তেরো বছর আগে বাংলাদেশের গার্মেন্টস কর্মী গাজী এক টুকরো কাজগ গুঁজে দিলেন তাঁরই হাতে তৈরি শার্টের ভেতর। তিনি সেই কাগজে সাহায্য চাইলেন। সেই শার্ট গিয়ে পড়লো জার্মানির কোলন শহরের ক্লুটশ পরিবারের হাতে। এরপর তৈরি হল অসাধারণ একটি সংযোগের গল্প।
ক্লাউডিয়া ক্লুটশ স্বামীর শার্ট লন্ড্রিতে দিতে গিয়ে দেখলেন কি যেন একটা পড়লো শার্ট থেকে। তুলে নিয়ে পড়লেন, তাতে লেখা, “আমি একজন গরীব মানুষ। জীবন চালানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন। আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসুন। সৃষ্টিকর্তা আপনার মঙ্গল করুন।” এর পাশেই গাজীর ঠিকানা।
ক্লাউডিয়া বলেন, গাজীর সাথে তাঁর পরিবারের সম্পর্কটি নাটকীয়তায় ভরা এবং বিস্ময়কর যা আমরা কখনো কল্পনা করতে পারিনি। আর এটির শুরুটা হয়েছিল একটি শার্ট থেকে যেটি বাংলাদেশ হতে এসেছে।
শার্টের মাঝে খুঁজে পাওয়া এই চিরকুট দেখে ক্লাউডিয়ার স্বামী বলেছিল ফেলে দিতে, কিন্তু সে ফেলে দেয়নি এবং দিনের পর দিন তিনি এটি ভুলতে পারেননি। ক্লাউডিয়া বাংলাদেশে গাজীর কাছে চিঠি লিখলেন। ছয় সপ্তাহ পর গাজী উত্তর দিল, “বাংলাদেশে অর্থ উপার্জন করা খুবই কঠিন। আমার ভাইবোন প্রায় সবাই বেকার। আমি খুবই খুশি হব যদি তুমি বাংলাদেশে বেড়াতে আস। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক নিসর্গ, বন, নদী তোমাকে মুগ্ধ করবে।” এভাবে প্রায় তেরো বছর ধরে তাঁদের চিঠি চালাচালি চলতে থাকে।
ক্লাউডিয়ার পরিবারও তেমন সচ্ছল নয়। কোলন শহরের পাশে ভেজেলিং এ তাঁদের চার সন্তান নিয়ে ছোট একটি ট্যারাসে থাকেন। এতদসত্বেও তাঁরা গাজীকে সাহায্য করতে চাইলেন। এগিয়ে এল জার্মানির টিভি চ্যানেল স্টারটিভি। স্টারটিভির অর্থায়নে ক্লাউডিয়া ও তাঁর স্বামী মার্টিন ক্লুটশ রওনা দিলেন বাংলাদেশে। দেখা করলেন গাজীর পরিবারের সাথে। গাজীর পরিবার এবং বাংলাদেশের দারিদ্রতা তাঁদের হৃদয় স্পর্শ করলো। গাজীর স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। গাজী জানায়, শার্টের ভেতরে সেই চিরকুট রাখার কারণ ছিল তাঁর বাবার অসুস্থা। চিকিৎসার অর্থ যোগানে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। এরপর চিরকুটের ধারণা হঠাৎ করে মাথায় আসে। ক্লাউডিয়া ও মার্টিন ক্লুটশ গাজীর পরিবারকে মাসিক ৩০ ইউরো করে সহায়তা পাঠাতে থাকেন।
বাংলাদেশ থেকে ফেরার ছয় মাস পর। এটা ২০০৬ এর নভেম্বর মাসের কথা। একদিন ক্লাউডিয়ার ফোন বেজেই যাচ্ছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গাজীর উৎকণ্ঠিত গলা। তাঁর স্ত্রীর প্রসব জটিলতা এবং সার্জারি ছাড়া উপায় নেই। এর জন্য দরকার ৫০০ ইউরো। ক্লাউডিয়া যোগাযোগ করলেন ডাক্তারের সাথে এবং অর্থ প্রদানের নিশ্চয়তা দিলেন। জন্ম নিল ফুটফুটে এক পুত্র সন্তান। কৃতজ্ঞতাবশত গাজী তাঁর পুত্রের নাম দিলেন রাকিবুল মার্টিন। সেই থেকে বাংলাদেশ ও জার্মানির এই দুই পরিবারের সম্পর্ক আরো গাড় হতে থাকে। সম্পর্কের শর্ত হিসেবে ক্লাউডিয়া রাকিবুল মার্টিনকে স্কুলে পাঠানোর কথা বলেছেন।
সম্প্রতি ক্লাউডিয়া ও গাজীর এই ঘটনা নিয়ে একটি রিপোর্ট হয়, সেটি দেখুন এখানে- https://www.facebook.com/wdrlokalzeitkoeln/videos/vb.281374231896419/1985654195068794/?type=2&theater
এরপর সময় গড়িয়ে যায়। ক্লাউডিয়া ও মার্টিন আরো একটি বার বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। একবার হলেও রাকিবুল মার্টিনকে জড়িয়ে ধরতে চান। আবারো এগিয়ে এল স্টারটিভি। এতদিনে গাজীর ভাগ্য ফিরেছে। গার্মেন্টসের কাজ ছেড়ে মাছের ব্যবসা শুরু করেছেন। জার্মানি হতে প্রাপ্ত অর্থ আর নিজের পরিশ্রম দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন নিজস্ব দালান বাড়ী, যাতে খরচা হয়েছে প্রায় তিন হাজার ইউরো। এদিকে গাজীর ঘরে আরো এক পুত্র সন্তান এসেছে। ক্লাউডিয়া আর মার্টিন অবাক হয়ে যান গাজীর জীবনের এই পরিবর্তন দেখে। রাকিবুল মার্টিন এখন স্কুলে যায়, মেধাবী ছাত্র সে। গাজী বলেন, জার্মানির সাথে তাঁর একটি আত্মার বন্ধন তৈরি হয়েছে। আমি অবশ্যই ভাগ্যবান। তবে আমি এও জানি, একটা সময় এটি শেষ হয়ে যাবে এবং আমাকে আমার পথ করে নিতে হবে। ক্লাউডিয়া স্বামীকে নিয়ে বাংলাদেশের একটি গার্মেন্টস ঘুরে দেখেন যেখানে কাজ করে প্রায় ৮ হাজার কর্মী।
শেষে বিদায় পর্ব। গাজীর চোখে অশ্রু টলটল করে। সে জানে তাঁর প্রথম সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখত না যদি এই জার্মান পরিবারটি এগিয়ে না আসত। ক্লাউডিয়া বলেন, গাজীর এই পরিবর্তন সত্যিই অতুলনীয়। তাঁদের এই অন্যরকম বন্ধুত্ব, আজকের দুনিয়ায় যা প্রায় বিশ্বাসই করা মুশকিল, গাজী না থাকলে সেটি সম্ভব হয়ে উঠত না, আর যে বন্ধুত্বের শুরুটা হয়েছিল শার্টের ভেতরে কুড়িয়ে পাওয়া এক চিরকুট হতে।
সূত্রঃ https://www.stern.de/tv/zettel-in-hemd-versteckt–so-reagierte-eine-deutsche-familie-auf-den-hilferuf-eines-fabrikarbeiters-aus-bangladesch-8404308.html
ধন্যবাদান্তে
জাহিদ কবীর হিমন
বন্ধুশহর বার্লিন থেকে
২রা ডিসেম্বর ২০১৮