চুয়েটে ব্যচেলর পড়েছিলাম মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে , তবে বেশিরভাগ কাজ ছিল অটোমেশান নিয়ে, ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে। যদিও ফ্লুইড মেকানিক্স ছাড়া মেকানিক্যালের বাকি সব ফিল্ড যেমন হিট, পাওয়ার প্লান্ট, ক্যাড ও ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স, ম্যাটেরিয়াল ইত্যাদি সকল বিষয়েই আমার বেশ আগ্রহ ছিল। তবে রোবট নিয়ে আগ্রহটা একটু বেশীই ছিল। জার্মানিতে এসে রোবটিক্স নিয়ে পড়লেখা করলাম ইলেক্ট্রিক্যাল ফ্যাকাল্টির অধিনে, কিন্তু থিসিস করলাম কম্পিউটার সায়েন্সের টপিক কৃত্তিম দৃষ্টি বা আর্টিফিশিয়াল ভিশন নিয়ে। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে আমার আগে থেকেই আগ্রহ ছিল, কিন্তু পড়ার সুযোগ হয়নি।
দেড় মাসের একটু বেশী হতে চলল আমি আমার পিএইচডি প্রোগ্রাম শুরু করেছি। কম্পিউটার সায়েন্সের একটি বহুল প্রচলিত বিষয় কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স নিয়ে আমার কাজ। আমার রিসার্চ গ্রুপের নাম “প্যাটার্ন রিকগনিশান এন্ড আর্টিফিশিয়াল ভিশন গ্রুপ”। ফ্যাকাল্টি অফ ইনফরমাটিক্সের অধিনে কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের বিশাল বড় বিল্ডিংয়ের ভিতরে একটি ঘরে বড় বড় হাই কম্পিউটিং জি.পি.ইউ. বিশিষ্ট অনেকগুলো কম্পিউটার দিয়ে সাজানো একটা ল্যাব। এই ল্যাবে আমরা ৭ জন কাজ করি। তাদের মধ্যে দুই জন পি.এইচ.ডি. করছে আর দুই মাষ্টার্স থিসিসের কাজ করছে। দুইজন ব্যাচেলর থিসিসের কাজ করছে।
ব্যাচেলর থিসিস করছে আমার কলিগ প্লাসিডো – এর সাথে আমার বেশি সখ্যতা। গত দেড় মাস তার সাথে কথাবার্তা বলে নিজেকে নাম্বার ওয়ান ফুল মনে হচ্ছে। ব্যাচেলরে পড়েই সে ১০টির বেশি আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স অ্যালগরিদম ইম্প্লিমেন্টেশান করে ফেলেছ, সে ভাইরাস প্রোগ্রামিং করে বানায়, এবং আরও কত কিছু যে করছে! আমি তাই পারতপক্ষে আমার পি.এইচ.ডি. কলিগদের সাথে টেকনিক্যাল কথা বলতে যাই না, যদি আমার ভিতরের সদরঘাট সব প্রকাশ হয়ে যায় এই লজ্জায়!
গত সপ্তাহে প্রথম টেকনিক্যাল মিটিং করলাম, আমার সুপারভাইজর দের সাথে, রিসার্চ টপিক নিয়ে আলোচনা হল। বলা বাহুল্য যে, অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই আমি তাদের কথাবার্তার কিছুই বুঝি নাই। আমার তিনজন সুপারভাইজর প্রফেসর বেচারাগন বোর্ডে লিখতে লিখতে পুরা বোর্ড কালো করে ফেলল, তবুও আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকে নাই! তারপর সবচেয়ে জুনিয়র প্রফেসর আমাকে “প্লে-গ্রুপের” ছাত্র পড়ানোর মত ‘কোলে পিঠে’ বসিয়ে বুঝানো শুরু করল। অনেকক্ষণ পর গিয়ে আমার মাথায় কিছু ঢুকলো অবশেষে! আমার এহেন করুন অবস্থা দেখে আমার প্রফসর আমাকে একটা বই দিল পড়তে। তার মতে, এই বইয়ের ভাষা নাকি একদম সোনামনিদের অ আ ক খ টাইপের, তবে ডিপ লার্নিং নামক আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স অ্যালগরিদমের উপর লেখা একটি বই। আমার জন্য বুঝতে নাকি সুবিধা হবে!
আমার কাজ হবে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ডেভেলপ করা। হাই রেজুলেশান ইমেজ নিয়ে কাজ। সেজন্য স্পেশালাইজড গ্রাফিক্স কার্ড যুক্ত মাঝারি মানের হাই কম্পিউটিং কম্পিউটার দিয়ে যায় আমাকে। গত এক সপ্তাহ সেই কম্পিউটারে শুধু লিনাক্স সেটআপ করা এবং আমার কাজের জন্য প্রোগ্রামিং লাইব্রেরীগুলো ইনস্টল করার মত সহজ কাজগুলো করতেই আমার মত ‘দক্ষ’ রিসার্চাারের সব সময় চলে যায়! তাই, পরবর্তী মিটিংয়ে প্রফেসরকে কি বলব সেই ছুতো হাপিত্যাশ হয়ে খুজঁছিলাম। ইউটিউব ঘেঁটে কয়েকটা শর্টকাট ভিডিও দেখে কিছু রাশভারী কথা ঠাডা মুখস্ত করে নিলাম। খাতার মধ্যে বাংলায় নোট করে রাখলাম। পরবর্তী মিটিংয়ে এইগুলাে বলে বুঝাতে হবে যে আমি খুব ভাল করেই সব কিছু বুঝছি!
আজ আবার মিটিং হল। জুনিয়র সুপারভাইজর আজকে ‘ডিনয়েজিং এনকোডার’ নিয়ে বললেন। আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি কি শুনেছি নাকি এই নাম। আমি এই জন্মে এই প্রথম শুনলাম এই নাম। মাথা নাড়িয়ে বললাম যে, আমি জানি না। তবে একটু ভাব নিয়ে মাথা নাড়ালাম। তারপর সে আরও কয়েকটা টপিকের নাম বলল। বলা বাহুল্য সেগুলোর নামও আমি এই জন্মে কেন, আগের জন্মেও শুনেছি কিনা মনে মনে ভাবছিলাম। আমার ভাব নেওয়াও তাই শেষ হয়ে গেল! আমার অবস্থা দেখে বেচারা প্রফেসরের মুখ লাল! সে তখন সমগ্র বোর্ড জুড়ে আকাঁআকি করে ম্যাট্রিক্স, নিউরলাল নেটওয়ার্ক দিয়ে হাবিজাবি যা কিছু পারলো সব একেঁই বুঝানোর চেষ্টা করল আমাকে। কিন্তুু তার সেই ড্রয়িংগুলো আমার কাছে প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় করা গ্রাম বাংলার সুদৃশ্যমান প্রাকৃতিক ছবির মতই লাগল! তবে আমি বিজ্ঞের মত মুখে মুচকি হাসি দিয়ে মাথা নেড়েই যাচ্ছিলাম। এমন কঠিন ভাব নিচ্ছিলাম যেন সবই বুঝি। একটু পর পর নোট করার ভান করে খাতায় বাংলায় হাবিজাবি সব শব্দ লিখছিলাম, যাতে কি লিখছি সেগুলো তাদের চোখে পড়লেও যেন বুঝতে না পারে!
ও আরেকটা কথা, গত সপ্তাহে দেওয়া বইটার এক পাতাও পড়ার সুযোগ হয়নি। তবুও একটু ভাব মারার জন্য বইয়ের মধ্যে স্টিকি কাগজ দিয়ে বুকমার্ক করে রাখলাম কিছু পাতা। যাতে প্রফেসর বেচারা রাতে একটু ভালো ঘুমাতে পারে এই ভেবে যে এটলিস্ট বইটা পড়ে কিছু বুঝছে!
এভাবেই চলছে, আমার পি.এইচ.ডি. শিক্ষা!
লেখক : শাওন সূত্রধর
বর্তমানে পিএইচডি করছেন,
ইউনিভার্সিটি অব আ করুনা, স্পেন