হাসপাতাল বাস
বাংলা সিনেমার বড়লোকদের দেখতাম সকালবেলা নাইটড্রেস পরে পাউরুটিতে বাটার লাগাচ্ছে। ব্রেড বাটার আর জেলি এইগুলো খেতে আবার স্পেশাল চাকু লাগে। গত সাতদিন এই একি জিনিষ এর চক্র পুনরাবৃত্তি করে সকাল দুপুর রাতে খেতে খেতে গোলক ধাঁধাই আটকে গেছি।
সকাল না রাত মনে করতে পারছিনা। সপ্তম দিন বাদে আজকে মোবাইলে ইন্টারনেট লাগিয়ে দিয়েছে এক বন্ধু যাতে দিন রাতের দিশা পায়, আমি মোবাইল এ ইন্টারনেট ইচ্ছে করেই রাখিনা যাতে সারাক্ষণ টুংটাং করে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়।
সেদিন বিকেলবেলা এই একি খাবার খেয়ে দুপুরবেলা একটু ঘুমিয়ে গিয়েছি মাত্র। এরপর রুটি আর আলুভাজি খাচ্ছি এই স্বপ্ন দেখলাম। রুটি বা ভাত কার্বোহাইড্রেট এবং আলুও কার্বোহাইড্রেট, বাঙালী খাবার, খুব বাজে কম্বিনেশন ওজন বাড়ার জন্য।কিন্ত ঘুম ভেংগে রুটি আর আলুভাজির জন্য কেমন যেন হাহাকার শুরু হয়ে গেল। একটু পরে দেখি একজন আপা মাছের ঝোল আর পাতাকফি ভাজি করে নিয়ে এসেছেন দেখতে। মনে হল বহুবছর পরে দুটো ভাত খেলাম।
হাসাপাতাল বাস, প্রথম রাত
প্রথম দিনে তো জর তীব্রব্যথা আর টেনশন এ খেতেই পারিনি। এককাপ চা আর আধখানা বিস্কুট আর ওষুধ নাকেমুখে গুঁজে সকালবেলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেছি। সকাল সাড়ে এগারোটাই হাউজ ডাক্তার এর কাছে এপয়েনমেন্ট কিন্তু সময় আর কাটেনা। আগে আগেই বেরিয়েছি।
ডাক্তার আমার চেহারা দেখে আতকে উঠলেন। এতো এন্টিবায়োটিক এ কোন কাজই হচ্ছেনা উল্টো বেড়ে যাচ্ছে ইনফেকশন। তিনি আর অপেক্ষা না করে নিজেই টেলিফোন নিয়ে বসলেন ডার্মাটোলজিস্ট এর খোঁজে। নাহ কেউ সিরিয়াল দেবেনা। জার্মান দেশে মরার আগেও সিরিয়াল নিয়েই ডাক্তারবাড়ি যেতে হয়। তবে বড় বড় শহরের এই হাল কিন্তু ছোট শহর হলে হয়ত দেখা মেলে। শেষমেষ এক হাসাপাতাল এর জরুরীতে ঠাই মিলল।
টিকেট কেটে বাসে-ট্রেনে অনেকটা পথ হেটে গিয়ে হাসাপাতাল এর ঠিকানা মিলল। শেষ পথটুকু হেটে হেটে খুঁজে পেতেই মনে হল শান্তি। কিন্তু জার্মান দেশের হাসপাতাল এর জরুরী বিভাগ ঢাকার জ্যামে আটকে আছে। এই দেশে বাস- ট্রেন আসতে এক মিনিট এদিক ওদিক হয়না। এক দু মিনিট দেরী হলে ঘোষণা আসে আগেই। ইউনিভার্সিটিরর ভর্তি, ব্যাংকে একাউন্ট খোলা মুহুর্তে হয়ে গিয়েছিল দেখে সন্দেহ লেগেছিল হয়েছে তো সব ঠিকঠাক? ঢাকা ভার্সিটিরর ভর্তির গোলকধাধা পেরিয়ে এসেছি তো, রেজিস্টার বিল্ডিং, টিএসসির ব্যাংক এর লাইন, শামসুন্নাহার হল, ডিপার্টমেন্ট এতো গুলোতে ঠাই দুদিন দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ভর্তি হতে, যাক সে-সেসব। এই দেশে সব কাজ বিদ্যুৎ বেগে হলেও হাসপাতাল এর জরুরী বিভাগ এ ঠাই দাঁড়িয়ে পাক্কা চারঘণ্টা। এরপর ভর্তি হলেও রুমের সামনে বসে আরো দুইঘন্টা! সন্ধ্যা ৬ টার দিকে রুমের দেখা পেলাম।
সারাদিন আর খাওয়া হয়নি। টেবিলে এ দেখি দুপিস শক্ত ব্রাউন ব্রেড, বাটার জেলি আর চাকু। একপিস একটু জোর করে খেয়ে নিতেই ডাক্তারদের ডাক্তারি শুরু হল আরো দুঘণ্টা পরে। সিরিঞ্জ গুঁজে গুঁজে আট-দশ রকম রক্ত টেনে টেনে বের করে নিলো। আমি এইসব রক্ত, সিরিঞ্জ, সুই এমনিতে ভয় পায়। গলা শুকিয়ে আত্মা আর দম পিঠে আটকে গেলো। অতি সুদর্শন ডাক্তার এবার ইঞ্জেকশন, এন্টিবায়োটিক আর স্যালাইন পুশ করা শুরু করলো একেএকে।
এবার মনে হল রবীন্দ্রনাথ আর ছুটি গল্পের ফটিক এর কথা। সেই ফটিক মা, দিদি ছেড়ে শহরে মামার বাড়ি এসেছিল পড়তে কিন্তু সেই ব্যামো। ফটিক এর ছলছল চোখের জলের কথা মনে এলো, তার ঘুড়ি লাটাই সব পড়ে রইল গ্রামে। এই সব ভাবতে ভাবতে সুই এর ব্যথায় কেঁদে উঠে বললাম, উহ না!
ডাক্তার বলল, না?!
আমি ভেবেছি ডাক্তার খুব রাগ হবে। ছোটবেলায় সিদ্দিক ডাক্তার আর জাহাঙ্গীর ডাক্তার বাড়িতে আসতেন পেনিসিলিন ইনজেকশন দিতে, টনসিল ইনফেকশন করেছিল। আমি ভয়ে লুকিয়ে থাকতাম। অনেক খোঁজাখুঁজি করে আমাকে মা, ফুফু একরকম ধরে বেধে নিয়ে ইনজেকশন দিতেন, আমার গগনবিদারী চিৎকার উপেক্ষা করেই। সিদ্দিক ডাক্তার কে দেখলেই ভয় লাগতো, ডাকাত মনে হত ব্যাটাকে।
কিন্তু এই ডাক্তার আমাদের বয়সি হবে। আমার ব্যথা লাগছে দেখে ছেড়ে দিয়ে অন্যহাতে আবার পুশ করলো। ঢাকার ক্যান্সার হাসাপাতালে আমার বড় ভাইয়ের ছেলেটার কেমোথেরাপির চিতকার কানে এসে লাগতে আমার ব্যথা কমে আসলো।
রাতে দশটার দিকে ঘরে দিয়ে গেলো। তখন ওষুধপাতি কাজ করা শুরু করেছে। ব্যথ্যার তীব্রতা কমে এসেছে একটু। আর ক্ষুধা পেয়েছে মনে হল। ঘরের সেই এক খানা ব্রেড খুঁজতে গিয়ে দেখি নেই। সিস্টার ট্রে ফেরত নিয়ে গেছে ভেবেছে আর খাবো না।
জার্মানিতে রাত দশটা মানে গভীর রাত। এতো রাতে খাবার কিভাবে পাবো?! ক্যান্টিন এতোক্ষণে বন্ধ। আমার আবার লো- প্রেশার, মাথা ঘোরা শুরু হয়ে গেছে। বুঝলাম দানাপানি পেটে না,পড়লে আর রাতে ঘুম হবেনা। লজ্জার মাথা খেয়ে বাঙালী এক ভাই কে কল দিলাম।
ভাগ্য ভালো তিনি আশেপাশেই মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন।
বললাম, ” ভাই আমি হাসপাতালে খাবার তো ফেরত নিয়ে গেছে সারাদিন ব্যথায় খেতে পারিনি মাথা শুন্য হয়ে যাচ্ছে। দুটো খাবার কোথা পাই?”
এরপর তিনি কোথা থেকে এক টার্কিশ দোকান খুঁজে পেলেন। ভাত, আলু আর মুরগীর তরকারী নিয়ে এলেন। তিনি আর একজন বাঙালী ভাই গেটে এসে বললেন,”গেট তো বন্ধ ভিজিটিং আওয়ার শেষ।”
আমি বললাম, “আমি নিচে গেটে এসে নিয়ে যাচ্ছি।”
প্রথম দিনে নিজে থেকে আর কাউকে কল দেওয়ার ইচ্ছে, শক্তি-সামর্থ্য কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। শুধু ডরমিটরি থেকে অতি সহৃদয়া একজন নিজে থেকে কল দিয়ে এই কাঠখড় পেরিয়ে এর মধ্যেই দেখতে এসেছিল তাও ভিজিটিং আওয়ার রাত আটটার মধ্যে চলে গেছে । আমার সাথে থাকলেন আটাত্তর আর ছিয়াশি বছর বয়স্কা দুইজন জার্মান ভদ্রমহিলা, প্রচণ্ড সাহসী, আত্মবিশ্বাসী। এনাদের দেখে মনে কিছু ইতিবাচক চিন্তা আর সাহস সঞ্চয় হল।
এরপর সেই ভাত খেয়ে শুরু হল এই দূর-পরবাসে হাসাপাতালের প্রথম রাত্রিযাপন!
স্টুটগার্ট বাড কান্সটাট ক্রাংকেন হাউজ