জার্মানীতে আমার দুইবার দাঁতের মাড়িতে অপারেশন হয়েছে ৷ পুরোটাই বিনামুল্যে ৷ প্রথমবার অপারেশনের ব্যপ্তিকাল ছিল আনুমানিক বিঁশ মিনিট, পরের বার চল্লিশ মিনিট ৷ লোকাল এনেস্থেশিয়া দেয়াতে আমি সব কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম দাঁত ও মাড়ির মধ্যে কি পরিমান কাটা ছেড়া ঘষা মাজা হচ্ছে ৷

অবাক ব্যাপার হচ্ছে, ডাক্তারগন অপারেশন শেষ করে দাতের মাড়িতে তুলা গুজে দিয়েই বাসায় চলে যেতে বললেন ৷ এবং কোন রকম ওষুধপত্র ছাড়া! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এতবড় অপারেশন! কোন ওষুধ দিবেন না, এন্টিবায়োটিক? গ্যাস্ট্রিক? ব্যাথার ওষুধ? আমাদের দেশে আবার ব্যাথার ওষুধের সাথে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ৷ প্রেসক্রিপশনে সব সময় এরা পাশাপাশি ঘুমায় ৷ আমার পীড়াপীড়ি তে ডাক্তার আপা শেষে একটা মাত্র ইবুফ্লাম নামের ব্যাথার ওষুধ লিখে দিলেন ৷ আমি ভাবলাম এত ওষুধ খরা যদি জার্মানীতে চলে তাহলে এখানকার ফার্মেসী ব্যবসা কিভাবে চলছে ?

ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হবার পর কোন মেডিসিন রিপ্রেজেনটেটিভ ও দেখা গেলনা ৷ দেশে থাকতে দেখতাম চেম্বার থেকে বের হবার সাথে সাথে হাতে কালো সুটকেস গলায় টাই পড়া কিছু অসহায় ভদ্রলোক ছুটে চলে আসতো ডাক্তার কি ওষুধ দিলেন, তার কোম্পানীর ওষুধ দিলেন কিনা, সাথে প্রমান রাখতে চট করে মোবাইল টা বের করে প্রেসক্রিপশনের একটা ছবিও তুলে রাখেন ৷ মেডিসিন রিপ্রেজেনটিটিভদের দেখলে আমার আবার খুব মায়া লাগতো, শুধু রুটি রুজির জন্য নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নিজেদের বয়সের থেকে কম বয়সী ডাক্তারদের স্যার স্যার বলে তেল মারতো ৷ ডাক্তার গুলাকে ও দেখতাম খুব গম্ভীর ভাব নিয়ে সেই তেল মালিশ টা উপভোগ করতো ৷ তবে ঐসব অসহায় লোক গুলার কাছে তেল মেরে ওষুধ বেচার কাজ টা কেমন লাগতো বা কাজ টা তারা কেমন উপভোগ করতো আমার জানা নাই তবে আমার কাছে ব্যাপার টা বিশ্রি দেখাতো ৷ মনে হতো এর থেকে কষ্টের জব দুনিয়াতে নাই ৷ যদিও জার্মানীতে দেখেছি ডাক্তারদের কাছে এসব মেডিসিন রিপ্রেজেন্টেটিভদের কোন বালাই নেই ৷

এবার আসি মেডিক্যাল ডায়গনোসিস এর ব্যাপারে ৷ প্রতিটা ডাক্তারের চেম্বারের সাথেই প্রায় প্রয়োজনীয় সব রোগ ডায়াগনোসিস এর ব্যবস্থা থাকে ৷ তার জন্যেও রোগীর কোন আলাদা টাকা দিতে হয়না ৷ কাজেই দুষ্টু টাইপের ডাক্তারগন দুষ্টু হাসপাতাল মালিকের লাভ বাড়াতে হীন স্বার্থে রোগীর পকেট কাটতে পারেন না বা সেই সুযোগ থাকেনা ৷ জার্মানীতে মেডিকেল টেস্ট প্রায় সবটাই বিনা মুল্যে ৷ আমার দাঁতের মাড়ির অপারেশন এর পূর্বে কয়েকবার বিভিন্ন ভাবে মাড়ির এক্সরে নেয়া হয়েছিল, টেস্ট রিপোর্টের কোন হার্ড কপি নেই, সফ্ট কপি থাকতো ডাক্তারের কম্পিউটারে ৷ এ ধরনের টেস্ট রিপোর্ট রোগীর হাতে যাবার সুযোগ ই নেই ৷ ডাক্তারের নিকট আমার জন্য খোলা ফাইলে সব ধরনের ডায়াগনোসিস এর রিপোর্ট সংযুক্ত করা আছে ৷ আগামী দশ দিন পর অথবা এক বছর বা পাঁচ বছর পর ঐ ডাক্তার জীবিত থাকলে তার কাছে যাওয়া মাত্রই আমার নাম ও জন্ম তারিখ মিলিয়ে আমার সব তথ্য তিনি মিলিয়ে নিতে পারবেন ৷ একবার জ্বর নিয়ে হাউজ ডাক্তারের কাছে গেলাম, শরীর চেকআপ করে রক্তের কিছু নমুনা নিয়ে প্যাথলজি টেস্ট করা হলো, সবটাই ছিল বিনামুল্যে ৷ বাংলাদেশে এই টেস্ট গুলা করতে নিম্ন পক্ষে তিন হাজার টাকা লাগতো ৷

জার্মানীতে দোকান গুলা লক্ষ্য করেছি ৷ সুপার মার্কেট গুলা কাস্টমারে জমজমাট থাকলেও ফার্মেসী গুলা সবথেকে কাস্টমার শুন্য থাকে ৷ হোক সে সকাল, বিকাল অথবা সন্ধ্যা, কাস্টমার মাত্র দুই একজন থাকে কি থাকেনা ৷ সেলসম্যান গুলা অলস সময় পার করে ৷ কিছুদিন আগে দেশে গিয়েছিলাম মাত্র দুই মাসের জন্য, ওষুধের দোকান গুলো দেখে আমি হতবাক, মানুষ চাল ডাল মুড়ি বাতাসা কেনার মত করে ওষুধ কিনছে ৷ পাশের মুদি দোকান কাস্টমার পাচ্ছেনা হা করে বসে আছে কখন একটা কাস্টমার আসে অথচ ফার্মেসীতে এতটাই মানুষের ভিড় যে সামান্য একটা ওষুধ কিনতে হলে আধা ঘন্টা লাইনে অপেক্ষা করা লাগে ৷ আমার পরিচিত আত্মীয় স্বজন বাবা মা ভাই বোন সবাইকেই দেখেছি এরা চারভাগ পেটের পুরা একভাগই ওষুধ দিয়ে ভরে রাখে ৷ মাকে দেখতাম মাঝে মাঝেই বলতো, আজকে মাজায় ব্যাথার ডাইক্লোফেন বড়ি নিয়ে আসিস তো, গালের ভিতর ছুলে গেছে রিবোফ্লাভিন নিয়ে আসিস তো, দাঁতে ব্যাথা নুপ্রাফেন আর ফাইক্লক্স নিয়ে আসিস তো ৷ আমার মা অষ্টম শ্রেনী পাশ অথচ দীর্ঘ দিন ওষুধ সেবনের অভিজ্ঞতা পুজি করে জটিল জটিল দাঁত ভাঙ্গা সব ওষুধের নাম দিব্যি মুখস্ত করে ফেলেছে ৷

জনৈক এক রাজনীতিবিদ সেদিন তার এক ভাষনে বললেন সারাদেশে প্রতিটি মানুষের জন্য একজন করে ডাক্তার নিয়োগ করবেন ৷ ব্যাপার টা নিয়ে দেশে বিদেশে অনেক হাসাহাসি হয়েছে ৷ তাদের কাছে ব্যাপার টা অবাস্তব ও হাস্যকর মনে হয়েছে ৷ হয়তোবা অনেকে চোখ বন্ধ করে এভাবে কল্পনা করেছেন যে একটা হসপিটাল তার একটা ওয়ার্ডে ত্রিশ টা বেড প্রতিটা বেডে রোগীর শিওরে একজন করে ডাক্তার স্টেথিস্কোপ গলায় নিয়ে আর্মি সোলজারের মত তটস্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে ৷

আমি কোন রাজনৈতিক আলোচনা এখানে করবোনা ৷ প্রতিটা নাগরিকের জন্য প্রতি টা ডাক্তার সেবার ব্যাপার টা আসলে তেমন নয় ৷ উন্নত দেশ গুলাতে কিন্তু প্রতিটা নাগরিকের জন্যই একজন করে ডাক্তার নিযুক্ত করা আছে ৷ এর মানে এই নয় যে সেই ডাক্তার তার রোগীর চাহিবা মাত্র সেবা দেবার জন্য তটস্ত হয়ে রোগীর আশে পাশে ঘোরাঘুরি করছে ৷

জার্মানী তে প্রতিটা নাগরিকের জন্য একজন নির্দিষ্ট ডাক্তার নিয়োগ করা আছে ৷ এই ডাক্তার কে বলা হয় হাউজ ডাক্তার ৷ প্রতিটা রোগীর জন্ম থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত গুরুত্বপুর্ন সব রোগের বায়োডাটা ও রোগের ইতিহাস সব কিছু ডাক্তারের কাছে লিপিবদ্ধ করা রয়েছে ৷ যে কোন ছোট বড় সমস্যা অনুভব করলে প্রথমে এই ডাক্তারের সরণাপন্ন হতে হয় ৷ এই ডাক্তার গুলা সাধারনত মেডিসিনের ডাক্তার হয়ে থাকে ৷ প্রথমে ডাক্তারের কাছে যেয়ে রোগের সমস্যাজনিত কারন ব্যাখ্যা করার পর নিজে যদি সেবা দিতে পারেন তখন তিনি নিজেই মেডিসিন প্রেসক্রাইব করেন নতুবা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে সুপারিশ সহ পাঠিয়ে দেন ৷

জার্মানীতে প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য বীমা করা বাধ্যতামুলক ৷ এখানে যেসব চিকিৎসা সেবার কথা বিনামুল্যে বলা হয়েছে আসলে তার সবটাই পরিশোধ করে এই বীমা কোম্পানী ৷ সদ্য প্রসূত বাচ্চা শিশু থেকে শুরু করে বার্ধক্য জনিত মৃত্যুর দিন পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থবীমা থাকা আবশ্যক ৷ যদি কারো স্বাস্থ্য বীমা এক মাসের জন্যে ও স্থগিত থাকে, তার জন্য চাকরী করা কিংবা অন্যান্য নাগরিক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় ৷ জার্মানীতে মুলত দুই ধরনের স্বাস্থ্যবীমা কারী প্রতিষ্ঠান আছে, সরকারী ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান ৷ স্বাস্থ্য সেবা পাবার ক্ষেত্রে সরকারী প্রতিষ্ঠান ই বেশি নির্ভরযোগ্য ৷ একজন ত্রিশ অনূর্ধ্ব নাগরিক কে স্বাস্থ্যবীমা বাবদ প্রতিমাসে নব্বই ইউরো (আট হাজার টাকা) ও ত্রিশ উর্ধ্ব বা চাকুরীজীবী নাগরিক কে বীমা কোম্পানী ভেদে ১৬০ থেকে ১৮০ ইউরো প্রতিমাসে (চৌদ্দ হাজার টাকা) পরিশোধ করতে হয় তবে চাকুরীজীবী ব্যক্তির স্বাস্থ্যবীমা চাকুরীদাতা প্রতিষ্ঠান ই পরিশোধ করে থাকেন ৷ ফলে পরিশোধের দুঃশ্চিন্তা থাকেনা ৷ ব্যক্তিগত ইন্সুরেন্স আবার সস্তাতে মিলে, ত্রিশ ইউরো (আড়াই হাজার টাকা) থেকে আশি ইউরো (সাত হাজার টাকা) এর মধ্যেই থাকে ৷ তবে ঐ সস্তার তিন অবস্থা প্রবাদের মতই এদের সেবার মান ও ভালোনা ৷ স্বাস্থ্য বীমা প্রতিষ্ঠান তার কাস্টমার কে একটি ইন্সুরেন্স ডিজিটাল কার্ড প্রদান করে থাকে ৷ পরবর্তীতে যে কোন চিকিৎসা নিতে ডাক্তারের চেম্বারে কার্ড শো করলেই চলে, কম্পাউন্ডার কার্ড পাঞ্চ করেই বুঝতে পারে আমার নাম ঠিকানা সহ স্বাস্থ্য সেবা নেয়ার তালিকা ৷ শরীরের যাবতীয় রোগের জন্য বিনামুল্যে রোগীর চেকআপ ও রোগ ডায়াগনসিস করা হয় ৷ তবে স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে বীমা কোম্পানীর কিছু বিধি নিষেধ থাকে, যেমন শরীরের সৌন্দর্য বর্ধন জাতীয় কোন চিকিৎসার ভার এরা বহন করেনা ৷ যেমন নতুন দাঁত লাগানো বা দাঁতে বেস লাগানো বা দাঁত ইমপ্লান্ট করানো ৷

সবার জন্য সাধারন চিকিৎসা সেবা খুবই সাধারন ব্যপার মনে হলেও অনেক সময় জটিল ও দামী চিকিৎসা ও কিন্তু সম্পূর্ন বিনামুল্যে করার সুযোগ থাকে ৷ বাংলাদেশে যখন মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত পরিবার গুলোতে হঠাৎ করেই জটিল রোগ ধরা পরে, তখন ঐ পরিবারের সমস্ত সঞ্চয় টা ধ্বংসের পথে আগুয়ান হয়, চিকিৎসা কোথায় কিভাবে করবে, টাকা পয়সা কিভাবে যোগাড় করবে এসব নিয়ে হরেক রকম দুঃশ্চিন্তার মধ্যে থাকতে হয় ৷ অনেকে বিনা চিকিৎসায় মারা ও যায়, দীর্ঘদিন বিনাচিকিৎসায় অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতে হয় ৷ নিম্নবিত্ত মানুষদের বিপদ আরো চরম মাত্রায় পৌছে, এদের কে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয় ৷ চিকিৎসার খরচ যোগাতে রাস্তায় নামতে হয়, মানুষের কাছে হাত পাত তে হয় ৷ আজকে বাংলাদেশে এমন কোন ব্যবস্থা থাকলে হয়তো জটিল ও দামী রোগ গুলো নিয়ে মানুষের দুশ্চিন্তা করতে হতোনা ৷ সব পেশার মানুষের আয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে সব ধরনের চাকুরীজীবী, ব্যবসায়ী বা কৃষক সবার জন্য সরকারী ভাবে স্বাস্থ্য বীমা বাধ্যতামুলক থাকলে হয়তো মানুষ অসুখ বিসুখের সুচিকিৎসা নিয়ে ভাবতো না ৷ দুঃশ্চিন্তা ও করতে হতোনা ৷
(মাহবুব মানিক)

mm

By Mahbub Manik

Scientific researcher at Hochschule Merseburg and Ph.D. student at Martin Luther University of Halle-Wittenberg, Germany.

Leave a Reply