বিশাল বিশাল খালের পানি কোথাও বয়ে যেতে দেখলেই আমার কেমন হাত পা শিরশির করে। পাহাড়ের বুক চিড়ে যে রেলপথ যায় সেগুলো দেখলেও। আবার উঁচু উঁচু সেতু, আকাশচুম্বী অট্টালিকা, পিরামিডের মতন বিস্ময়কর কৌশলী স্থাপনা সব কিছুই আমাকে কিছুটা বিমর্ষ করে ফেলে। সুবিধাভোগী মানুষের স্বস্তি মানুষের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তীব্র ঘাম আর আপন রক্তে ভেজে নাম না জানা কত মানুষ! কত জীবন আর অস্থি করোটি মিশে থাকে সেগুলোয়!
এই দেশের কষ্টসাধ্য নানান সংযোজনের মত আমাকে অদ্ভুত এক অনুভূতিতে আচ্ছন্ন করে ফেলে এখানকার বর্ধিত নদী আর খাল। আমি সেখানে যেন নাৎসিবন্দী মানুষের কান্না বইতে দেখি। পরবর্তী সময়ে ভলগা খালে আর বা বাল্টিক খালে যেমন মিশে গিয়েছে জার্মান গুলাগবন্দীদের অশ্রু আর শরীরের সমস্ত নির্যাস।
সে ভাগ্যহত মানুষগুলোকে জ্বালানি হিসেবে জড়ো করা হত যে অগ্নিকুণ্ডে সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোর একটির নাম নয়েনগাম্মে। হামবুর্গের ব্যার্গেডর্ফে সেদিন হালকা বৃষ্টি ছিল। হেমন্তের শেষভাগ হলেও মূল শহরে অত শীত ছিলনা। অথচ গাড়ি থেকে নেমেই টের পেলাম শীতে হাড় ফুটো হয়ে যাচ্ছে। মূল ক্যাম্পের বিপরীত দিকে ছিল আমাদের পার্কিং এর জায়গা। একসারি গাছের ওপারেই কেমন বিরানভূমি দেখি চোখের সামনে। দেখি বিপুল এক অনড় মাঠ। জনমানুষ নেই কোন। হিম বাতাসে প্রগাঢ় হচ্ছে নৈঃশব্দ।
পেছনে ফিরে প্রথমেই অফিস ঘরটা পড়ে। একজন কর্মচারী ছিলেন সেখানে, বুঝিয়ে দিলেন কোন পথে যেতে হবে। খুব বেশী সময় বাকি ছিলনা সেদিন। জার্মানদের যত্ন করে রাখা মর্মপীড়ার চিহ্ন বন্ধ হয়ে যাবে আজকের মত, ঘণ্টাখানেক পর।
১৯৩৮ সালে স্থাপিত হয় পুরো ক্যাম্প। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত নাৎসিরা নয়েনগাম্মে এলাকার ছয় লাখ স্কয়ার মিটার সংবলিত জায়গাটিকেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প এবং ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ মিলিটারি ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করে। দ্রুত কয়েকটা ব্রশিওর নিয়ে একটা এক্সিবিশন বিল্ডিঙের দিকে হাঁটা দিলাম। সবচেয়ে বেশী পীড়নের দাগ রেখে দেয়া আছে সেখানে। দ্বিতল ভবনটি লাল ইটে গাঁথা।
ভেতরে ঢুকতেই একজন কর্মচারীর কাছ থেকে ছবি তোলার জন্য অনুমতি আছে কিনা জেনে নিলাম। পড়ন্ত বয়সী ভদ্রমহিলাটি প্রয়োজনের চাইতে অনেক অনেক বেশী আন্তরিকতায় অবাক করলেন। আমি হয়ত কারাগারের লৌহ কপাটের একাংশ দেখছি তখন একবার এলেন ক্যাম্পের দায়িত্বে নিয়োজিত কোন কর্মকর্তার টেলিফোন নম্বর নিয়ে, আবার কয়েদীদের ব্যপারে সংরক্ষিত তথ্য পড়ছিলাম মোটা লাল মলাটের খাতায় তখনো এলেন এক সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে। আমি যা দেখি চেষ্টা করি লিখে রাখার এবং সেগুলো লোকেদের পড়তে দেবার অভ্যাস আছে জেনে উৎসাহ দিলেন নয়েনগাম্মেকে নিয়ে লেখার জন্য। জার্মান ভাষায় যেন লিখি একদিন সেই শুভকামনা আমাকে জানালেন। আমি ভাবলাম হয়ত বিদায় নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু গণস্নানঘরে টাঙ্গানো টিভিতে ক্যাম্পের ওপর নির্মিত তথ্যচিত্র দেখছিলাম মন দিয়ে যখন, তখনও এলেন আর কোন কোন উৎস থেকে তথ্য পেতে পারি জানানোর জন্য।
স্বজাতির অতীত অবিচার সম্বন্ধে স্বয়ং স্বজাতি এবং বিশ্ববাসীকে সচেতন করবার পুরো প্রচেষ্টাকেই আমার কাছে খুব পরিশ্রমসাপেক্ষ তো বটেই, বেশ ব্যয়বহুলও মনে হয়েছে। এত বড় জায়গার প্রতিটা ইট- প্রতিটা সবুজের কণা ঠিকঠাক দেখে রাখার জন্য, প্রয়োজনমত সংস্কার কিংবা কষ্টস্মৃতির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয়ভার তো সম্মিলিত নাগরিকদের সাথে নিয়ে রাষ্ট্রই বহন করছে। কোন টিকেট কাটতে হয়না এখানে আসতে।
প্রায় তেতাল্লিশ হাজারেরও বেশী নারীপুরুষ আর শিশু এই নয়েনগাম্মে নামক মৃত্যুপুরীতে অচিন্তনীয়ভাবে নির্যাতিত লাঞ্চিত অপমানিত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। জার্মানির বিভিন্ন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তো বটেই রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইউক্রেন, ফ্রান্স থেকে আনা হত তাদের। বন্দীরা আসতেন নেদারল্যান্ডের লিউওয়ার্ডেন, আসেন কিংবা গোরিঙ্গেন শহর থেকে। সে দেশের ফুগট ক্যাম্প থেকেও আসতেন তারা। পোল্যান্ডের কুখ্যাত আউশুইৎস ক্যাম্পে যে ইহুদিদের মারা হয়নি, তাদের স্থানান্তরিত করা হয়েছিল এখানে। অ্যাডলফ হিটলারের সামরিক বাহিনী ভাফেন এসএস প্রধান হাইনরিশ হিমলারের নিয়োগে মেজর ওয়াল্টার আইযেলে নয়েনগাম্মের ক্যাম্প কমান্ডারের দায়িত্বে থাকে। এরপর এসএস লেফটেন্যান্ট মাক্স পাউলিকে নিয়োগ দেয়া হয়।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প নামের নরকগুলো যেমন হয়, নয়েনগাম্মেও ব্যতিক্রম না। একটা মূল ক্যাম্প ছাড়াও বাই ক্যাম্পের সংখ্যা ৭০ টার মত। মহিলাদের জন্য ২৪টার মত আলাদা ক্যাম্প ছিল। বন্দীরা সমস্ত সুখের সময় পেছনে রেখে ক্যাম্পে আসতেন একে একে। তাদের গোসল সেড়ে ফেলতে বলা হত। তাদের শরীরের সব চুল ফেলে দেয়া হত। এরপর স্ট্রাইপড ক্যাম্প ইউনিফর্ম পরতে হত। জ্যাকেট পাজামাতে সিল করা হত ক্যাম্প রেজিস্ট্রেশন নম্বর । শিপইয়ার্ড, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, গ্যাস মাস্ক, ট্রাক টায়ার ইত্যাদি আলাদা আলাদা ক্ষেত্রের জন্য কয়েদী ভাগ করে ফেলা হত শুরুতেই।
সবগুলো ক্যাম্প ছিল হৃদয়হীনতা আর বিদ্বেষের গুমোট এক একটা ঘর। যেখানে ডোরাকাটা মলিন ছেঁড়া জামা গায়ে দেয়া মানুষগুলো হাসতো না, মনের সুখে গান গাইতোনা। চোখের সামনে মানুষ মারা যেত চরম অপুষ্টি, যথার্থ স্যানিটেশনের অভাব কিংবা হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে। ১০০০ বন্দী মারা যায় মহামারি টাইফয়েডে। নিউমোনিয়া, যক্ষ্মায় বিপন্ন ফুসফুসের শব্দে ব্যারাকের ছিদ্র থেকেই ফিরে যায় প্রতিদিনের মুক্ত বাতাস। মহামারি টাইফয়েডেই ক্ষয়ে যায় হাজারেও বেশী প্রাণ।
এক পর্যায়ে এসে যারা তখনও বেঁচে, তাদের মনে হত শুধু মৃত্যুর জন্যই অপেক্ষা হচ্ছে জীবন, মৃত্যুই সমস্ত যন্ত্রণার সমাধান।
দিনমান নামমাত্র আহারের বিনিময় বন্দীদের কাদার খাদে কাজ করতে হত। প্রায় অচল শরীরে খাল খুঁড়ে যেতেন আপ্রাণ। যে কোন মুহূর্তে বিস্ফোরণের ঝুঁকির ভেতর থেকে কাজ করতে হত সমরাস্ত্র কারখানায়। কাজ করতে হত ইটের ভাটায়। দরকার মত কোন দালানের ধবংসাবশেষ সরানোর কাজে বন্দীদের ব্যবহার করা হত অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণভাবে। কোন নিরাপত্তার ব্যবস্থা না রেখে অবিস্ফোরিত বোমা খুঁজে দেখার কাজেও তাদের বাধ্য করা হত। কাজে বা আদেশে অপারগতার শাস্তি ছিল প্রবলবেগে চাবকানো কিংবা সিলিঙে ঝুলিয়ে রাখার মত তীব্র।
বন্দীদের ব্যবহৃত জীর্ণ পোশাক, ভীষণ দুঃখী থলের ভেতর ভরে রাখা তার পৃথিবী দেখে নিজের পৃথিবীটাই কোথাও থমকে যায়। তাই পুরোটা আমি থমকে যাই তাদের হলদেটে ডায়রি, হালকা মরচে ধরা ছোট্ট ডায়ালের ঘড়ি কিংবা লকেটবন্দী প্রিয়তমার মুখ দেখে।
একটু একটু করে রেকর্ড পড়ি, হেডফোন কানে শুনি অডিও, এগোতে এগোতে দেখি সাবেক জীবিত সংশ্লিষ্টদের ভিডিও ক্লিপ।
দক্ষিণপূর্ব প্যারিস থেকে কিছু দূরে আভোঁ শহরের মেয়র রেমি দ্যুমঁসেল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রেমি ফ্রেঞ্চ আর্মির হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, আহতও হয়েছিলেন পাঁচ পাঁচবার। ব্যক্তিগত জীবনে রেমি ছিলেন একজন ক্যাথলিক। পাঁচ সন্তানকেও ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিক হিসেবে বড় করছিলেন। কিন্তু হিটলার নীতির পক্ষে না থাকার কারণে কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা গেস্টাপো কর্তৃক বন্দী হন। ক্যাম্পে মারা যান তিনি।
আবার সাত বছর বয়সী জ্যাকুলিন মর্গেনস্টের্ন। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হবার পর মুযেলম্যানা হিসেবে শিশুটিকে আলাদা করে ফেলা হয়। Muselmänner ক্যাম্পে প্রচলিত একটি মর্মন্তুদ পরিভাষা। এই পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত চূড়ান্ত অসুস্থ, মৃত্যুশয্যা নেয়া, শ্রমক্ষম নয় এমন বন্দীরা। বিনা চিকিৎসায়, বিনা খাদ্যে তাদের ফেলে রাখা হত সিক বে (Sick bay) তে। কই মাছের মত তড়পাতে থাকা অথচ মরতে না পারাদের লেথাল ইঞ্জেকশন পুশ করে চিরমুক্তি দেয়া হত।
জার্মান ভাষায় মর্গেন অর্থ সকাল আর স্ট্যার্ন মানে তারা।
নয়েনগাম্মে হত্যা করেছে জিঘাংসায়; সম্ভাবনার এই আলোকে, নির্দয়ের মত। সকালবেলা হেসে উঠে রঙ ছড়াতে দেয়নি একটুও।
হায় যুদ্ধ! হায় মানুষের জীবন! হায় হৃদয়হীনতা!
যুদ্ধের পর পর ক্যাম্পের বর্বরতার চিহ্নগুলো মুছে ফেলা হয়েছিল। পরবর্তীতে প্রতিবাদের মুখে দুটো স্মারক এবং একটা এক্সিবিশন বিল্ডিং তোলা হয়।
বিশাল জায়গা জোড়া এলাকাটিতে সতেরটা ইটের দালান আছে, আছে মন খারাপ করে দেয়া স্মৃতিস্তম্ভ। সমান্তরালভাবে কয়েক ব্লকে বিছিয়ে রাখা আছে অজস্র পাথরের টুকরো, হতভাগ্য মানুষদের আহত নিঃশ্বাসের ভার নেয়া ব্যারাকগুলো ছিল যেখানটায়।
সাদা বুনটের ব্যানারে নয়েনগাম্মেতে নিহত ২৫০০০ বন্দীর নাম লিখে রাখা আছে হাউজ অব রিমেমবারেন্স নামের স্মৃতিঘরটায়। প্রায় তেতাল্লিশ হাজার মৃতের ভেতর সবার নাম ব্যানারে নেই। ডাটাবেজে আছে বাকি থাকা আরও আরও নাম। কিছু আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, ছাইক্ষেতে, স্মারকে অনুলিপি হয়ে। তাও হয়ত সমস্ত নাম ডাটাবেজেও পাওয়া যাবেনা।
পৃথিবীর কোন প্রান্তে, কোন অজ্ঞাতনামা ব্যথাতুর স্বজনের হৃদয়েই হয়ত ভীষণ যত্ন করে
রেখে দেয়া আছে। জ্বলজ্বল করছে, সবাই দেখতে পাচ্ছেনা।
চারটে এক্সিবিশন বিল্ডিং এ অল্প হলেও মানুষের আনাগোনা আছে। স্কুলের কিছু ছেলেমেয়েরা এসেছে শিক্ষাসফরে। তাদের দলটাও ভেঙ্গে ভেঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে বিমর্ষ অতীত।
তারপরেও শূন্য, ভীষণ শূন্য মনে হল। মরে যাওয়া আকাশটা ভেঙ্গে পড়ছে যেন হেমন্তক্লান্ত পপলারগুলোর মাথার ওপর।
শীত আসছে কদিন পরেই।
আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। গাড়ির জানালা দিয়ে দেখলাম ধর্মপোশাকে সজ্জিত কয়েকজন ইহুদী যাচ্ছেন ক্যাম্পের দিকে। হয়ত স্বজাতির যন্ত্রণা অনুভবে যাচ্ছেন সেদিকটায়।
পৃথিবীর সব নিপীড়িত মানুষের দুঃখবোধে আমার সংহতি। চলমান পৃথিবীতে আজও অলক্ষ্যে অগোচরে অথবা প্রকাশ্যেই উদোম হয়ে আছে কত সম আর অসম যুদ্ধ! উদোম হয়ে আছে যুদ্ধবন্দীদের জন্য কত গারদ আর কত জাহান্নাম! নাৎসিরা জাতীয়তা আর দেশের মাটির মর্যাদার পতাকা উঁচু রাখার জন্য যা করেছে, শেখার কি কিছু নেই? নাৎসি ত্রাস দমন করল যারা, তারা কি নির্বিচারে জার্মান নারীদের ধর্ষণ করেনি? গুলাগের অন্ধকারে ঠেলে দেয়নি লাখো মানুষের জীবন?
যদি অতীত থেকে শেখা যেত কিছু! মানবিকতার প্রয়োজনীয়তাটুকু অন্তত।
মানুষের আর্তনাদ- দুঃখগুলোকে যদি আর একটুও বাড়তে না দেয়া যেতো!