড়িতে বসিয়ে ঠেলে।

তো বাতচিতের এক পর্যায়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তো বাবু স্কুলে কি কি পড়ায়? “।
বাবুর সহজ সরল উত্তর, “অংক, বিজ্ঞান, জার্মান, ইংরেজি ……।।”
আবার জিজ্ঞাসা করলাম, “কোনটা বেশি কঠিন লাগে তোমার ? ”

প্রথমে ভাবছিলাম, আমার মত গর্দভ হলে হয়ত বলবে সবগুলোই। কিন্তু না, অনেকটা অভিযোগের স্বরে সে বলল,
“জার্মান। জার্মান গ্রামার বেশি কঠিন।”

বাবুর উত্তর শুনে আমার আবেগে কান্দাইলাইছি অবস্থা। ইচ্ছা হচ্ছিল বলি, আয় বাবা বুকে আয়, একটু জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করি। ওরে বেটা তুই তো মায়ের পেট থেকে পড়ার পর থেকেই জার্মান শিখছিস, তোর এই ভাষা এত কঠিন লাগে। আর আমরা তো বরিশাল থেকে ঢাকা আসার মত প্লেনের পশ্চাদাংশ ধরে উড়ে উড়ে এসেছি, চিন্তা কর একবার আমাদের কেমন লাগে।

যাদের জানা নেই, জার্মান ভাষা অন্যতম কঠিন একটি ভাষা। প্রত্যেক কিছুর আলাদা লিঙ্গভেদ আছে এই ভাষায়। যেমন আপনার সামনের টেবিলটা পুংলিঙ্গ, তো এই ছেলে টেবিলটার উপর যেই বোতলটা রাখা সেটা হল স্ত্রীলিঙ্গ। আবার এই মেয়ে বোতলটাতে যেই পানি রাখা সেটা হল ক্লীবলিঙ্গ। বাংলায় কিন্তু টেবিল-টা, বোতল-টা, পানি-টা বললেই হয়। কিন্তু জার্মান ভাষার মত যদি বাংলায় বলতে হত তবে হয়ত বলতে হত তিনটা আলাদা আলাদা ভাবে। অনেকটা এইরকম; জনাব টেবিল, বেগম বোতল, খাসি পানি বা নিরেপক্ষ পানি 😀 ।

খুব একটা নিয়ম মেনে যে এই লিঙ্গভেদ হয় তা কিন্তু না, তাই মনে রাখা কঠিন। আবার বাক্যে Subject, Direct Object, Indirect Object,Plural ইত্যাদি অনুসারে এইসব পুংলিঙ্গ হয়ে যায় স্ত্রীলিঙ্গ বা ক্লীবলিঙ্গ; স্ত্রীলিঙ্গ ও ক্লীবলিঙ্গের ক্ষেত্রেও ঘটে একই। মানে জনাব হয়ে যায় বেগম, বেগম হয়ে যান খাসি, খাসি হয়ে যায় জনাব। একটা কঠিন অবস্থা।

এইবার বুঝেন তাহলে ঠেলা ………… 😀

mm

By Nayan Dhar

পড়েছিঃ Technische Universität Kaiserslautern তে। থাকিঃ Kaiserslautern, Germany তে।

One thought on “জনাব,বেগম, খাসি এবং জার্মান ভাষা”

Leave a Reply