নৃতাত্ত্বিকদের মাধ্যমে আমরা জানি বিববর্তনের মাধ্যমে মানুষ যখন শিম্পাঞ্জি হতে আলাদা হওয়া শুরু করে, সেই প্রায় সত্তর হাজার বছর আগে, তখন মানুষের পোশাক বলতে কিছু ছিল না, তখন থেকেই মূলত বৃক্ষের ছাল-বাঁকল বা পশুর চামড়া দিয়ে লজ্জাস্থান ঢাকার সংস্কৃতি মানুষের মাঝে শুরু হয়। আজকের মানুষের পোশাক এই সেই দিনও আজকের মত ছিল না, সাংস্কৃতিক বিববর্তনের মধ্য দিয়ে ওর ভাষা পোশাক সবই পাল্টেছে।
পুরাকালে বাঙ্গালির পোশাক কি ছিল জানিনা। তবে নানাপ্রকার ভাষ্কর্য্য, পাণ্ডুলিপি থেকে দেখা যায় নারী পুরুষ উভয়ের দেহের উর্ধ্বাংশ উদাম। তারা সেলাইবিহীন ধুতি আর শাড়ি পড়তো। বাঙ্গালি নারী ব্লাউজ ছাড়া “এক প্যাঁচ” দিয়ে শাড়ি পড়ে অন্তত দেড় হাজার বছর কাটিয়েছে। ব্লাউজকে বলা যায় এই সেদিনের সংযোজন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অগ্রজ সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ছিলেন জ্ঞানে গুনে অনন্যা। পতির ব্যবসাসংক্রান্ত কারণে জ্ঞানদানন্দিনীর উঠাবসা ছিল ইংরেজ মেমসাহেবদের সাথে। মেমদের নকল করে তিনি ঠাকুর পরিবারে প্রচলন করেন ব্লাউজের। সেকালে এই পরিবার বাঙ্গালি সমাজের সংস্কার, ধর্মসংস্কার আন্দোলন, সাহিত্য, শিল্পকলা ও সংগীতে খ্যাতনামা। তখন থেকেই ধীরে ধীরে শাড়ির সাথে স্তন ঢাকতে ব্লাউজের চল শুরু হয়।
এই ঘটনা থেকে দুটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। বিষয় একঃ সংস্কৃতি, পোশাক, আচার এসব শুরু হয় সমাজের উপর তলায়, ধনে মানে খাটো মানুষ তাইই শ্রেষ্ঠ ভাবে আর অনুকরণ করতে থাকে। আজকের পৃথিবীতেও আমরা দেখি টিভি সিনেমায় অভিজাত অভিনেতারা যা পরিধান করে, আমজনতা তাই অনুকরণ করে। পাখি ড্রেসের জন্য আত্মহত্যা- উচ্চবিত্ত হতে নিম্নবিত্তে সংস্কৃতির এই প্রবাহমানতাকে প্রমাণ করে।
বিষয় দুইঃ বাংলায় ব্লাউজ ব্যবহারের বহু আগেই আরব থেকে ভারতে ইসলাম আসলেও পর্দার ব্যাপারটিকে মানুষের মাঝে প্রচলিত করা যায়নি। মানুষের ধর্মবিশ্বাস, পুরনো ধারণা, সংস্কার-কুসংস্কার, মনোভাব, ইত্যাদি বদলায় ধীরে। বাংলাদেশের গ্রাম বাংলায় আজও ব্লাউজবিহীন নারী বেশ দেখা যায়। মোগল আমলে ইসলামের ব্যাপক প্রসারের ফলে পর্দার ধারণা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ১৯০৬ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ গঠিত হলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পর্দাকে ইসলামের প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে বিশ্বাস করতে মানুষকে উদ্ধুব্ধ করা হয়।
সম্প্রতি ফেসবুকে দুটি ছবি বেশ আলোড়ন তুলল। প্রথমটি হোন্ডা চালিয়ে বিয়ের আসরে যাওয়া নারী, অপরটি বোরকা পরে ক্রিকেট খেলুড়ে নারী। নারীর হোন্ডা চালিয়ে বিয়ের আসরে যাওয়াকে যারা মানতে পারেনি তাঁরা বোরকা পরে ক্রিকেট খেলুড়ে নারীকে সেলুট দিয়ে নিজেদের কিছুটা হলেও উদারমনা হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছেন। সচরাচর আমরা তাঁদের জামাতি হিসেবেই চিনি। স্কুল কলেজের বই আর মোকছেদুল মুমেনিন পর্যন্ত এদের দৌড়। চঞ্চলা কিশোরীরা যেমন কথায় কথায় সিদ্ধান্ত পাল্টায়, এই জামাতিরা তেমন দেশভেদে আদর্শ পাল্টায়। এরা বাংলাদেশে চায় একটি ধর্মবাদী সরকার, আমেরিকা ভারতে চায় ধর্মনিরপেক্ষ সরকার, অন্যদিকে সৌদি, মিশর বা তুরষ্কে চায় ধর্মভিত্তিক শরিয়া সরকার, মুসলিম সংখ্যালঘু ইউরোপের দেশগুলোতে এরা চায় ধর্মনিরপেক্ষ সরকার। এদের অনেকে নিজভূমি ছেড়ে ইহুদি নাছাড়া নাস্তিক দেশে এসেও স্বপ্নে মরুভূমির খেজুর খায়। উত্তপ্ত গ্রীষ্মে প্রায় উলঙ্গ মেয়েলোক দেখে চোখের জেনা হওয়ার এবং ইসলামী কায়দায় সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা থাকা সত্বেও মরুরবুকে অন্যায্য অসমতার সমাজে না গিয়ে এরা এসেছে এমন দেশে যেখানে ঠিকঠাক নামাজেরও উপায় নাই, আজান নাই, চারিদিকে শুরা-মদ।
এই দৃশ্যের বিপরীতে একটি দল দেখলাম যারা হোন্ডা চালানো মেয়েটিকেই বাঙ্গালি নারীর অগ্রদূত বেগম রোকেয়া বানিয়ে দিল, আর বোরকা পরে ক্রিকেট খেলা সেই মাকে বানালেন আফগানিস্তানের নারী। অথচ আমরা জানি এই ঝর্না আক্তারের শুধু নিজের জন্মই এই বঙ্গভুমিতে নয়, তাঁর চৌদ্দগোষ্ঠীর কেউই আফগান নন। এই দলটি স্বঘোষিত মুক্তমনা। না পড়াশোনা করা এই নতুন নাস্কিকদের আচরণ আগুণের পরশমণি সিনেমার সেই কিশোরী কাজের মেয়ে বিন্তির মতো চঞ্চলা, যার মুখে শুধু বিবাহের কথা, আবার তাঁর গোপন ইচ্ছা যেন কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য ছলাকলা করা। ফেসবুক দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার পরাকাষ্ঠা স্থাপনকারী এই বস্তুরা বড় বিচিত্র। এই গ্রুপের নারীরা কপালে সিঁদুর মেখে, কাশ্মীর থেকে আনা বালুচরি শাড়ী পরে, পুরুষেরা ধুতি, গলায় তুলসী ডালের মালা জড়িয়ে নমঃ নমঃ করতে করতে দেবীদূর্গার চরণে পুষ্পমাল্য অর্পণে এদের দ্বিধা নাই, অথচ মোহাম্মদের (সাঃ) জন্ম বা মৃত্যু দিবসের আলোচনা অনুষ্ঠানে যেতে বলেন, অথবা শবে মেরাজ শবে কদরের মজলিশে যেতে বলেন তখন দেখবেন এদের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, সাম্য, বস্তুবাদীতা, নাস্তিকতা নব্বই বছর আগে তুরষ্কের কামাল আতার্তুকের চেয়েও ঢের বেশি উপচেপড়া।
তাহলে নারীর পোশাক কেমন হবে, ওরা কীভাবে কথা বলবে, ওদের আচরণই বা কি হবে, সেসব কে ঠিক করে দেবে? আর যেই হোক, অন্তত ধর্মগ্রন্থে বিবেকবন্দক রাখা জামাতি বা দুই পাতা পড়ে স্বঘোষিত মুক্তমনারা নয়, আপনার আমার মতো কদ্দুসরাও নয়। নাক মুখ ঢেকে জীবন্ত তাঁবু সেজে থাকাই যেমন আটপৌরে আদিমতা নয়, তেমনি বেপর্দা বা ইচ্ছাস্বাধীন ছোট কাপড় পরাই সভ্যতা নয়। সভ্যতা হল এমন একটা সমাজ বিনির্মাণ করা যেখানে নারীরা ইচ্ছামত পোশাক পরতে পারবে, হোক তা বিকিনি হোক তা সর্বাঙ্গ ঢেকে বোরকা। সত্যবাদী নীতিবাদী শুভবাদী মানুষ হিসেবে আমাদের এমন একটি অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখা জরুরী যেখানে বর্ণে-লিঙ্গে-ধনী-দরিদ্রে-ধর্মে-অধর্মে-নারী-পুরুষে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে পুঙ্খানু সমতা, বৈষম্যহীনতা, স্বাধীনতা আর সম-অধিকার সোনার মতো জ্বলজ্বল করবে।
২৯ ভাদ্র ১৪২৭
ধন্যবাদান্তে
জাহিদ কবীর হিমন, বার্লিন থেকে
সম্পাদক, জার্মান প্রবাসে
আরো পড়ুনঃ
জার্মানিতে আক্রান্ত মুসলিম অভিবাসী- আমাদের করণীয়