গেল সপ্তাহের সোমবার বার্লিনের বাসা থেকে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁর নাম মো. তারেক এবং তিনি চিরকুমার ছিলেন। কদিন ধরেই পরিচিতজনেরা তাঁর খোঁজ না পাওয়ায় পুলিশে খবর দিলে দুয়ার ভেঙ্গে তাঁকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। মৃতদেহ দেশে নিয়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দাফন হয়েছে। তিনি ১৯৭৫ সালে জার্মানিতে এসেছিলেন। সাতচল্লিশ বছর পর ব্যস্ত বার্লিনের ঘরের কোনে একাকী নিঃসঙ্গ মরে রইলেন কয়েকদিন, কেউ জানতেও পারলো না।
খবরটা দেখার পর থেকেই পুরনো চিন্তা চাড়া দিয়ে উঠলো মনের ভেতর। জার্মানিতে এসেছি সাত বছর, তাহলে কি আর চল্লিশ বছর সময় আমার হাতে? সেদিন অফিসের এমপ্লয়ী পোর্টালে ঢুকে দেখি আমার অবসর ২০৫৫ সালের মার্চে। স্বাভাবিক সুদীর্ঘ জীবনলাভ করলেও মোটামুটি ধরে নেয়া যায় ২০৭০ সালের দিকে মারা যেতে পারি। আর যারা এই লেখা পড়ছেন, নিশ্চিত থাকতে পারেন, এই শতকেই পটল তুলতে হবে সব্বাইকে। তবে এসব হাস্যকর কথা। কে কখন মরবে কারো জানার কথা নয়, সেসব নিয়ে আলাপ করাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
দেশের বাইরে যারা থাকে মৃত্যু নিয়ে তাঁদের দুই ধরণের চিন্তা। এক, দেশে কেউ মারা গেলে শেষ দেখা না পাওয়ার অসীম বেদনা, আর দুই, বিদেশে আমরা মরলে কি হবে। আমাদের কবিগুরু বলেছেন, মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান। অপরদিকে তারাশঙ্করের কবি উপন্যাসের কবি বলেন, হায়! জীবন এত ছোট কেনে! কবিগুরু সারাটি জীবনে বহু নিকটজনের মৃত্যুদর্শন করেছেন, প্রিয় বৌদি কাদম্বরী দেবী থেকে শুরু করে অল্প বয়সের স্ত্রী ভবতারিণী দেবী (ভবতারিণী নামটি কবির কাছে সেকেলে লাগতো, তাই তিনি নাম দিয়েছিলেন মৃণালিনী দেবী), প্রিয় সন্তানের মৃত্যু দেখে হয়তো শেষকালে তিনি মৃত্যুকে শ্যামতুল্য করেছেন। আমাদের মত নিদানজনের বুকে কি অত পাটা আছে? তাই মৃত্যুকে আমরা ঘৃণাই করি। ঘৃণা না করলেও বহু মানুষ নিশ্চয়ই অনন্ত যৌবনের আকাঙ্ক্ষা হতে পিছুটান দেয়নি। এই মুহুর্তে শুধু নয়, অতীত বর্তমান এমনকি ভবিষ্যতেও মানবজীবনের সর্বোচ্চ আরাধনা আর তপস্যা হল দীর্ঘ জীবনলাভ।
শুধু দীর্ঘ জীবনলাভ নয়, বিজ্ঞানীদের ক্ষুদ্র একটি অংশ ধীরলয়ে মানুষের অমরত্ব পাওয়া নিয়েও কাজ করে চলেছেন। তাঁরা বলছেন, বিজ্ঞান একদিন মৃত্যুকে পরাজিত করে মানবজাতিকে অনন্তকালের জীবনদান করবে। এঁদের মধ্যে বিখ্যাত দুজন হলেন জীবাণু বিশেষজ্ঞ (gerontologist) অব্রে দে গ্রে আর বিজ্ঞানী রে কুরসভেইল। ২০১২ সালে কুরসভেইল গুগলে যোগ দেন এবং Caliko নামের একটি প্রকল্পে কাজ শুরু করেন যেটির মুল মিশন হল “মৃত্যুসমাধান” (To solve death)। বিল মারিস নামের আরেক বিজ্ঞানী যিনিও বিশ্বাস করেন মানুষ একদিন মৃত্যুকে জয় করবে, ২০১৫ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন মানুষ ৫০০ বছর বাঁচবে কিনা, আমি বলব হ্যাঁ অবশ্যই। গুগল এই প্রকল্পে দুই বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
১৯০০ সালের দিকে মানুষের গড় আয়ু ছিল চল্লিশ বছরের মত। কিন্তু তখন মানুষ নানাবিধ কারণে মরতো। যুদ্ধ, ক্ষুধা আর মহামারী ছিল মুল কারণ, যার কারণে বহু তরুণকেও অকালে প্রাণ হারাতে হয়েছে, যার কারণে গড় আয়ু এত কম ছিল। যেমন বিখ্যাত চেক লেখক কাফকা যক্ষ্মায় মারা গেলেন মাত্র চল্লিশে, রাশিয়ার বিখ্যাত কবি পুশকিন মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে ত্রিভুজ প্রেমের কারণে ডুয়েল খেলে মারা যান, যে খেলায় দুইজন দুইজনের দিকে গুলি ছুড়বে, যে বেঁচে থাকবে সে পাবে প্রেমিকাকে। এত কিছুর পরেও আধুনিক ঔষধ আর কোন ধরণের ভ্যাক্সিন ছাড়াই বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলেই ৭৭ বছর, নিউটন ৮৪ বছর বেঁচেছিলেন মধ্যযুগেই। এই আধুনিক যুগেও মানুষ বেঁচে থাকে ওই সর্বোচ্চ ১০০ বছর। অর্থ্যাৎ, বিজ্ঞান বহু রোগ থেকে মুক্তি দিলেও এখন পর্যন্ত একটি বছরও অতিরিক্ত আয়ু যোগ করতে পারেনি। অকাল মৃত্যু অনেকাংশে ঠেকানো গেলেও বহু কারণে এখনো মানুষ মারা যায় যা রোধ করা অসম্ভব নয়। ২০১২ সালে পৃথিবীতে মারা যায় মোট পাঁচ কোটি ছয় লাখ মানুষ যার মাঝে ছয়লাখ বিশ হাজার যুদ্ধে-সন্ত্রাসে, আট লাখ আত্মহত্যার কারণে। ওদিকে ১৫ লাখ মানুষ মারা যায় ডায়াবেটিসে। দেখা যাচ্ছে আমেরিকার সুসজ্জিত সেনা, আইএস বা আল কায়েদার থেকে চিনি (সুগার) অধিক বিপজ্জনক!
তবু মানুষের আরাধনা শেষ হওয়ার নয়। বিজ্ঞানের সৌন্দর্য হল অনন্তকাল ধরে সাধনা চালিয়ে যাওয়া। অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানী ডেভিড সিঙ্কলেয়ার বলছেন, মানুষের বয়স থামিয়ে দেয়ার প্রযুক্তি এই আসলো বলে। তিনি গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন, যে সমস্ত জীন মানুষকে বয়স্ক করে দেয়, ত্বক কুঁচকে দেয়, সেই জীনগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রেখে মানুষকে দীর্ঘকাল তরুণ রাখা যাবে। অর্থ্যাৎ, আমি আপনি নব্বই বছর বয়সে মারা গেলেও আমাদের চেহারা থাকবে ২৫ বছরের তরুণের মতই। অমরত্ব না পেলেও, চকচকে তরুণরূপ নিয়ে মরাও কি কম সৌভাগ্যের?
গুগলের রিসার্সে ফিরে যাই। কুরসভেইল ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, ২০৫০ থেকে ২১০০ সালের মধ্যে তাঁদের গবেষণা আলোর মুখ দেখবে। তাঁরা বলছেন, পুরোপুরি অমরত্ব না পেলেও এসময়ের মধ্যে মানুষের আয়ু হবে অন্তত ১৫০ বছর। কেউ কেউ বলছেন ২২০০ সালের মাঝেই মানুষ অমরত্বের স্বাদ পাবে।
এত কথার মূল কথা হচ্ছে, মানবজাতি একদিন অমরত্ব পেলেও পৃথিবীতে বর্তমানে যত প্রাণ আছে তাঁরা সেই আরাধ্য অমৃত ভোগ করতে পারবে না। অর্থ্যাৎ মৃত্যুর অমোঘ সত্যকে মানতে হবে আর এটি নিয়ে সামান্যতম দুশ্চিন্তা করাও বোকামি। এককালে মৃত্যু নিয়ে ভয়ে কাঁপতাম। সেসব মনে হলে এখন হাসি পায়। জীবন পূর্ণতা পায় না মরণ না হলে। মরণ তো জীবনেরই অংশ। আমার জীবনের সকল কিছু নিজের হাতে রেখে একমাত্র মৃত্যুকেই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। বলে দিয়েছি, মরার সাথে সাথে লাশ চলে যাবে মেডিকেলে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিছু সচল থাকলে মানুষের জন্য যেন সেসব কেটে নেওয়া হয়। বাকিটা রিসার্চের তরে। মৃত্যুর পর কোন ধরণের ধর্মীয় রংঢঙের কোন প্রয়োজন নেই। হুমায়ূন আহমেদ চান্নি পসর রাতে মরতে সাধ করেছিলেন। লেখকদের কত আহ্লাদ থাকে। আমাদের মত অভাজনদের আহ্লাদ থাকতে নেই। তবু বড্ড আয়োজন করে মরতে সাধ জাগে। আমি যেন জানবো আমি মারা যাচ্ছি, গভীর রাতে একাকী ঘরে ফুলের শয্যায় শুয়ে থাকবো, আগরবাতির জঘন্য গন্ধে মাথা ঘুরে বমি বমি ভাব আসবে, দূর হতে ভেসে আসবে আমার পরমেশ্বর কবিগুরুর গান, যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে, আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে……গান শুনে রাগ উঠে যাবে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা নিয়ে স্পুটিফাইতে চালিয়ে দেব, জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে, বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে…।
সূত্রঃ
১। ইউভাল নোয়াহ হারারির “সাপিয়েন্সঃ অ্যা ব্রিফ হিস্টোরি অব হিউম্যানকাইন্ড” (Sapiens: A Brief History of Humankind)
২। ইউভাল নোয়াহ হারারির “হোমো ডিউসঃ আগামীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস” (Homo Deus: A Brief History of Tomorrow)
৩। ইন্টারনেট
২৪ জানুয়ারী ২০২১
ধন্যবাদান্তে
জাহিদ কবীর হিমন, বার্লিন থেকে
অমরত্ব প্রত্যাশিত হলেও তা বাস্তবিক না। এইটার একটা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। তবে আমার ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা হচ্ছে, আশেপাশের সবাই পটল তুলবে আর আমি যুগের পড় যুগ বসে থাকবো। হতাসাগ্রস্থ হবো, অবসাদ থাকবে। সুইসাইড করতে ইচ্ছে করবে, একটা সময় পরে।