মুঠোফোন বেজেই যাচ্ছে। আগের দিনের অ্যানালগ ফোনের ক্রিং ক্রিং সুরে। মনে হচ্ছে ওপাশ থেকে কেউ আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নম্বর চাপছে। এমন প্রাগৈতিহাসিক রিং টোন দিয়ে রাখার অপরাধে আমি লতার হয়ে ফোনটা ধরলাম না। তা ছাড়া, মনে হচ্ছে ফোনের ভেতর ঝামেলা আছে। আজকে এমনিতেই অনেক বিপদ-আপদ গেছে। এখন ফোন ধরে খাল কেটে আর কুমির না আনলেও চলবে।

কিন্তু ভালো লাগছে না। লতার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু দুশ্চিন্তাটা কমেছে আগের চেয়ে। সেখানে এসে হানা দিয়েছে প্রচণ্ড খিদে আর ক্লান্তি। এরা একসঙ্গে সিন্দাবাদের ভূতের মতো কাঁধে জেঁকে বসেছে। বাসায় গিয়ে হট শাওয়ার নিয়ে একটা ডিম ভেজে আর এক গ্লাস দুধ গিলে ঘুমিয়ে থাকব। এ ছাড়া, কিছু নেইও ঘরে। তাতে কিছু আসে যায় না। ডিম-দুধই খেয়ে নেব হালুম করে। তারপর ফোঁস ফোঁস ঘুম। মাঝে মাঝে নাক ডাকা মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে পাশের ঘর থেকে ভ্লাদিমির ঠকঠক করে পলকা দেয়ালে আপত্তির টোকা দেয়। আমি বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য না করে পাশ ফিরে বালিশ কানে চেপে বিপুল বিক্রমে নাক ডাকা চালিয়ে যেতে থাকি। ভ্লাদিমির কোন ছাড়, স্বয়ং ভ্লাদিমির পুতিনও আমাকে জ্বালিয়ে সুবিধা করতে পারবে না। কোথায় রক্ত গরম রয়্যাল বেঙ্গল আর কোথায় রাশিয়ার হোৎকা সাইবেরিয়ান টাইগার! তুলনাই চলে না।

এই হাসপাতাল খুব পুরোনো। কারুকাজ করা অনেক উঁচু ছাদ আর সাবেকি আমলের কাঠের মেঝে। রাজবাড়ি রাজবাড়ি গাম্ভীর্য আছে। সিঁড়ি ভেঙে নামছি আর মচমচ করে শব্দ হচ্ছে। প্রায় সদর দরজার কাছে চলে এসেছি। ধাক্কা লাগল কারও সঙ্গে। অন্যমনস্ক ছিলাম হয় তো। ভালো করে চোখ তুলে তাকাতে দেখি এক তরুণী হাতের ফোনটায় ডুবে এলোমেলো হাঁটছে। আমি দুঃখিত বলতে যাওয়ার আগেই পকেটে লতার ফোন আবার বেজে উঠল। সামনের মেয়েটাও দেখি ঠোঁট কামড়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোনটা কানে ধরল। ধাঁধায় পড়ে গেলাম। এই মেয়েটাই ফোন করছে নাতো? লতার বন্ধু হয়তো। আবার এক হাতে ধরা সাদা অ্যাপ্রনটা বলে দিল যে, সে এই হাসপাতালেরই ডাক্তার কিংবা নার্স। তফাৎটা ঠিক বুঝতে পারি না আমি। যাক, অতি চিন্তা করে লাভ নেই। রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। আগস্টে হিরের কুঁচি ছড়ানো রাতের আকাশে সুকান্তের চাঁদ উঠেছে। সেই আলোয় অতিপ্রাকৃত লাগছে চারপাশ। রাত অনেক গড়িয়ে গেছে। বাস-ট্রামের আশা না করে হেঁটেই যাব ভাবছি। মিনিট বিশ-পঁচিশেক লাগবে বড় জোর। কোনো ব্যাপার না।

বাঁধ সাধল লতার অস্থির ফোন। বেজেই চলছে আর বেজেই চলছে। ফোন হাতে নিয়ে ইতস্তত করছি। ধরতে যাব, অমনি রিং থেমে গেল। কয়েক সেকেন্ড বাদেই ভেসে উঠল খুদে বার্তা, ‘লতা, কই তুমি? আমি ডিউটিতে। শিগগির কল দাও। প্লিজ, প্লিজ।—লিওনি’। তাহলে তখন দরজার কাছে ধাক্কা লাগল যে, সেই কী এই লিওনি? ডাক্তার কলিগ কিংবা বন্ধু? লতার দুর্ঘটনার খবর কী তার বন্ধু জানে? নাকি নতুন কোনো অঘটনের খবর জানাতে লতাকে খুঁজছে মেয়েটা? হাঁটতে থাকা মানুষ যেমন কেউ নিঃশব্দে পিছু নিলে ঠিকই টের পেয়ে যায়, তেমন সতর্ক হয়ে গেলাম। তারপর লিওনি নামের ওপর আঙুল টিপে অপেক্ষায় থাকলাম। আর কখন যে উল্টো ঘুরে আবার হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম, বলতে পারব না।

লিওনি লতার বদলে আমার গলা শুনে ভড়কে গেল। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভড়কে যাওয়াটা সন্দেহের তীর হয়ে দাঁড়ানোর আগেই আমি খুব দ্রুত আর খুব সংক্ষেপে বলে গেলাম লতার পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়ার কাহিনি। কিছুটা অবাকই হলাম লিওনি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই বাধ্য ছাত্রের মতো কথাগুলো শুনে গেল। কিন্তু তারপর যখন অনুরোধ করল, আমি যদি খুব বেশি দূর চলে গিয়ে না থাকি, তাহলে এখনই তার সঙ্গে হাসপাতালের সামনে দেখা করতে পারব কিনা। তখন আমার অবাক হওয়ার পালা। এমন কী জরুরি কথা থাকতে পারে? এখন ঘড়িতে বাজে রাত একটার কাছাকাছি।

মিনিট দশেকের পরের দৃশ্য এরকম। লিওনি আর আমি হাসপাতালের ভেতরের বিশাল বাগানটায় পাশাপাশি একটা বেঞ্চে বসে আছি। লিওনি লতার প্রায় শূন্য সংখ্যক বন্ধুবান্ধবের একজন। সে একটু আগে যে খবরটা আমাকে জানাল সেটা লতাকে কী করে জানাব, তাই ভাবছি দুজন মিলে। কেমন অবশ আর বিমূঢ় লাগছে। আজকে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে লতার বাবা ফ্রেডরিখ স্নাইডার মারা গেছেন। মাত্রই অবসরে যাওয়া লতার বাবা প্রতিদিনের মতো টেনিস কোর্ট থেকে সাইক্লিং করে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে বিশাল এক ট্রাক তাকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। কাহিনির আরেকটা অদ্ভুত অংশ আছে। একটা কুকুর কোথা থেকে ছুটে এসে তার সাইকেলের সামনে পড়াতে ভদ্রলোক কয়েক সেকেন্ডের জন্য সাইকেলের সরু রাস্তা ছেড়ে বাম পাশের গাড়ির রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। আর তাতেই…। লতা আর তার বাবার ঘটনার ভেতর এত মিল কেন? এর ব্যাখ্যা কী? তা ছাড়া, লতাকে কালকে কীভাবে খবরটা জানাব? লিওনিকে অনুরোধ করে বললাম, এই কথা লতাকে তারই জানানো উচিত। কিন্তু আমি থাকব সেখানে। সকাল সাতটায় আমি চলে আসব। উঠে দাঁড়ালাম বাসার ফিরব বলে। লিওনির নাইট ডিউটি আছে। এত বড় দুঃসংবাদ চেপে কাজ করে যাওয়া তার জন্যও কঠিন।

বিক্ষিপ্তভাবে পা চালাতে চালাতে ভাবছি, দেয়ার আর মেনি থিঙ্কস বিটুইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ। দৃশ্যের চেয়ে অদৃশ্যের প্রভাবই বেশি। শেক্‌সপিয়ারের কথা। আজকের ঘটনা দুটো আমি মেলাতে পারছি না কিছুতেই। দুটো দুর্ঘটনা। দুই শহর। দুই সময়ে ঘটা। অথচ কী মারাত্মক অন্ত্যমিল। হাঁটছি আর ভাবছি। ভাবছি আর হাঁটছি। এক চাঁদের আলো ছাড়া রাস্তায় আর কেউ নেই। কেমন জানি শিউরে উঠলাম।

(চলবে)

ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: মিউনিখ, জার্মানি।

আগের পর্ব এখানে

mm

By Rim Sabrina Jahan Sarker

A biologist. My PhD was on chronic lung disease and now doing a postdoc on image analysis on cancer tissues. I enjoy creative writing and running.

One thought on “হঠাৎ স্বর্ণকেশী!-নয়”

Leave a Reply