১)
আমি জার্মানিতে আসি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৭ তারিখ। টি.উ. ডর্টমুন্ড ভার্সিটিতে অটোমেশান এন্ড রোবটিক্সে মাষ্টার্স করতে। তখন জার্মানিতে আছে এমন দুইজন বাংলাদেশীকে চিনতাম শুধু। আমার ভার্সিটিতে তখন মাত্র একজন বাঙ্গালী ছাত্র ছিল। ডর্টমুন্ডের কাছের এয়ারপোর্ট যে ডুসেলডর্ফ সেটাও জানতাম না, তাই ফ্রাঙ্কফুর্টের ফ্লাইট নিয়েছিলাম। ফ্রাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টের সাথেই যে ট্রেন ষ্টেশান সেটাও জানতাম না। ফ্রাঙ্কফুর্টে এসে জেনেছি। কেউকেই চিনি না, তাই কেউ রিসিভ করতে আসেনি। লাগেজ নিয়ে বের হয়ে বাহিরে একটি দাড়ানো বাসে উঠে পড়লাম, এবং সেটা রেলষ্টেশানে নিয়ে গেল। সেখান থেকে ৯৬ ইউরো দিয়ে ICE ট্রেনের টিকেট কেটে ডর্টমুন্ডে আসলাম। ডর্টমুন্ডে ট্রেন থেকে নামার পর কোন দিকে যাবো বুঝতে পারছিলাম না। ডান দিকে, বাম দিকে কয়েকবার তাকালাম। এতদিন পরেও সেই দৃশ্যটি এখনও মনের ভেতর গেঁথে আছে। আমরা দুইজন এসেছিলাম বাংলাদেশ থেকে, একই কোর্সে পড়তে। তাই সামান্য একটু সাহস ছিল। বড় বড় লাগেজ নিয়ে ষ্টেশান থেকে বের হলাম। টেক্সী ড্রাইভারকে বললাম AO Hotel যাবো। আমাদেরকে বলল, হোটেলটি মাত্র ৩০০ মিটার দূরে। আমরা যেন হেঁটেই চলে যাই। বড় বড় লাগেজ নিয়ে ৩০০ মিটার যে এই দেশে সবাই হেঁটেই যাতায়াত করে জানতাম না। হেঁটে গেলাম এবং প্রতিরাত ৩০ ইউরো ভাড়ার সস্তাতম ঘর ভাড়া করলাম। তার কিছুদিন পর ভার্সিটিতে এক দক্ষিণ ভারতীয়কে ধরে আমরা দুইজন তার বাসায় উঠলাম, কম খরচে থাকার জন্য। সেখান থেকে পরে আমরা Soest (জোস্ট) নামক একটা গ্রামে বাসা পেলাম, ডর্টমুন্ড রেল ষ্টেশান থেকে জোস্ট ষ্টেশান পাক্কা ৬০ মিনিটের দূরত্ব। তখন জানতাম না যে জার্মানি উন্নত দেশ হলেও এত দূর থেকে কেউ ভার্সিটিতে আসা যাওয়া করে না। শীতকাল তখন, এবং সকাল ৮ টায় ক্লাস। জোস্ট থেকে প্রতিদিন ৬ টায় বের হতে হত। গ্রাম হওয়ায় বাস কানেকশান ছিল না ঘনঘন। এবং সন্ধা ৬টার পর সেখানে কোন বাস চলে না। বহুদিন প্রবল ঠান্ডার মধ্যেই জোস্ট ষ্টেশান থেকে বাসা পর্যন্ত ৪.৫ কিলোমিটার হেঁটে গিয়েছি। ভাষা বুঝতাম না, বড়ভাইও কেউ ছিল না যে আশে পাশের সবকিছু দেখিয়ে দিবে, দিক নির্দেশনা দিবে। জোস্টে একবার বাসে উঠেছি এবং বাস বার বার একই জায়গা দিয়ে যাচ্ছে দেখে সন্দেহ হল, তখন বুঝলাম যে আমি বাসের সর্বশেষ ষ্টশান পার হয়ে আবার একই জায়াগা দিয়েই ঘুরপাক খাচ্ছিলাম, আমার যেখানে নামার কথা সেখানে না নেমে। সবচেয়ে ভয়াভহ বিষয়টি ছিল, পড়ালেখা। ক্লাসে বেশীরভাগ বিষয়ই বুঝতাম না। পরীক্ষায় কি কি আসে সেই সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। কেউ ছিলও না যে সেই বিষয়ে ধারণা দিবে। যে বড়ভাই ছিল, তার জন্য বাংলাদেশ থেকে সিগারেট আনি নাই দেখে জার্মানিতে আসার কয়েকদিন আগে থেকে উনি সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। তাই পরীক্ষা পদ্ধতি, ক্লাসনোট বুঝা ইত্যাদি অন্যান্য সকল কাজে ভার্সিটিতে কেউকে পাইনি সাহায্য নেওয়ার জন্য। নিজেদের ক্লাসের ভারতীয় পাকিস্তানী এবং অন্য দেশের গুটি কয়েক জনই একমাত্র সম্বল ছিল, যারা নামে মাত্র সাহায্য করত (তাদেরও এর থেকে বেশী কিছু করার মত অবস্থা ছিল না, নতুন বিধায়)। জার্মানিতে আমার প্রথম পরীক্ষা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যাথ। প্রচুর পড়ালেখা করলাম। পরীক্ষার হলে এসে প্রশ্ন পাওয়ার পর দেখলাম একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারছিনা। শূন্য নম্বর পেলাম। আমার শিক্ষাজীবনের প্রথম ফেল ছিল সেটি। পরে যখন প্রফেসর খাতা দেখান এবং প্রশ্নগুলোর সমাধান করে দেন, তখন বুঝলাম যে আমার সারাজীবনের গণিতবিদ্যা দিয়েও এই পরীক্ষায় পাশ করা কঠিন হবে। পরবর্তীতে অনেক কষ্ট করে ম্যাথে ৩.৩ পাই। পাশ করেছি দেখে চোখে জল চলে এসেছিল, আক্ষরিক অর্থেই। প্রতিটা পরীক্ষার প্রথম এটেম্ট দিতাম প্রশ্নপত্র নিয়ে ধারণা নেওয়ার জন্য। প্রথম এটম্টেই পাশ করেছি এমন কোন সাবজেক্টের নাম ঠিক মনে পরে না। প্রথম এটেম্ট এর পরীক্ষাগুলো হত সেমিষ্টারের ক্লাসগুলো শেষ হওয়ার সাথে সাথেই। বাংলাদেশের PL এর মত কোন বন্ধ ছিল না। প্রথম এটেম্ট এর পরীক্ষাগুলো দেওয়ার ১ মাস পর দ্বিতীয় এটেম্টের পরীক্ষা শুরু হয়। সেই একমাসকে PL হিসেবে ধরে নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেও নাম মাত্র কিছু গ্রেড নিয়ে পাশ করি আস্তে আস্তে। পুরো কোর্স শেষ করতে আমার ৩ বছর ৯ মাস লাগে। কোন রকম পথপ্রদর্শক ছিল না, কেউ কোনদিন বলে দেয়নি কি করা উচিত, কি না করা উচিত। কিন্তু থেমে থাকি নি, ভুল করে এবং ভুল থেকে ক্রমাগত চরম চরম শিক্ষা নিয়ে নিয়েই ৩ বছর ৯ মাসে শেষ করেছি মাষ্টার্স কোর্স ২,৬ গ্রেড নিয়ে।
ভার্সিটিতে মাষ্টার্স থিসিস না করে ফ্রনহফারে থিসিসের কাজ করেছি। ভার্সিটির নিজের ফ্যাকাল্টির কোন প্রফেসর আমার থিসিস সুপারভাইজর হতে রাজি হননি। একে একে ১২ জন প্রফেসর আমাকে রিজেক্ট করেছেন। তবুও হাল ছাড়িনি, এবং ১৩ তম জন ফ্রনহফারে আমার থিসিস শুরু হওয়ার ৭ মাস পর ইমেইল করে জানিয়েছেন যে তিনি রাজী। সেই থিসিসে আমি ১৭ মাস সময় নিয়ে অনেক খাটা খাটুনি খেটে, একদম নতুন একটি কনসেপ্ট দাঁড়া করিয়েছিলাম, যা আমার ভার্সিটির প্রফেসরকে অনেক খুশী করেছিল। যন্ত্রকৌশলে ব্যচেলর পড়ে, মাষ্টার্সে এসে ইলেক্ট্রিক্যাল ফ্যাকাল্টির অধীনে রোবটিক্সের সকল থিওরি পড়ে, অনেক কষ্টে হাতে পায়ে পড়ে রাজী করানো কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের MIT থেকে পড়ে আসা সিনিয়র প্রফেসরের অধীনে এক্সটারনাল মাষ্টার থিসিসের কাজে মেশিন লার্নিং ও কম্পিউটার ভিসন প্রযুক্তি দিয়ে বর্তমানে ব্যবহৃত সবচেয়ে কঠিনতম প্রোগ্রামিং ভাষা C++ ব্যবহার করে সফটওয়ার ডিজাইন করেছি। আমি জানতামও না যে C++ সবচেয়ে কঠিনতম ভাষা, কেউ বলেনি, তবুই নিজের প্রচেষ্টায় শিখেছি। ফ্রনহফারের সুপারভাইজার আমার থিসিস পেপার ৬ বার রিভিও করিয়েছে, মারাত্মক রকমভাবে কাটাছেঁড়া করেছেন, ৪ মাস লাগিয়েছেন ফাইনালাইজ করতে, ১২১ পাতার মাষ্টার থিসিস লিখিয়েছেন আমাকে দিয়ে। কিন্তু সবই করেছি।
২)
এতকিছু বলার একটি উদ্দেশ্য আছে। আমার বন্ধুবর রাসেল। সে ২০১১ সালের ১১ই জুলাই বিসাগ গ্রূপটি খুলে, যা বর্তমানে জার্মান প্রবাসে নামে সুপরিচিত। আমি আসার আনুমানিক ২ মাস আগেই সে জার্মানিতে এসেছিল এবং এই গ্রূপটি খুলেছিল নি:স্বার্থভাবে সকলকে সাহায্য করে যাওয়া এবং একটি শক্তিশালী এলামনাই গঠনেের স্বপ্ন নিয়ে। গত ৬ বছর ধরে অনেক চড়াই উৎরাই এর ভিতর দিয়ে সে এবং তাঁর নি:স্বার্থ এই দলটি প্রচন্ড পরিশ্রম করে জার্মান প্রবাসেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এবং সেই ‘ছোট্ট’ একটি পদক্ষেপের কারনে আজকে হাজারো বাংলাদেশী ছাত্রছাত্রী জার্মানিতে পড়তে আসছে। কিভাবে জার্মানিতে পড়ালেখার জন্য এপ্লাই করতে হয় এবং কি কি ডকুমেন্ট লাগে ও সেগুলো কিভাবে জোগাড় করতে হবে, এমনকি কিভাবে ব্যক্তিগত মোটিভেশান লেটার লিখতে হয় সেরকম ছোটখাট বিষয়েও এই ব্লগে পুঙ্খানুপুঙ্খ ও বিস্তারিত তথ্যাদি রয়েছে। এখন মোটামুটি সবাইকেই এয়ারপোর্টে থেকে রিসিভ করা হয়। লাগেজও টেনে নেওয়া হয়। দেশে থাকা অবস্থাতেই জার্মানিতে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, জার্মানিতে এসে বাসা খুঁজে দেওয়া হয়। জার্মানিতে আসার আগে কি কি শপিং করতে হবে বলে দেওয়া হয়। বিভিন্ন সাবজেক্টগুলো কিভাবে পড়তে হবে সেবিষয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গাইড দেওয়া হয়। আগের বছরের ক্লাসনোট, পরীক্ষায় কি কি এসেছে সেগুলাের ধারণা দেওয়া হয়। পার্টটাইম জব খুঁজতে সাহায্য করা হয়। জার্মানিতে এসে কিভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো কিনবে, কোথায় সস্তা এবং ভালো জিনিষ পাওয়া যাবে সেগুলো সম্পর্কে বলা হয়। এমনকি জার্মানিতে আসার পর তাদেরকে নিয়ে বিভিন্ন যায়াগায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়, আড্ডাবাজি হয়, খেলাধুলা হয়, পার্টি ও খাওয়াদাওয়া হয়, পিকনিকও হয়। মাষ্টার থিসিস নিয়ে আলোচনা করা হয়, কোন টপিক নিলে ভাল হবে, কোনটা কঠিন কোনটা সহজ হবে, কোন প্রোগ্রামিং ভাসা শিখা উচিত, কিভাবে থিসিস পেপার লিখতে হবে সেই সকল বিষয়ে সহযোগীতা করা হয়। সর্বোপরি, পাশ করার পর কিভাবে জব খুঁজতে হবে, কিভাবে কাভার লেটার এবং সিভি লিখতে হবে বলা হয়। এমনকি, ভালোভাবে ও সততার সাথে বড় ভাইদের সাথে যোগাযোগ রাখলে জবও পাইয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করে দেওয়া হয়! এবং সবচেয়ে উল্লেখজনক সেবাকার্যটি হচ্ছে, বাংলা ও ইংরেজীতে জার্মান ভাষা শিক্ষা, যেটি আমার দৃষ্টিতে পুরস্কার পাওয়ার মত একটি কার্যক্রম। যারা B2 জার্মান লেভেল পর্যন্ত করেছেন, তারা বোধকরি সেটি স্বীকার করবেন অনায়াসে। এবং এর সুফল হচ্ছে, আমার কোর্সে এক বছর পরে আসা ছোটভাইটিকে মাত্র ১টা সাবজেক্টে দুইবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে, বাকিগুলোতে সে তার প্রবল পরিশ্রম দিয়ে প্রথম প্রচেষ্টাতেই পাশ করেছে এবং অবশেষে ২,১ গ্রেড নিয়ে মাষ্টার্স কোর্স সুসম্পন্ন করেছে।
এবং এসকল কিছুর পিছনেই রয়েছে বন্ধুবর রাসেলের সেই ‘ছোট্ট’ একটি পদক্ষেপ, এবং পরবর্তীতে জার্মান প্রবাসে পরিচালনা মন্ডলীর নি:স্বার্থ ও অক্লান্ত পরিশ্রম, এবং আমার আপনার মতই ছোট বড় মানুষগুলোর অজস্র অভিজ্ঞতাপুষ্ট লেখা।
প্রথমার্ধে লেখা আমার ঘটনাটি শুধু আমারই জীবনের লেখা। কিন্তু আমার সমসাময়িক যারা ছিলেন, আমি জানি যে তাদেরকেও অনুরূপ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই জার্মানীতে সংগ্রাম করতে করতে এগিয়ে যেতে হয়েছে। “জার্মান প্রবাসে” ব্লগটি তাই তাদের সকলের সংগ্রামের একটি সফল পরিপক্ক ও সুমিষ্ট ফল। এবং এসকল সংগ্রাম মুহূর্তের মধ্যেই মধুর মনে হয় যখন একজন আগামী ছাত্রের ছোট্ট কিন্তু মারাত্মক একটি কমেন্ট চোখে পরে: “And that blog GermanProbashe is the Wikipedia for studying in Germany.”
জার্মান প্রবাসের সকল সদস্য, পরিচালক মন্ডলী ও শুভানুধ্যায়ীদেরকে জানাই প্রাণঢালা অভিনন্দন।
লেখক:
শাওন সূত্রধর
মাষ্টার্স ইন অটোমেশান এন্ড রোবটিক্স, টি.উ. ডর্টমুন্ড ইউনিভার্সিটি, জার্মানি
বর্তমানে পি.এইচ.ডি. গবেষণারত,
মেশিন লার্নিং এন্ড কম্পিউটার ভিসন রিসার্চার ইন বায়োমেডিক্যাল ইম্যাজিং,
ডিপার্টমেন্ট অফ কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অফ আ করুনা, স্পেন