ডাইরি ( ১)

আজকে জার্মানিতে করোনা আক্রান্তদের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ইটালির নিউজ গুলো আর পড়া যাচ্ছে না। ইটালির মানুষগুলো অসাধারণ হাসিখুশি। ইউরোপের সবচেয়ে মিশুক, সোশ্যাল আর হাসিখুশি একটা জাতি। এদের দেশ যেমন সুন্দর মানুষগুলোও খুব প্রাণবন্ত! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির অনেক প্রদেশ খুব বিধ্বস্ত হয়েছিল। ইটালির স্থাপনা গুলো সুন্দর টিকে আছে। ইটালির করোনা ভাইরাস এর খবর গুলো আর পুরোটা পড়ার মতো মানসিক অবস্থা আমার নেই।
মা বলল কিছু চালডাল কিনে রাখা উচিৎ ঘরে। আমি চাল ডাল কিনবো ভাবছি, চাল ডাল নেই, এরমধ্যে তখনি একজন কল দিয়ে বললও মোট আট টা দোকানে গিয়েছি, আলদি, লিডেল, নেটো, রেভে, তিনটা এরাবিক দোকান কোথাও চাল ডাল তেল নেই। কাউফল্যান্ডে একটা বেশী দামের গমের তেল আর অলিভ অয়েল আছে, আমি বললাম তাই নিয়ে আসো আর কি করা!
এর ভেতর ফেসবুকে ঢুকলে দেখি মানুষের ঝগড়া দেখা যাচ্ছে সারাক্ষণ। একদল আরেকদল এর উপর লেগে যাচ্ছে। আসিফ এন্তাজ রবি নামক একজন বলল স্কুল কলেজ সব বন্ধ করা উচিৎ, আবদুন নূর তুষার যেই বললেন, “তুমি সব বেশী জানো”!সাথে সাথে আমজনতার গালি আবদুন নূর তুষারের ওপর।


একদল বলছে ইটালি থেকে কেন এদের এনেছে? ইটালি থেকে এসে কেন এরা হাজিক্যাম্প্যে গেলো না এরা খারাপ! অন্যদল বলছে হাজি-ক্যাম্পের যে অবস্থা মানুষ গুলো ১৮-১৯ ঘণ্টা জার্নি করে কিভাবে থাকবে!
একে তো পুরোপুরি গৃহবন্দী আর যা পড়ি তাই রাতে স্বপ্ন দেখি। সারারাত স্বপ্ন দেখি এইগুলো, রাতে ঘুম ভেঙে যায়। এরপর দুদিন ফেসবুক বন্ধ করে দিলাম।
তাও ভালো যে আমাদের এখানে এখন প্রচুর ছেলেমেয়ে আছে। দুপুরে খাবার সময় ডাইনিং টেবিলে একজন জিগ্যেস করলো, তোমার রক্তের গ্রুপ কি? “এ পজেটিভ!” “আমার ও পজেটিভ”! “জানো এ পজেটিভ করোনাতে সব চেয়ে বেশী বাজে ভাবে ভুগছে!”
শোনার সাথে সাথে একটা শীতল রক্তের ঢেউ মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে গেলো। এমনিতেই আমার ইমুউনিটি নিয়ে আমি খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করিনা। ইমুউন সিস্টেম দুর্বল হয়ে গতবছর হাসপাতালের সেই ভয়াবহ দশদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। এরপর দেশে কল দিলাম, এদিকে আব্বু করোনা এর মৃত্যু কেমন কঠিন সেই নিয়ে বিস্তারিত একটা লেকচার দিলেন, শ্বাসকষ্টে দমবন্ধ হয়ে কিভাবে পানির নিচে আটকে পড়া মানুষ গুলো মারা যায় তার সাথে তুলনা করে।
এরপর থেকে দেখি নিজেরও মাথা ব্যথা, ঝিমঝিম করছে, আর ফেসবুকে ঢুকলে সে রাতে আর ঘুম আসে না। বাংলাদেশের মানুষের করোনা নিয়ে লেখা, একদল আরেকদল কে আক্রমণ ঝগড়া দেখলে নার্ভ এমনিতেই বিদ্রোহ করে।
দুইদিন ফেসবুক বন্ধ করে রেখেছিলাম, আর মোবাইল থেকে দূরে বসে বসে জার্মান শিখছি্লাম। একজন পাকিস্তানি এসে বলল, “পৃথিবীর এই অবস্থা আর তুমি জার্মান শিখছো?”
যাইহোক, ভারতীয়গুলোর স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট পলিসিটা সব থেকে ভালো দেখছি! অন্যদেরটা জানিনা তবে, আমাদের ফ্ল্যাটের ভারতীয় দুজন এখন সবচেয়ে সুখী জীবন যাপন করছে। আমাদের ফ্লাটের দুইটার সাথে পাশের ফ্ল্যাট থেকে এসে জুড়েছে আরো দুটো, একজন ভারতীয় আর একজন গ্রীক। এই চারজনকে দেখে মনে হচ্ছে এরা জীবনের শ্রেষ্ঠ সুখী সময় পার করছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে শোনা যায় এদের হাসির শব্দ, সারাদিন খিলখিল খিলখিল। গ্রিক ছেলেটাও সারাদিন এদের সাথে ন্যাওটার মতো লেগে থাকে, ঝাল মসলা সব খাওয়া শিখে গেছে। এই চারজন সারাদিন এক সাথে রান্না আর খাওয়া দাওয়া করছে। গতকাল রাতে দেখলাম বিরাট আয়োজন, ঘি দিয়ে পরোটা ভাজছে কুড়ি পঁচিশটা পরোটা তো হবেই। ঘি এর গন্ধ চারদিকে মৌ মৌ করছে, রাতের খাবার পরোটা মাংস।
আর আজকে দুপুরবেলা রান্নার সময় দেখলাম এরা প্লান করছে, “এখন মুভি দেখবো এরপর পোকার খেলবো, তারপর…… তারপর তারপর…. “মানে এক মুহূর্ত বিনোদন বন্ধ নেই!
আমি জিগ্যেস করলাম ভারতে কত জন আক্রান্ত? একজন হিহি করে হাসি দিয়ে বলল “আমরা খবর পড়িনা”।
এই পলিসিটা কিন্তু একদিক থেকে ভালো আমার পছন্দ হয়েছে, শুধু শুধু প্যানিক হয়ে বা কি লাভ?তাতে বরং নিজের ইমুউন সিস্টেম খুব দুর্বল হয়ে যায়। যাইহোক এদেরকে দেখে নিজের ভেতরের গুমোট ভাবটা কিছু হলেও কাটছে। রাতে রান্নার সময় গ্রীক ছেলেটা দেখি ময়লার ডাস্টবিন থেকে তিনটা লাঠি খুলে হাতে নিয়ে একটার সাথে আরেকটা জুড়ে দিয়ে লম্বা করে তার মাথায় এক কাগজের লাঠি জুড়ে দিয়ে আগুন দিয়েছে। লম্বা বারান্দায় এই আগুন হাতে ধরে হাঁটছে আর বাংলা হরতাল হরতাল টাইপ কিছু একটা বলছে, আসলে কি বলছে জানিনা। পিছে পিছে ভারতীয়টা তার মিছিলে সায় দিয়ে গলা মেলাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে আমি নিজেও আর হাসি আটকাতে পারলাম না।
পাকিস্তানি একজন হাসির শব্দে বেরিয়ে এসে কঠিন গলায় বলল,”এতো হাসাহাসি কেন এরকম দুর্যোগের ভেতর!”সাথে সাথে পাকিস্তানি একটা মেয়ে এসে চোখ বড়বড় করে জিগ্যেস করলো, “আমাদের আরও দুইমাস কোয়ারেন্টাইনে থাকলে কি জার্মান নাগরিকত্ব দিয়ে দিবে?”
এই প্রশ্ন শুনে দেখি প্রচণ্ড গম্ভীর চিন্তাগ্রস্ত ছেলেটাও আর হাসি আটকাতে পারলো না, সব দাঁত বের করে হাসছে !
কিন্তু আমি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না কোয়ারেনটাইনের সাথে জার্মান নাগরিক হবার সম্পর্কটা কিভাবে তার মাথায় আসলো !ওর কি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে কিনা কে জানে!

mm

By Rasha Binte Mohiuddin

স্টুডেন্ট অফ মাস্টারস ইন ইনভাইরনমেন্ট প্রটেকশন এন্ড এগ্রকালচারাল ফুড প্রডাকশন, ইউনি হোয়েনহেইম (স্টুটগার্ট জার্মানি)

Leave a Reply