আমার ফ্লাইট ৩০ তারিখ । হাতে আছে মাত্র ১২ দিন। তিন মাস ধরে বাড়িতে বসে আছি। গঠনমূলক কাজের মধ্যে একমাত্র জার্মান ভাষা শেখা ছাড়া কিছু করিনা। তাও যদি মন চায় তখন ইউটিউব খুলে আনিয়া(Anja) আপার সাথে মুখ বুলাই – ইশ বিন রব্বানী, ইশ কম্মে আউচ বাংলাদেশ।
আর মন না চাইলে মুভি দেখি, বই পড়ি, অথবা ছাদে পাখিদের সাথে কিছুটা সময় কাটাই। জার্মান ভিসা পেয়ে গেছি সুতরাং আমি এখন সাক্সেস্ফুল পাইয়োনিয়ার টাইপ তাই প্রতিদিন কাউকে না কাউকে কাউন্সেলিং করতে হয়। কখনও ফোনে কখনও মেসেঞ্জারে আবার কখনো ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে। “-ভাই ক্যাম্নে এপ্লাই করব? – কত টাকা লাগবে? – আপনি তো ভাই বস” এই টাইপ কথাবার্তার সমাধান দিতে হয় দিনের কোন একটা সময়। কাছের লোকজন ফোন দিলে আগে বলবে কবে ফ্লাইট তারপর অন্য কথা। ভার্সিটির অনেক জুনিওর, সহপাঠী, বড়ভাই কাছের এবং দূরের মেসেঞ্জারে নক দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। তারপর সবাই একটা সময়ে জানতে চায় কিভাবে যাওয়া যাবে?
আমাদের দেশে বাইরে পড়তে যাওয়া মানেই সাক্সেসফুল হওয়া মনে হয়। ওখানে গিয়ে কিভাবে থাকব, পাস করতে পারব কিনা তার ধার কেউ ধারেনা। সবসময় বাড়িতে থাকার দরুণ মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া হচ্ছে রেগুলার। সেই সুবাদে আঙ্কেল দের সাথেও একটা ভাব হয়ে গেছে। কিছু আংকেল যখনি দেখা হয় তখনি খোজখবর করেন। গোছগাছ কতদূর শুনতে চান। আমি বলি গোছগাছ মুটামুটি হয়ে গেছে বাকিটা যাওয়ার আগে ঢাকা থেকে করতে হবে। জার্মানি সম্পর্কে অনেকে শুনতে চান। কেমন দেশ? ধর্ম কর্ম পালন করা যায় নাকি? কি খাবার খেতে হবে? এক আংকেল একদিন হুট করে বলল “বাবা বাথরুমে কিন্তু ওরা পানি নেয় না। একটা বদনা নিয়ে যাইয়ো।” বদনার বিষয়টা আগে থেকেই জানতাম। তাই আংকেল কে আস্বস্ত করলাম যে কেনা হয়ে গেছে।
আত্নীয় স্বজনদের সাথে দেখা হচ্ছে । আমি জার্মানী যাব এইজন্য কাছের আত্নীয়রা দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছেন। দাদী নানীরা মুখে কপালে চুমু খান। কাঁদেন। ভাবেন এইদেখায় বুঝি শেষ দেখা তাদের সাথে। সব আত্নীয়দের সাথী মুটামুটি সাক্ষাত হয়ে গেছে। ঈদে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম তখন গ্রামের লোকজনদের সাথেও দেখা হয়েছে। আমার বিদেশে পড়তে যাওয়া গ্রামের লোকজন ভালভাবে নিতে পারেনি। অনেকে বলেছে একটাই ছেলে এতদূর যাওয়ার কি দরকার।
এই কথা শুনতে শুনতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমি কেন যাচ্ছি শুধু আমিই জানি। সবার জীবনদর্শন এক নয়। কঠোর মনোবল আছে বলেই হয়ত এই প্রশ্নে এখন বিচলিত হইনা। প্রথম দিকে ভাবতাম আমি কি ঠিক করছি? এখন আর এমন ভাবনা মাথায় আসেনা। এখন মনে হয় যে প্রশ্ন করছে তার সাথে আমার জীবনদর্শন আলাদা। সে তার অবস্থান থেকে আমাকে বিবেচনা করছে। আমাকে আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হবে।
অনেকে বলেছে আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া বাদ দিয়ে জার্মানী কেন যাচ্ছি। তাদেরকে ও আমি বেশি কিছু বলিনা। প্রসঙ্গ পাল্টাই। বাসায় চলে আসি। বাসায় আমার মা পরম যত্নে আমাকে প্রতি বেলা খাওয়ান। বাড়ীর বাইরে থাকছি সাত বছর হল। বাসায় এসে এক সপ্তাহের বেশি খুব কমই থাকা হয়েছে। সেই সময়ের মধ্যে মা আমার মন ভরে আমাকে খাওয়াতে পারেন না। মা যত পদের রান্না জানেন তার প্রতিটা আইটেম এক এক করে পূর্ণ স্বাদ পেতে হলে মিনিমাম একমাস বাসায় থাকতে হবে। টাকি মাছ ভর্তা, শুটকি চচ্চরি, সজিনা মাছ করলার ঝোল, করলা আলু শিং মাছের ঝোল, ইলিশ ভুনা, খাসির কোরমা, নেহারী, জিগরি(গরুর ভুড়ি), হরেক রকমের শাক ভাজি, পটল আলু ভেজে ভর্তা, নারকেল দিয়ে হাস, দেশী মুরগীর ঝোল, মিষ্টি কুমড়া দিয়ে গরু, ওল দিয়ে খাসি, মলা মাছের চচ্চরি, বেগুন ভাজি, ডাল আলু ঘন্ট, বুটের ডাল,কাচ্চি, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচু শাক, আলুর দম, কাঠালের বিচি দিয়ে ছোলা চচ্চরি সহ আরো শখানেক আইটেম শুধু মা’র হাতেই অমৃত লাগে। অনেক যায়গায় এগুলো খেয়েছি। পেট ভরলেও মন ভরে না। এখন আমি মন ভরে খাচ্ছি। তিনবেলা ভাত খাচ্ছি। কয়েকদিন আগেও ডায়েট করছিলাম। এখন ভাবি এই খাবার গুলো তো আর পাবনা। যখন পাবনা তখন আবার ডায়েট শুরু করা যাবে।
বাসায় শুধু আমি আর ছোটবোন সাদিয়া থাকি। দুই বোন মাঝে মাঝে আসে শশুর বাড়ী থেকে। চারজন একসাথে থাকলে বাড়িতে চাঁদের হাট বসে। বড় আপুর দুইটা ছেলে। বড় ছেলের বয়স সাত। আমার রুমে মাঝে মাঝে ঢু মেরে যায়। আমি ওকে বলেছি জার্মান থেকে তোমার জন্য জার্মান শেফার্ড এনে দিব। আলোচনার অধিকাংশ অংশ জুরে থাকে এই জার্মান শেফার্ড নিয়ে পর্যালোচনা। কত বড়? আমি যা বলব তাই শুনবে নাকি? স্কুলে নিয়ে যেতে পারব নাকি? আমি পিঠের ওপর চরতে পারব নাকি? এইসব হাজারটা প্রশ্ন। তারপর তারা চলে যায় । আমি, সাদিয়া ,মা আর বাবা থাকি বাসায়।
রাতে একসাথে খেতে বসি। বাবা বলেন এটা কিনেছি কিনা? ওটা কিনেছি কিনা? লুঙ্গি কয়টা নিবা? যাওয়ার সময় কত টাকা সাথে নিব? রাতে একটা মুভি দেখে ঘুমুতে যাই। অনেক সময় মুভি দেখতে দেখতেই ঘুম চলে আসে আবার মাঝে মাঝে ঘুম হারিয়ে যায়। যেদিন বিকেলে ঘুমাই সেদিন রাতে ঘুম আসতে এই সমস্যা হয়। রাত গভীর হলে আজে বাজে চিন্তা মাথায় আসে। একা লাগে। যতই দিন যাচ্ছে ততই যেন একা হয়ে যাচ্ছি। মন শক্ত করি। ভাবি এখন সবার মাঝে থেকেও একা লাগলে যখন কেউ থাকবেনা তখন কিভাবে বাঁচব। রাত গভীর হয়। একসময় ফুরিয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরি। আর এগারোটা রাত এভাবেই ঘুমিয়ে জেগে কাটাতে হবে। অসংখ্য ভালবাসায় সিক্ত হয়ে, ভাল লাগার না লাগার হাজারো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে শেষের কয়টা দিনও শেষ হয়ে যাবে।
তোমাদের এই সময়, আর আমাদের সত্তোর দশকের ইন্টারনেট, ইমেইল, মোবাইল এমনকি লং ডিস্টেন্স ফোনের সুবিধা বিহীন সময়ে জার্মান যাওয়ার তফাত অনেক!
আমিও বাবা-মার এক ছেলে ছিলাম।
আমাকে তখন ওই নির্বান্ধব পরিবেশে আল্লাহর উপর তাওয়াককুল করে ওঁদের এভাবে ছেড়ে দেয়ার সাহসের জন্যে এখন ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
তোমাদের এই সময়, আর আমাদের সত্তোর দশকের ইন্টারনেট, ইমেইল, মোবাইল এমনকি লং ডিস্টেন্স ফোনের সুবিধা বিহীন সময়ে জার্মান যাওয়ার তফাত অনেক!
আমিও বাবা-মার এক ছেলে ছিলাম।
আমাকে তখন ওই নির্বান্ধব পরিবেশে আল্লাহর উপর তাওয়াককুল করে ওঁদের এভাবে ছেড়ে দেয়ার সাহসের জন্যে এখন ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
Azizul Hakim
Paderborn Universität 1979~84