২০১৭ সালের জানুয়ারী মাসের শেষের দিনের কথা- বাংলাদেশী এক ছাত্র নাকি জার্মানির এক হাসপাতালে ভর্তি, তাকে দেশে পাঠানোর জন্যে অর্থের প্রয়োজন। এমনি এক কথা কানে আসে আমার যার থেকে ঘটনার শুরু। একদিনের মাঝে সকল তথ্য হাতে আসলো নানান জনের কাছ থেকে। এক পর্যায়ে যা জানা যায় তার সারমর্ম এই দাড়ায় যে সুজন চন্দ্র সরকার নামের এই ছাত্র যে কিছুকাল আগেও বিদেশে যাবার বিষয়ে আমাদের বাংলাদেশী স্টুডেন্ট এন্ড অ্যালুমনি এসোসিয়েশন এর ফেইসবুক গ্রুপে পোস্ট দিতো, সেই আজকে হামবুর্গের এক হাসপাতালে। তার কথা বলার ক্ষমতাও আর বাকি নেই কেবলমাত্র মানুষ চিনতে পারে এবং ইশারা দেয়। আমার দাদুভাই এর মৃত্য আমার সবথেকে কাছ থেকে দেখা ১৯৯৩ সালে, তারপরে আর কোনো মৃত্যু আমি কাছ থেকে দেখিনি আর জানিও না কি করতে হয়। নানুভাই এক বছর আগে চলে গিয়েছে আমাদের ছেড়ে, বিদেশে থাকার সুবাদে শেষ দেখা পাইনি তার। বিদেশে যেখানে আমাদের নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের নিয়ম কানুন নিয়েই আমরা ব্যস্ত থাকি তার মাঝে এমন একজন মুমূর্ষু রোগীকে কিভাবে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে আমার জানা ছিলনা। হাসপাতালে খোজ নিলাম, হাসনাইন (ব্রেমেনের ছাত্র) সুজনের খবর রাখছিল তাই তার কাছ থেকেও খবর নিয়ে বাস্তবতা মানতে হলো- সুজনকে এই অবস্থায় দেশে পাঠানো সম্ভব নয় এবং শরীরের যে অবস্থা তাতে বেশিক্ষণ তাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে। শরীরের ইন্টারনাল অর্গানগুলো ফেইল করা শুরু করেছে ততদিনে। একবার ভাবলাম যাই একটু দেখে আসি কিন্তু পরে ভাবলাম, এমন অবস্থায় দেখলে মানসিকভাবে দূর্বল হয়ে যাব। অবস্থা সামাল দিতে হলে মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে, দরকার মতন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।


হাসনাইনের মুখে সুজনের শেষ দিনগুলোর স্মৃতিচারণ

জার্মান প্রবাসে এবং ব্রেমেনের ছাত্রদের সাথে কথা বলে তড়িঘড়ি করে খোজ নেয়া হলো খরচাপাতি কত পরতে পারে তার বাজেট। সেই বাজেট মতন পোস্ট দেয়া হলো বিসাগ গ্রুপে এবং জার্মান প্রবাসে ওয়েবসাইট এ। আমরা অনেকেই আমাদের নিজেদের মাসের খরচটা রেখে বাকি টাকা নিয়ে তৈরী ছিলাম অবস্থা সামাল দেবার জন্যে। গ্রুপের পোস্টে সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল তিনদিন এর মাঝে দান যা আসবে তাই দিয়ে ব্যাপারটা সামাল দিতে হবে। একদিন পরে সুজন কোমাতে চলে যায় সেই সাথে আমাদের কাজের পরিধিও বাড়তে থাকে। এর মাঝে নানান অচেনা মানুষের ফোন আসতে থাকে সমগ্র জার্মানি থেকে, যে যার সাধ্যমতন তথ্য দিয়ে সাহায্য করা শুরু করে। CLS কম্পিউটার নামের এক প্রতিষ্ঠান থেকে কল আসে, এই কোম্পানির সিংহভাগ চাকুরে বাংলাদেশী এবং মালিকও বাংলাদেশী। কর্ণধার দেওয়ান সফিকুল ইসলাম সুজনকে দেশে পাঠাবার সব দ্বায়িত্ব গ্রহন করেন এবং বলেন একজন বাংলাদেশী ছাত্রের দেহ দেশে যাবে তার খরচ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এমন আশ্বাসের মাঝ দিয়ে আমাদের চিন্তা কিছুটা হলেও লাঘব হয়। মাঝে দুইটা দিন সাপ্তাহিক ছুটি থাকার কারণে আমরা জানতেও পারি না সর্বমোট কত টাকা হাতে আসবে এবং কতজনই বা দেবে।


প্রফেসর ডাক্তার মীর নজরুল ইসলাম

এর মাঝে শনিবার ভোর চারটার দিকে হাসপাতাল থেকে ফোন আসে সুজনের শেষ নিঃশাস ত্যাগের খবর নিয়ে। আমরা কাল বিলম্ব না করে সবাইকে টাকা দেয়া বন্ধ করে দিতে বলি এই চিন্তা করে- হাতে এখন আর বাড়তি টাকা নিয়েও কোনো লাভ নেই। যা আজকে সকালের মাঝে হাতে আসবে তাই দিয়েই সুজনকে পাঠাতে হবে। এর মাঝে এক ছাত্র জার্মানি থেকে যোগাযোগ করে পররাষ্ট্র মন্রী, এম.ডি. শাহরিয়ার আলম এম.পির সাথে যার কারনে আমার কাছে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ফোন আসে। যদিও এমন তথ্য আসে যে সরকার থেকে সমস্ত খরচ বহন করা হবে এবং এই মতে দূতাবাস থেকে আবেদন এবং খরচের রশিদ ও চাওয়া হয় যার কোনো উত্তর আর কখনো পাওয়া যায়নি। কারন খুবই সাধারন, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে এমন খাতে কোনো বাজেট বরাদ্দ কখনো ছিলনা এবং থাকবারও কথা নয়। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, এই ব্যবস্থা বাংলাদেশী প্রবাসী শ্রমিকদের জন্যে প্রযোজ্য, তবে গুজব রটাতে আমাদের বেশ ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। এমন কথাও শুনতে হয় যে আমরা লাভের দিকই দেখি, সব জায়গা থেকে টাকা তুলেছি। বেশ কজন বাংলাদেশী ছাত্র পাসপোর্ট সংক্রান্ত কাজে বাংলাদেশ দুতাবাসে গিয়েও রিসিপশন থেকে শুনে আসে- দুতাবাস নাকি আমার মারফত জার্মান প্রবাসেকে লাশ পাঠাবার খরচ দিয়েছে। আমি নিয়মিত দুতাবাসের নানান অনুষ্ঠানে যাবার পরে এই কথা হলফ করে বলতে পারি- এই গুজবের জন্যে নিম্ন পদস্থ কর্চারীরা ছাড়া অন্য কেউ দায়ী নয়। দুতাবাসের নামে অনেক গুজব থাকলেও বর্তমান দুতাবাসের কর্মকর্তাদের বিষয়ে আমি সুনাম ছাড়া আর কিছু বলার কারন খুঁজে পাইনি।


সবুজ চন্দ্র সরকার, সুজনের বরভাই

এক সময় উনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক অফিস থেকেও রশিদ চাওয়া হয় যায় প্রতিউত্তর কখনো আর পাওয়া যায়নি। তথাকথিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীও দাবি করে বসে- তাদের জনৈক নেতা বিষয়টি দেখছেন এবং সামলাচ্ছেন। বার্লিনে বসবাসরত জনৈক বাংলাদেশী সাংবাদিকও দাবি করে বসেন- দূতাবাসের সব সিস্টেম তিনি করে দিয়েছেন। আমরা সাধারন পড়ুয়া ছাত্র যারা না আছি রাজনীতিতে, না আছি মিডিয়াতে- এই সবের মাঝেই জার্মান অফিস গুলো থেকে সুজনের মরদেহের দায়িত্ব কাধে তুলে নিতে ব্যস্ত। কতিপয় মানুষ আমাদের হয়ে নানান স্তরে প্রতিবাদের ঝড় তোলেন, কিসের রাজনৈতিক নেতা আর কিসের সংবাদ দাতার দূতাবাসে আনাগোনা কোনো কিছুই ধোপে আর টেকেনি। তথাকথিত মুরুব্বিদেরও আমরা প্রয়োজনের সময় পাইনি তবে আমাদের বিশ্বাস ছিল, আমরা নিজেরাই সামাল দিতে পারব। সুজনের লাশ এর রিলিজ নেয় হাসনাইন হ্যামবুর্গ থেকে রওনা করিয়ে দেয় ফ্রাঙ্কফুর্টের উদ্দেস্যে যেখান থেকে প্লেনে ঢাকা আসবার কথা। আমাদের চিন্তা শেষ হয় না, লাশ প্রথম ফ্লাইট এ পাঠানো সম্ভব হয় না। এর মাঝে সুজনের ঢাকার বন্ধুরা আম্বুলেন্স ম্যানেজ করে বসে আছে, ঢাকা এয়ারপোর্টে এয়ারপোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট এবং ওয়েজ আর্নার বিভাগের কর্মকর্তাও অপেক্ষায় আছেন যাতে মরদেহ দ্রুত ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা যায় তার জন্যে। অবশেষে সুজন দেশে ফেরে, বাড়িতে শেষকির্ত্য সম্পন্য হয়।

মাননীয় মন্ত্রী, আসাদুজ্জামান নূর

আমাদের হিসাবের খাতা খুলে বসা হয়, দাতাদের দানের হিসাব করতে গিয়ে যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না! বাংলাদেশ থেকে ২২ জন দাতা এবং ইউরোপ থেকে ৪৭২ জন যার সিংহভাগ জার্মানিতে বসবাসরত। এই সর্বমোট ৪৯৪ জন দাতার নাম আমাদের হিসেবের তালিকায় রয়েছে যাদের বিবরণ জার্মান প্রবাসের ওয়েবসাইটে দেয়া আছে। এই অর্থ থেকে সুজনের দেহ বাংলাদেশে পাঠাবার সমস্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে, জার্মানিতে সুজনের নামে যে সকল দেনা ছিল তা শোধ করে দেয়া হয়েছে। সুজনের একাউন্ট এ যে টাকা ছিল তা তার বাবার কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। সর্বপরি অবশিষ্ট অর্থের সম্পুর্নটা সুজনের মায়ের নাম ১০ লক্ষ টাকার পারিবারিক সঞ্চয়পত্র, যা থেকে আগামী বছরগুলোতে বাবা-মায়ের খরচের টাকা আসবে এবং ২ লক্ষ টাকা চেকরূপে অর্পন করা হলো বাবা-মায়ের প্রয়োজনে ব্যায় করবার জন্যে। এছাড়াও বেশকিছু অর্থ জার্মানীতে সুজনের ধারদেনা শোধ করবার জন্যে বরাদ্দ করা হয়েছে। সুজনের জন্যে যে অর্থ সগৃহিত হয়েছিল তার কোন অংশ জার্মান প্রবাসের সাথে সশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি কোন খাত বাবদ রেখে দেয়নি, সম্পুর্ন টাকা কেবল সুজনকে পাঠানো, তার জার্মানিতে থাকা ঋণ (যা শোধ না করা হলে কিছু দেশী-বিদেশী ছাত্র বিপদে পরতে পারতো) এবং বাবা-মায়ের মাসিক খরচের পেছনে ব্যায় করা হয়েছে।

১১ই অক্টোবর, ২০১৭ র এই স্মরণ সভায় আগত সকলকে জার্মান প্রবাসের তরফ থেকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। সেই সাথে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় মন্ত্রী, আসাদুজ্জামান নূর এমপিকে আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি মন্ত্রনালয় থেকে সার্বিক সহযোগিতা করবার জন্যে, তথাপরি আমাদের সময় দেবার জন্যে। সেই সাথে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি বিশিষ্ট শিক্ষক ডাক্তার পবিত্র দেবনাথ স্যারকে আমাদের বিশেষ অতিথীর আসন গ্রহণ করবার জন্যে। সেই সাথে আমার বাবাকে এবং মাকে যাদের সাহায্য ছাড়া ঢাকায় এমন একটি আয়োজন করা প্রায় অসম্ভব ছিল। সেইসাথে সুজনের পরিবারের কাছে আজ আমরা তুলে দিচ্ছি আমাদের মাঝে বেচেঁ থাকা লক্ষ-কোটি সুজনকে তাদের নিজের সন্তান হিসেবে।

কিছু কথা বিশেষভাবে না লিখলে কথাগুলো বাকি থেকে যায় তাই বলা। আমরা জার্মান প্রবাসে প্লাটফর্মে যারা নিয়মিত কাজ করি তারা কেবলমাত্র মনের তাগিদে দেশের মানুষের জন্যে কাজ করি। কখনো নিজের পেটের তাগিদে বা নিজের নামের জন্যে কাজগুলো করি না। নিঃস্বার্থ কাজের মূল্য আপনি/আপনারা যদি নাও দিতে পারেন অন্তত অসম্মান আমাদের কাম্য নয়। তাই এই রিপোর্টের শেষে জার্মান প্রবাসে টিমের তরফ থেকে এই কথা বলেই শেষ করতে চাই-

তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?

আরো পড়তে চাইলে

খবর ২

খবর ৩

পর্দার অন্তরালে সুজনের স্বজন

সুজনের জন্যে আপনারা

সুজন এবং আমাদের পথচলা আপনাদের ভরসায়

‘হায়! জীবন এত ছোট কেনে’

mm

By Tanzia Islam

Tanzia Islam is an admin of BSAAG, learn german and Germanprobashe.com this is a volunteer work from her side for the Bangladeshi community. She is also an admin of Free Advice Berlin. Her volunteer activities are related to educational development, city development and environmental protection. Tanzia is a freelance writer and researcher. Currently she is a doctoral researcher at Technical University of Berlin.

3 thoughts on “সুজনের পাশে “জার্মান প্রবাসে””
  1. Got emotional , Bangladeshis are always sign of humanity !! Once again it has been proved , when all Bangladeshis are together , nothing is impossible to win !! Respect to all of your efforts # German Probashe ..

  2. […] করেছে তা তুলনাহীন। এখানে সেই লিংকঃ http://www.germanprobashe.com/archives/15393 ভ্রান্তি স্বাভাবিক, সেই ভ্রান্তি […]

Leave a Reply