বিশ্বকাপ, বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বসেরা সব গাড়ি কিংবা হোমিওপ্যাথিক ঔষধ, জার্মানি কিংবা জার্মান যে নামেই ডাকেন না কেন এ দেশটি সম্পর্কে কম বেশি আপনিও জানেন। প্রায় বিনামূল্যে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা সরবরাহ করায় বিদেশে পাড়ি দেয়ার স্বপ্নে বিভোর বাংলাদেশের হাজারো ছাত্র/ছাত্রীর মতো জার্মানি নিয়ে আমার আগ্রহও কম ছিলো না। জার্মানি সম্পর্কে বাকি সবার মতোই কিছু ধারণা নিয়ে এখানে এসে নতুন অনেক কিছু দেখে কখনো বিস্মিত আবার কখনো বিমোহিত হয়েছি। জার্মানিতে পড়াশোনা করে জার্মান জীবনের অনেক নতুন কিছুর সাথে পরিচিত হয়েছি যা জার্মানিতে বসবাস না করা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অজানা। আমার চোখে দেখা জার্মানির এরকম কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ অথচ জার্মান জীবনের অপরিহার্য বিষয় নিয়ে আজকের জার্মানি কথন। জার্মানি নিয়ে আগ্রহ থাকলে এ বিষয়গুলো জেনে আপনারও আমার মতো বিমোহিত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
মশারীবিহীন
জীবন
পৃথিবীর সমগ্র যুদ্ধে যত বেশি লোক
মারা গেছে তার চেয়ে
অনেক বেশি মানুষের মৃত্যু
হয়েছে মশার কামড়ে। মানব
সভ্যতার ইতিহাসে মশার ভূমিকা অনেক।
একজন বাংলাদেশী হিসাবে আমার চেয়ে ভালো
একথা আর কেউ জানে
না। জার্মানিতে এসে অনেক নতুন
কিছুর দেখা পেলেও কোথাও
দেখা পাইনি ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই পতঙ্গের।পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার
প্রতি জার্মানদের অবসেশনের কারনেই কিনা জানিনা জার্মানিতে
এসে আমার মশার কামড়
খাওয়া হয়নি। অনেকের কাছে শুনেছি জার্মানির
কোনো কোনো এরিয়াতে নাকি
মশা আছে কিন্তু আমি
কোথাও পাইনি। কয়েল, স্প্রে আর মশারী ছাড়াও
যে একটা জীবন আছে
জার্মানি না আসলে এ
কথা হয়তো আমার অজানাই
থেকে যেতো।
নীল
চোখ আর স্বর্ণকেশীদের দেশ
গাড় নীল চোখ আর
মাথা ভর্তি ব্লন্ড হেয়ার বা স্বর্ণকেশ, পুরুষ
হোক অথবা নারী, এই
হলো একজন ট্রেডমার্ক জার্মানের
বৃত্তান্ত। পৃথিবীর বাকি সব দেশের
মতোই জার্মানদের মধ্যেও রয়েছে নানা আকার, বর্ণ
আর ধর্ম। তবে এই ইউনিক
ফিচার ফলো করলে বেশিরভাগ
জার্মানদেরই সহজে অন্যদের থেকে
আলাদা করা যায়।
শুধু
জার্মানদের দেশ না
জার্মানিতে এসে আপনি শুধু
জার্মানদের দেখা পাবেন এ
কথা ভাবলে আপনার এখনো অনেক কিছুই
জানার আর দেখার বাকি।
আমেরিকার পর পৃথিবীর সব
দেশের অভিবাসীদের দ্বিতীয় পছন্দের দেশ বলেই হয়তো
জার্মানির রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে শত শত
মানুষের সাথে দেখা হওয়ার
পরো মাঝে মাঝে আনমনে
ভাবি-“আজ কি কোনো
জার্মানের সাথে দেখা হয়েছে?”
জার্মানিতে এসে পৃথিবীর খুব
কম দেশই আছে যেখানের
মানুষের সাথে দেখা হয়নি।জার্মানির
জনসংখ্যার একটা বড় অংশই
টার্কিশ জনগোষ্ঠী। কয়েক প্রজন্ম ধরে
এখানে সেটেল হয়ে যাওয়ায় জার্মানির
সর্বত্রই আপনি তুর্কী বংশদ্ভূত
অনেক মানুষের দেখা পাবেন। একই
ভাবে ইটালি, পোল্যান্ড ছাড়াও পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশের মানুষদের
স্থায়ী ঠিকানা এখন জার্মানি।
জার্মান শুধু জার্মানদের ভাষা না
কিছুদিন আগে পোল্যান্ড ভ্রমণে গিয়ে এয়ারপোর্টে নামার পর পোলিশ ইমিগ্রেশন পুলিশ আমার কাগজপত্র দেখে যখন পরিষ্কার জার্মান ভাষায় জিজ্ঞেস করলো আমি জার্মান জানি কিনা তখন লজ্জিত হয়েছি কিন্তু অবাক হইনি।রাশিয়ান বাদ দিলে ইউরোপের সবচেয়ে বেশি মানুষের নেটিভ ল্যাংগুয়েজ এই জার্মান ভাষা জার্মানি ছাড়াও অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড,বেলজিয়াম,লুক্সেমবার্গ আর লিখটেনস্টাইনের অফিশিয়াল ভাষা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরতে গিয়ে যখন বেশিরভাগ দেশেই ইংরেজির পাশাপাশি জার্মান ভাষায় দেওয়া ট্যুরিস্ট নির্দেশনা দেখি তখন জার্মান ভাষার অজ্ঞতা আমাকে আরেকটু বেশি পোড়ায়।
জার্মানদের
ক্যাশপ্রীতি
তথ্য প্রযুক্তি আর বিশ্ব অর্থনীতিতে
দাপিয়ে বেড়ালেও অদ্ভুতভাবে ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড
ব্যাবহারে জার্মানদের যতো অনীহা। ইউরোপের
অন্যান্য দেশে গিয়ে যেখানে
রাস্তার মোড়ের কিয়স্ক বা ছোট দোকানেও
কার্ড দিয়ে পে করতে
সমস্যা হয়না সেখানে জার্মানির
বিশাল বিশাল স্টোরেও প্রায়ই কার্ড দিয়ে পে করতে
গিয়ে পড়তে হয় বিড়ম্বনায়।
লেনদেনের ক্ষেত্রে জার্মানদের অনন্য ক্যাশ প্রীতির কারণেই এখানে আপনি চাইলেই সব
জায়গায় কার্ড ব্যবহার করতে পারবেন না।
জার্মানির বেশিরভাগ লেনদেনই তাই এখনো হয়
ক্যাশ টাকায়।
খালি
বোতল ফেলে দিতে নেই
পরিবেশ সংরক্ষণে রিসাইক্লিং এর ক্ষেত্রে জার্মানদের
জুড়ি মেলা ভার। ব্যবহারের
পর খালি বোতল ফেলে
দেয়াকে নিরুৎসাহিত করতে তাই জার্মানির
আছে অনন্য এক পদ্ধতি। ছুড়ে
ফেলে না দিয়ে এই
প্লাস্টিক আর কাঁচের বোতল
প্রায় সব সুপার শপে
অবস্থিত মেশিনে নিয়ে জমা দিলেই
প্রতিটি বোতলের জন্য আপনি পাবেন
টাকা। সুপার শপে কেনাকাটা করতে
গিয়ে কেউ যখন ব্যাগভর্তি
খালি বোতল নিয়ে রওনা
হয় তা দেখে এখানে
কেউ তাই অবাক হয়
না। এক পার্টির সব
বোতল জমা দিয়ে আরেকটা
ছোটখাটো পার্টির টাকা ম্যানেজ হয়ে
যাওয়াটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু না। জার্মানিতে
তাই পারতপক্ষে কেউ খালি বোতল
ছুড়ে ফেলে না। তারপরো
যদি ব্যবহারের পর আপনি খালি
বোতল ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলেন খুব
বেশি ক্ষতি হবে না ।
কারণ তখনো নিজের অজান্তেই
আপনি অনেক মানুষদের জীবন
ধারণে অবদান রাখবেন। দরিদ্র আর সহায় সম্বলহীন
অনেক মানুষই এখানে এই ফেলে দেয়া
বোতল সংগ্রহ করার টাকা দিয়ে
বেঁচে থাকার পথ খুঁজে।
রবিবারে
কোনো কেনাকাটা নয়
সারা সপ্তাহ কাজ করে সাপ্তাহিক
ছুটির দিন রবিবারকে রেখে
দিয়েছেন শপিং করার জন্য?
কিংবা রবিবার সকালে ঘুম থেকে উঠে
যদি আপনার মনে পড়ে যে
ঘরের চাল শেষ হয়ে
গেছে তখন আবার বিছানায়
ফিরে যাওয়া ছাড়া জার্মানিতে আপনার
অন্য কোনো অপশন নেই।
রবিবারের জার্মানি যেন এক গোস্ট
টাউন। শুধু কিছু রেস্টুরেন্ট
বাদে এদিন সব দোকান
পাট বন্ধ থাকে।সপ্তাহের এই
একটা ছুটির দিন জার্মানরা রেখে
দিয়েছে নিজের ঘরে থেকে উপভোগ
করার জন্য। রবিবারে জার্মানির রাস্তা-ঘাট আর শহরগুলো
তাই অনেকটাই আমাদের ঈদের সময়ের ফাঁকা
ঢাকা শহরের মতো।সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোতে আপনি চাইলেও ঢাকার
মতো এখানে রাত দশটা/এগারোটায়
শপিং করতে পারবেন না।নির্দিষ্ট
কিছু সুপার শপ আর রেস্টুরেন্ট
বাদে বাকি সব দোকানগুলো
এখানে রাত আটটার মধ্যে
বন্ধ হয়ে যায়।
প্রাসাদ,
অট্টালিকা আর রুপকথার দেশ
আপনি যদি প্রতি মাসে
একটি করে জার্মান ক্যাসল
বা প্রাসাদ পরিদর্শন করার প্ল্যান করেন
তবে জার্মানির সবগুলো ক্যাসল দেখা শেষ করতে
আপনার মাত্র ১৭৫ বছর সময়
লাগবে। প্রতিদিন একটি করে দেখলেও
সময় লাগবে প্রায় ছয় বছর। একসাথে
সৌন্দর্য আর ইতিহাসকে ধারণ
করে জার্মানিতে ছোট বড় প্রায়
২১০০ ক্যাসল বা প্রাসাদ রয়েছে।
ডিজনির সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লিপিং বিউটি ক্যাসল যে প্রাসাদের অনুকরণে
করা হয়েছে বাভারিয়ায় অবস্থিত সেই এক নয়েসোয়ানস্টাইন
ক্যাসল দেখতেই প্রতিবছর ভিড় করে তের
লাখেরও বেশি পর্যটক।শুধু রুপকথার
প্রাসাদই না, স্নো হোয়াইট,
লম্বাকেশের রুপাঞ্জেল কিংবা হেন্সেল-গ্রেটেলের মতো রুপকথার চরিত্রগুলোও
কিন্তু আদতে জার্মান। পৃথিবীব্যাপি
জনপ্রিয় এই চরিত্রগুলো যে
জার্মানির বিখ্যাত গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয়ের সংগ্রহ করা জার্মান রূপকথা
থেকে নেওয়া। হ্যামিলনের বাশিওয়ালার হ্যামিলন শহরও কিন্তু এই
জার্মানিতেই।
পানি
খাবেন?স্পার্কলিং ওয়াটার নয়তো
জার্মানিতে পানি কিনতে গিয়ে
প্রায়ই যে বিড়ম্বনার শিকার
হতে হয় তার নাম
স্পার্কলিং ওয়াটার। কোক বা অন্যান্য
সফট ড্রিংকসের মতো সাধারণ পানিও
জার্মানরা গ্যাসসহ পান করতে পছন্দ
করে। সাধারণ পানি ভেবে কিনে
তাই বোতল খোলার পর
পানির বুদবুদ দেখে প্রায়ই ভাবি
এবারো বোকামি করে কিনে ফেলেছি
জার্মানদের অতি প্রিয় স্পার্কলিং
ওয়াটার। স্টিল ওয়াটার পান করে বড়
হওয়া আমার কাছে স্পার্কলিং
ওয়াটারের স্বাদ আর গন্ধ যে
নিতান্তই পরিত্যাজ্য একথা বলাই বাহুল্য।
জার্মানিতে তাই পানি কেনার
সময় স্টিল নাকি স্পার্কলিং তা
চেক করে নেয়াটাই বুদ্ধিমানের
কাজ।
(জার্মানি আর জার্মান জীবন নিয়ে লিখা শুরু করার আগে আমার ধারণাই ছিলো না যে এ লেখাটা এতো বড় হতে পারে। বিশাল এক রচনা লেখার পর এখন অনুভব করছি যে বিষয়গুলো বলতে চেয়েছিলাম তার বেশিরভাগই বলা হয়নি। আপাতত এই পর্যন্তই থাকুক। আবার লেখার অনুপ্রেরণা আর উদ্দীপনা পেলে জার্মান জীবনের বাকি বিষয়গুলো পরবর্তীতে আবার কখনো লিখবো বলে আশা করি।)
ভাইয়স আমাকে একটু হেলপ করবেন।