আগের পর্বঃ হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-পাঁচ
পা বাড়ালাম বটে, কিন্তু পা বড্ড ভারী ঠেকল। এগোতে চাইল না যেন। ভাবলাম, একবার পেছন ফিরে দেখি লতা ঠিক মত রাস্তা পেরোতে পারল কিনা। কিন্তু সে তো ‘ভাঙে, তবু মচকায় না’ গোছের মেয়ে। অন্তত এতক্ষনের পরিচয় থেকে যেটুকু বুঝেছি। ক্রাচ নিয়ে রাস্তা পার হওয়া লতার কাছে হাতের তুড়ি। ঠাশ্ করে আমাকে চড় মারার আগে যেমন তুড়ি বাজিয়েছিলো, তেমন তুড়ি। মনে হতেই হাত চলে গেলো গালে। কি শক্তি দিয়ে মেরেছিলো বাপস্। এখনো যেন জ্বলছে। কিন্তু, আশ্চর্য, অপমানে না। অন্য কিছুতে। ধরতে পারছি না। ধরতে পেরে কাজ নেই। নিজেকে কষে বকা দিলাম, “হুরর্ অনিক মিয়া, বেশি ন্যাকামি হচ্ছে। পুতুপুতু আউট। শিনা টান ইন। আগে বাড়ো, জওয়ান। লিঙ্কস-রেখস্ট, লিঙ্কস-রেখস্ট, লেফট-রাইট, লেফট-রাইট।“
পা চালাতে চালাতে মনে মনে সকালে কাজের যে একটা ফর্দটা করেছিলাম, সেটাকে ডাকলাম। ডাকামাত্র আলাদিনের চেরাগ ফুরে দৈত্যের মত ইয়া লম্বা চওড়া এক লিস্টি বেড়িয়ে এল। বেয়াড়া রকম বেড়ে যাওয়া চুল কেটে কদম ছাঁট করা, সাত দিনের দাড়ি কামিয়ে তিন দিনের দাড়িতে নামিয়ে আনা, গোটা তিনেক ফর্মাল শার্ট কেনা, সাথে ক’টা স্যান্ডো গেঞ্জিও, বাংলাদেশী দোকানে গিয়ে কাজলী মাছের জন্যে হানা দেওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি মামুলি কাজের সুদীর্ঘ তালিকা। মনে মনে তাতে চোখ বোলাচ্ছি।
বাধ সাধল বাঘ আকৃতির এক জার্মান শেফার্ড। ফুটপাথের সমান্তরালে সাইকেলের জন্যে রাখা সরু লেন দিয়ে তার মালিক ফুরুফুরে মেজাজে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। আর শেফার্ড। সাহেব কেশর ফুলিয়ে ফুটপাথ দিয়ে ছুটছে তার পিছু পিছু। চোখে পড়ল, কুকুরটার মুখে মাজল্ পড়ানো। মানে এখনো ঠিক নতুন মালিকের বশে আসে নি পুরোপুরি। ঘ্যাক্ করে কামড়ে দেবার আশংকায় এই ব্যাবস্থা। কালো আর ঘিয়া মেশানো এই প্রকান্ড প্রানিটাকে দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। দৌড়ানোর ভেতর এক ধরনের বন্যতা আছে।
কিন্তু, একি! কুকুরটা যেন খুব ক্ষেপে গিয়ে এলোপাথাড়ি ভঙ্গীতে ছুটে এসে আচমকা ধাক্কা দিয়ে প্রায় গায়ের ওপরে উঠে যাচ্ছে। ধাক্কা খেয়ে আমি লাটিমের মত বাঁই বাঁই করে বারকয়েক ঘুরপাক খেয়ে দেয়াল ধরে কোনমতে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে কুকুরটা অস্ফুট গর্জন তুলে সাঁই সাঁই করে নেই হয়ে গেছে। জার্মান শেফার্ড বলে কথা। তার উপর আবার আধা-পোষ মানা। যাক বাবা, খুব বেঁচে গেছি। ঘাড় মটকে দেয় নি, এই বেশি।
চকিতে কি যেন মনে হল। অতিন্দ্রিয়ের মত কিছু একটা কাজ করল বোধ হয়। পেছন ফিরে তাকাবো-তার আগেই ঠন্ করে ধাতব কিছু আছড়ে পড়ার শব্দে অজানা আশঙ্কায় জমে গেলাম। মুহূর্তের অসাড়তা কাটিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলাম, লতার ক্রাচ উড়ে গিয়ে মাঝ রাস্তায় পড়েছে। আর কুকুরটা দূরে বিন্দু থেকে বিন্দুতর হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর…আর, লতা এলোমেলোভাবে ফুটপাথে পড়ে আছে। নিঃসাড়। একটা হাত প্রায় রাস্তার ওপরে। কোনকিছু না ভেবে নিজের অজান্তেই লতা বরাবর ছুটতে লাগলাম। সিগনাল লাল কি সবুজ, জানি না। হঠাৎ বিশাল একটা ট্রাকের শেষ মুহূর্তের প্রচন্ড ব্রেকের তুমুল আর্তনাদে থমকে দাঁড়ালাম। ঘ্যাচচচ্ …!
(চলবে), ২৭.১০.১৮, –ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকারঃ মিউনিখ, জার্মানি