কর্মজীবনে পদার্পন করাটা আমাদের অনেকের জন্যই একটা বিভীশিখাময় ব্যাপার। ছাত্র জীবনের সেই মধুমাখা, নিশ্চিন্ত জীবন শেষ করে মিটিং, প্রেজেন্টেশন, ক্লায়েন্ট হ্যান্ডেলিং এর মত গুরুদায়িত্ব হুট করেই যখন ঘাড়ে এসে পড়ে তখন জীবনটা বড়ই বিস্বাদ লাগে! কর্মজীবনের সবচেয়ে বাজে সমইয়টা হল এর প্রথম কয়েকটা মাস, এই সময়টা সবকিছু শিখে পড়ে নেওয়ার সময়, ভূল ভ্রান্তি যা আছে সব কিছু ঠিক করে নিয়ে একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার সময় । অনেকই কর্মজীবনের এই কঠিন সময়টা খুব সাচ্ছন্দেই পার করে ফেলেন কারন তারা পুরোপুরি কর্মজীবনে পদার্পন করার আগেই বিভিন্ন কর্পোরেশন অথবা অর্গানাইজেশনে খন্ডকালের জন্য শিক্ষানবিস বা ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করে নিজস্ব আগ্রহের বিষয়ের উপরে ব্যাবহারিক অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকেন। ইন্টার্নশীপ বা শিক্ষানবিস হিসেবে কোন কম্পানি বা সংগঠনে ৩ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত কাজ করার বেশ ভাল সুযোগ রয়েছে দেশে এবং বিদেশে ।
আমি আপনাকে মূলত জার্মান সরকার কর্তৃক প্রদপ্ত এমনি একটা ইন্টার্নশিপের কথা জানাব যেটায় চূড়ান্তভাবে মনোনীত হলে আপনি জার্মানি গিয়ে যে কোন জার্মান অর্গানাইজেশনে শিক্ষানবিস বা ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করতে পারবেন । এই ইন্টার্নশীপের সময় হবে সর্বোচ্চ তিন মাস এবং এই সংক্রান্ত আপনার সকল খরচ বহন করবে জার্মান সরকার।
প্রতিবছর জার্মান সরকার তাদের এই Cross Cultural Internship Programme (CCP) এ দুই থেকে তিনজন বাংলাদেশীকে (কর্মজীবনে স্থায়ী হয়েছেন অথবা কোন অর্গানাইজেশনের সাথে দীর্ঘদিন স্থায়ী সেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন এমন ব্যক্তিকে ) আমন্ত্রন জানায় জার্মানিতে পছন্দের কোন অর্গানাইজেশনে ইন্টার্নশিপ করার জন্য। এই স্কলারশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে জার্মান সরকার আপনার যে সকল খরচ বহন করবে তা হল – জার্মানিতে যাওয়ার জন্য ভিসা এপ্লিকেশন এবং প্রসেসের সকল খরচ, বাংলাদেশ থেকে জার্মানিতে যাওয়া এবং জার্মানি থেকে দেশে ফিরে আসার প্লেনের টিকিটের খরচ, জার্মানিতে থাকা অবস্থায় আপনার বাড়ি ভাড়া,ইন্সুরেন্স এবং ট্রান্সপোর্টেশন খরচ, প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট অংকের টাকা দিবে হাতখরচ বাবদ এবং ইন্টার্নশীপ চলাকালিন সময়ে বিভিন্ন ওয়ার্কশপে যাওয়া/আসার খরচ। ইন্টার্নশিপ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য নিচে জানিইয়ে দিচ্ছি…
১) আবেদন করার যোগ্যতা –
এই ইন্টার্নশীপে আবেদন করা্র জন্য IFA এবং জার্মান সরকার কিছু শর্ত দিয়ে দিযেছে সেগুলো নিম্নরূপ-
ক) আবেদনকারীর বয়স ২৩ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে হতে হবে।
খ) বর্তমানে ছাত্র অবস্থায় থাকলে তার আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থা আবেদন করা যাবেনা, পড়া শেষ হতে হবে।
গ) বাংলাদেশের কোন সংস্থায় স্থায়ী কর্মকর্তা অথবা স্থায়ী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
ঘ) ইংরেজী ভাষায় দক্ষ হতে হবে , জার্মান ভাষা জানাটা প্রয়োজনীয় নয় তবে জানলে ভাল।
ঙ। দেশের বাহিরে ২/৩ মাস থাকার মত শারীরিক এবং মানুষিক সুস্থতা থাকতে হবে।
এই সম্পর্কে আরও জানতে এই ওয়েবসাইটে ভিসিট করতে পারেন – http://www.ifa.de/en/funding/crossculture-programme/programme-information/applicants-from-abroad.html
২) যে সব বিষয় হতে ইন্টার্নশীপ করার সুযোগ রয়েছে –
মূলত , Politics, Society & Education, Human Rights & Peace Building, Sustainable Development and Media & Culture এই কয়েকটি ফিল্ডে যারা কাজ করছেন তারা ২০১৮ সালে সিসিপি ইন্টার্নশীপের জন্য আবেদন করতে পারবেন । প্রতি বছর এই বিষয়গুলো পরিবর্তন হয় তাই IFA এবং জার্মান এম্বাসির ওয়েবসাইট দেখে তার পরে নিশ্চিত হয়ে আবেদন করা উচিত।
৩)সিসিপি প্রগ্রামের আবেদনের নিয়ম ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র –
সাধারনত প্রতি বছরের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত জার্মান এম্বাসি সিসিপি প্রোগ্রামের জন্য আবেদনপত্র গ্রহন করে। এই বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের জন্য আবেদনের শেষ তারিখ ১২ ই জানুয়ারি। ২০১৭ সালে আমরা যখন এপ্লাই করেছিলাম তখন আমাদের জার্মান এম্বাসির ওযেবসাইট থেকে আবেদনপত্র ডাউনলোড করে, সেটা পূরন করে, প্রিন্ট করে, আবেদনপত্রে সই করে আবার সেটা স্ক্যান করে এমেইলের মাধ্যমে জার্মান এম্বাসি ঢাকায় পাঠাতে হইয়েছিল।
২০১৮ সাল থেকে IFA এর ওযেবসাইটে গিয়ে তাদের অনলাইন আপ্লিকেশন পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে আপ্লাই করতে হবে। এপ্লিকেশন করার সময়ে তাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া মোটিওভেশন লেটার এবং রেকমান্ডেশন লেটারের টেমপ্লেট ডাউনলোড করে সেগুলো পূরন করে, সিগ্নেচার করে, রেকমান্ডেশন লেটারে উর্ধতন কর্মকর্তার সিগ্নেচার নিয়ে, পুনোরায় পোর্টালে আপলোড করতে হবে। সেই সাথে আপনার একটা জার্মান ভিসা স্টান্ডার্ডের ছবি এবং সিভি আপলোড করতে হবে।
এসব রিকুযারমেন্টস প্রতি বছরই কিছুটা পরিবর্তন হয় তাই সব সময় IFA অথবা জার্মান এম্বাসির ওযেবসাইটে গিয়ে রিকুযারমেন্টগুলো নিশ্চিত হওয়া উচিত। এই সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এই ওয়েবসাইটায় পেতে পারেন – http://www.ifa.de/en/funding/crossculture-programme/programme-information/faqs.html
আবেদন করতে হবে এই পোর্টালে – https://ifa-portal.rexx-recruitment.com/job-offers-initiative.html
৪) সিলেকশন প্রসেসের বিস্তারিত-
সিসিপি প্রোগ্রামের সিলেকশন IFA এবং জার্মান এম্বাসি বাংলাদেশ মিলে করে। আপনার আবেদন প্রথমে জার্মান এম্বাসির কাছে পৌছালে তারা IFA এর সাথে মিলে সেটা জাচাই বাছাই করে যদি আপনাকে তাদের যোগ্য মনে হয় তাহলে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকবে অথবা স্কাইপে ইন্টারভিউ নিবে। ইন্টারভিউয়ের পরে আপনাকে যোগ্য মনে হলে তারা আপনাকে প্রাথমিকভাবে সিলেক্ট করে আপনার নাম এবং বিস্তারিত তথ্য পাঠাবে জার্মানিতে তাদের ফেডারাল ফরেন অফিস বা পররাষ্ট্র মন্তনালয়ের অফিসে। তারা আরও জাচাই বাছাই করার পরে তাদের সিদ্ধ্যান্ত জানাবে জার্মান এম্বাসি এবং IFA কে। ফেডারাল ফরেন অফিস থেকে গ্রিন সিগনাল পেয়ে গেলেই আপনি সিসিপি প্রোগ্রামের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত হবেন।
৫) অর্গানাইজেশন নির্ধারন-
আপনি কোন অর্গানাইজেশনের সাথে ইন্টার্নশীপ করবেন সেটা আপনি নিজেই ঠিক করতে পারবেন। চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়ে গেলে, আপনার পছন্দের অর্গানাইজেশনের সাথে আপনি নিজেই সিসিপি স্কলারশিপের কথা বলে ইন্টার্নশীপের ব্যাপারটা নিশ্চিত করে নিতে পারবেন। সেটা সম্ভব না হলে আপনার পছন্দের অর্গানাইজেশনের নাম IFA কে জানিয়ে দিলে তারাই সেই অর্গানাইজেশনের সাথে যোগাযোগ করে আপনার ইন্টার্নশীপের ব্যাবস্থা করে দিবে, তবে সেই অর্গানাইজেশনের সাথে আপনার ইন্টার্নশীপের টপিক এবং আপনার পূর্ব কর্মঅভিজ্ঞতার মিল থাকতে হবে। যদি আপনি নিশ্চিত না থাকেন যে কোন অর্গানাইজেশনের সাথে আপনি আপনার ইন্টার্নশীপ করতে চান, তাহলে সেটা IFA কে জানালে তারা আপনার সাথে পরামর্শ করে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা, পড়াশোনা এবং আপনার ইন্টারেটের উপরে ভিত্তি করে অনেকগুলো অর্গানাইজেশন সম্পর্কে আপনাকে ধারনা দিবে, আপনি তার মধ্যে থেকে আপনার পছন্দের অর্গানাইজেশন নির্ধারন করতে পারেন ইন্টার্নশীপ করার জন্য।
৬) সিসিপি ইন্টার্নশীপ করার সুবিধাসমূহ-
এই ইন্টার্নশীপ শেষে আপনি সম্পূর্ণ একটা নতুন মানুষে পরিণত হবেন! দেশের বাহিরে কাজের অভিজ্ঞতা হবে আপনার, সেই সাথে বেশ বড় অংকের একটা টাকা পাবেন প্রতি মাসে, যা দিয়ে ইউরোপের কয়েকটি দেশ ভ্রমনও করে আসতে পারেন। সর্বোপরি, জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম লেখা থাকবে ইন্টার্নশীপ শেষে IFA প্রদপ্ত সার্টিফিকেটে, এইটাই বা কম কিসের!
সরকার সামিরা জান্নাত (সেতু)
কিল, জার্মানি
—————————–
আরো পড়তে পারেনঃ
আমি বর্তমানে ইউরোপিয়ান কমিশন ঢাকা অফিসে কর্মরত এডমিন এন্ড ফাইনান্স অফিসার হিসেবে। এই কোর্স এর করার পরে জার্মানিতেই কি জব করতে পারব? জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
বা জার্মানিতেই চাকরি করার কি কোন সুযোগ আছে?