১্‌। আসার দিন যখন ইমিগ্রেশনে যাবো তার আগে ভাবলাম আম্মার সাথে কথা বলি কিছুক্ষণ। সবার কাছে বিদায় নেয়ার পরে গেলাম আম্মার কাছে আলাদা করে কথা বলার জন্য।

– ঠিকমতো থাকবা বাবা।
– থাকবো আম্মা। টেনশন কইরো না।
– পৌছায়েই পড়ার টি-শার্ট, তোয়ালে, লুঙ্গি, প্যান্ট কোথায় আছে মনে আছে?
– হ্যান্ড লাগেজে।
– সার্টিফিকেট আর ফটোকপিগুলা?
– কাধের ব্যাগে।
– কিক-অফে যাওয়ার জন্য স্যুট, টাই, ফরমাল শার্ট?
– ১ নাম্বার বড় ব্যাগে।
– কাবাব, স্যুপ, মশলাগুলা, খাওয়ার প্লেট, চামচ?
– ২ নাম্বার বড় ব্যাগে।
– ওষুধগুলা?
– আরে এইগুলা তো পরেও শোনা যাবেনে যদি না পাই(আসলে ভুলে গেসি কোন ব্যাগে আছে)
– ঐখানে কিন্তু অনেক ঠান্ডা, সাবধানে থাকবা। মাফলার দিসি।
– আচ্ছা।
– টাকা পয়সার কোনো সমস্যা হলে সাথে সাথে আমাকে জানাবা। তোমার মা’র টাকা-পয়সা যা আছে সবই তোমার জন্য।
– আচ্ছা। লাগবে না ইনশাল্লাহ। লাগলে জানাবো।
– একটা কথা মনে রাখবা, তুমি আমার ছেলে। আমি কখনো কোনোদিন মানুষের ক্ষতি করি নাই, আমার ছেলেরও কোনো ক্ষতি আল্লাহ হতে দিবে না।
– আচ্ছা।
– আচ্ছা না, বলো ইনশাল্লাহ।
– ইনশাল্লাহ।
– ঐখানে কিন্তু আম্মা নাই, সবকিছু নিজেকে করতে হবে। রান্না করতে সমস্যা হলে আমাকে জানাবা, স্কাইপে দেখায়ে দিবো।
– সমস্যা হবে না। আমি তোমার ছেলে না!! ম্যানেজ করে ফেলবো।
– আমি জানি আমার ছেলে মানেজ করতে পারবে। তুমি মানুষের সাথে মিশতে পারবা নাকি, চলতে পারবা নাকি এইগুলা নিয়ে আমি টেনশন করি না, আমি জানি এইটা তুমি অনেকের চেয়ে ভালো পারো। আমার খালি ভয় তুমি কাগজ-পত্রগুলা হারায়ে না ফেলো। তুমি যে অগোছালো…
– হু!!
– যখন যা লাগবে মা’কে জানাবা।
– জানাবো।
– কোনো মেয়ে পছন্দ হলেও আমাকে জানাবা।
– আরে যন্ত্রণা, গেলামই না এখনো আর মাইয়া!! মাইয়ারা তো বইসা আছে আমার লাইগা, এয়ারপোর্টে পৌছানোমাত্র ঝাপায়ে পড়বে।
– দেখেশুনে থাকবা।
– তুমিও।
– তোমার মতো ছেলে যেনো সব মা পায়। তোমার মা তোমার সাথে আছে সবসময়, এটা মনে রাখবা।
– আমি জানি। এইজন্যই তো ভয় পাই না।

কথা-বার্তা শেষ কইরা আর পিছে তাকাই নাই, সোজা হাটা দিসি ইমিগ্রেশনের দিকে। পিছে তাকানো সম্ভব ছিলো না আসলে/ পিছে আমার দেশ আছে, আমার মা আছেন। সবাইকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট না হয় পিছের মানুষগুলা নাইই দেখুক। আমার হাসিমুখটাই থাকুক তাদের সামনে, কান্নাটা আমারই থাকুক।

তোমার মতো মাও যেনো সব ছেলেমেয়ে পায় আম্মা।

10257680_867582883255539_4244124509888000998_n

২। আমি বিদেশে আসাতে সবচেয়ে বড় অসুবিধা হইসে আমার আম্মার, সারাদিন পরে বাসায় আইসা সে কথা বলার লোক পায় না। তার রাজ্যের গল্প জইমা আছে, শোনার কেউ নাই। আমার বাপ কি করসে, চাচা কি করসে, মামা কি করসে, নিলয় কেন লেখাপড়া করে না, ইরানি মেয়ের কি খবর সব ব্যাপারেই তার জানার এবং বলার আগ্রহ অত্যাধিক।

আমি ফোন দিলেই সে নানাভাবে ‘তোর ক্লাসের মেয়েদের কি খবর?’ টাইপের কথাবার্তা জিজ্ঞাস করে এবং ঘুরেফিরে সেটা ইরানী মেয়ের দিকে চলে যায়। তারে আমি যতোই বলি যে ইরানির লগে আমার দেখা হইসে একদিন, তাও ৫ মিনিটের কিন্তু সে বোঝে না। বলে, তুই ঠিকই দেখা করিস কিন্তু বলিস না। আমি কই, আরে ভালো যন্ত্রণা হইসে তো এই মহিলার। তোমারে না বইলা আমার ফায়দা কি? তুমি কি আমার সতীন?

আজকে আমার ছুটি+বাসায় আছি, সে আমারে যুতমতো পাইসে। সকাল থেইকা স্কাইপে সে আমার লগে কথা বলে। যতোই বলি যে আম্মা রান্না করতে হবে, খাইতে হবে, গোসল করতে হবে হেন তেন, ক্যামনে কি!! সে কথা কইতেসে তো কইতেসেই। একই কথা তিনবার কইরা বলে, সবচেয়ে বেশিবার বলে তুই ভালো আছিস তো বাবা?

তোমার বাবা ভালোই আছে আম্মা। তার থাকা-খাওয়া, টাকা পয়সার সমস্যা নাই; তার সমস্যা একটাই, সেটা হলো তুমি নাই। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমাকে দেখতে না পাওয়া যে কতোটা কষ্টের, এটা কেউ ফেইস না করলে ফিল করতে পারবে না কখনো।

আমি শুধু চিন্তা করি আমার মা’তো তাও আছেন, হউক না হাজার মাইল দূরে, অন্তত তাকে তো স্কাইপে দেখা যায়, আজ হউক কাল হউক আর ২/৪/১০বছর পরে হউক, বেচে থাকলে নিশ্চয় আবার দেখা হবে কিন্তু যে ছেলেমেয়েগুলার মা নাই, তারা কিভাবে দিনের পর দিন এই কষ্ট সহ্য করে?

জগতের সকল মা’রা ভালো থাকুক।

mm

By Rafiul Sabbir

এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ইত্যাদি নানান অপ্রয়োজনীয় ডিগ্রী নিয়ে বছর দুয়েক সফটওয়্যার ফার্মে কামলা দিসি তারপরে 'জ্ঞানী হবো। কি আছে জীবনে!' বলে কম্পিউটার বিজ্ঞানে এমএস করতে চলে আসছি EIT ICT Masters Labs এ। ছিলাম জার্মানির বার্লিনে, ইউনিভার্সিটি TU Berlin। অবসর সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকি, আপাততো বার্লিন ঘুরতে ঘুরতে অবসর পাই না। কিন্তু বার্লিনেও বেশিদিন থাকা হইল না। বর্তমানে Pervasive Computing পড়তেছি Lappeenranta University of Technology (LUT) তে। এইটা ফিনল্যান্ড এ।

Leave a Reply