আমার মিশ্র অভিজ্ঞতাঃ ২০১৯ মার্চ মাসে বার্লিন আসি উচ্চশিক্ষার জন্য। ঠাণ্ডা দেশ চারপাশে বেশ ছিমছাম সাজানো গুছানো। দিন কয়েক যেতে না যেতেই খেলা শুরু জার্মান/তুরস্ক/বাংলাদেশ এর সাথে। উচ্চশিক্ষাঃ মাস্টার্স এর ক্লাস শুরু হলো, কেন জানি পড়ালেখা কঠিন লাগা শুরু করসে, জানা টপিক মুহূর্তে অজানা। 😃

কোন এক ক্লাসে maxqda, stata, hubspot, Ravens eye করা ক্লাসমেট বলে তুমি কি এগুলোর ব্যবহার জানো, যদি জেনে থাকো তাহলে গ্রুপ এসাইনমেন্টে নিতে পারি। যাই হোক, কিছুদিন পর মনে হল আমি মনে হয় অশিক্ষিত, মূর্খ, শুধুমাত্র এক্সেল ও এস পি এস এস টা জানি। পরে অন্যান্য স্টুডেন্ট বলে ভাই আমি ও একই নৌকা তে আছি, চিন্তা নিয়েন না। তখন কিছুটা স্বস্তি। কোন না কোন ভাবে পাস করে ফেলতে পারবো গ্রুপ স্টাডি করে। তার কিছুদিন পর, অন্য একটা সাবজেক্ট এর গ্রুপ এসাইনমেন্ট। নিজের অংশটুকু করে ভিনদেশী গ্রুপ লিডার কে দিয়ে দিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় মেসেজ করে বলে, তুমি কি বিরাম চিহ্ন এর ব্যবহার জানো না, তুমি এমন সাদা-সিদা ধরনের কেন লিখসো, তোমার জন্য আমাদের ইভ্যালুয়েশন মার্ক খারাপ হবে। তখন আবার ভাবতে লাগলাম, আমি এত কম জ্ঞানের পরিধি নিয়ে কেমনে মাস্টার্স শেষ করবো।

পরীক্ষা শেষে জানতে পারলাম, অই সাবজেক্ট টাতে শুধু আমি পাস করেছি, বাকি গ্রুপমেট প্লাজিয়ারিজম এর জন্য ফেল। তখন আমি কেন পাস করে গেলাম তাদের এই আক্ষেপ টা দেখে একটু খারাপ লাগলো। হোম-সিকনেস, নতুন বাসা খুঁজা, স্টুডেন্ট ডরম এ প্রতি দুই সপ্তাহ গিয়ে রুম চাওয়া, পড়ালেখা এর চাপ, ভাষাগত অনভিজ্ঞতা, কিঞ্চিৎ পরিমাণ রেসিজম, কিছু ক্লাসমেট এবং সিনিয়রদের হেয় মনোভাব নিয়ে প্রথম সেমিস্টার শেষ। আমি দেশে থাকা অবস্থায় জানতাম না, কিভাবে একটি সাইন্টেফিক রিসার্চ পেপার লিখতে হয়, কিভাবে সে পেপার উপস্থাপন করতে হয়, উপলব্ধি করলাম দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজনেস রিসার্চ বিষয়টা শুধু অল্প একটু মুখস্ত বিদ্যা দিয়েই শেষ।

কিভাবে একটি কোম্পানি এনালাইসিস করতে হয়, কিভাবে মার্কেট ট্রেন্ড নিয়ে সার্ভে করা লাগে, কিভাবে অফিস ম্যানাজমেন্ট এর সাথে একাডেমিক দিক দিয়ে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়। এসব ব্যাপার আমি শিখেছি জার্মান প্রফেসর এবং ব্যাচেলর পড়ুয়া এক শিক্ষার্থী থেকে। রেসিজমঃ বার্লিন এর আলেক্সান্দেরপ্লাটযে মালায়শিয়ান, গুজরাট এর দুইজন ফ্রেন্ড মাথায় কাপড় দেয়ার কারণে, তাদের কে উদ্দেশ্য করে বলতে শুনেছি, মাথার কাপড় টা আমাদের দাও, ওটাতে আমরা বন্ধুরা বসবো (হয়তো অন্যের কাছে এটা তেমন রেসিস্ট ব্যবহার না ও মনে হতে পারে।)একটি স্টার্ট-আপে ইন্টার্ভিউ দিতে গেলাম, সে অফিসের একজন বলে বসলোঃ Scheisse. Noch einmal asiatischer Kandidat für Interview (হয়তো অন্যের কাছে এটা তেমন রেসিস্ট ব্যবহার না ও মনে হতে পারে।).একটি ভেগান সুপারমার্কেটে ক্যাশিয়ার পদে ট্রায়াল দিতে গেলাম, ক্রেতা আমার কাউন্টারে চেক-আউট করাবে না। তাই অন্য কাউন্টারে চলে গেলেন। ম্যানেজার উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কিছু বললেন না।

অন্য কলিগরা ও পছন্দ করছে না আমি কাউন্টারে থাকি। পরে কাউন্টার থেকে সরিয়ে ডেকে নিয়ে বললো, ক্যাশিয়ার পদে আমরা তোমাকে রাখতে পারবো না, তবে ব্যাক অফ দি হাউস (ক্লিনিং) কাজ টা চাইলে করতে পারো (হয়তো অন্যের কাছে এটা তেমন রেসিস্ট ব্যবহার না ও মনে হতে পারে।). দেশীয় মানুষজনঃ অনেক শুভার্থী আছেন এখানে যারা আপনাকে সাধ্যমত, যথেষ্ট সহযোগিতা করবে। অজানা বিষয় সব নিজ উদ্যোগেই জানিয়ে দিবে, পারলে নিজেই কাজটা করে দিবে। সেটা এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসা থেকে শুরু করে নিজের বাসাতে রেখে রান্না করে খাওয়ানো, সিটি রেজিশট্রেশন, ভিসা এক্সটেনশন হোক না কেন। গুটি কয়েক আছেন, যারা হয়তো অন্য কেউ কিছুটা ভালো/উন্নতি করুক তা পছন্দ করে না বা এক প্রকার দাম্ভিকতা প্রদর্শন করেন আমি-ই সব জানি, এটা কেন করলা? তুমি নিজেকে বেশি বড় ভাবো? আসছো কত দিন হয়সে এখানে? এই দেশের সিস্টেম সম্পর্কে জানো তুমি? পারত পক্ষে এদের এড়িয়ে থাকা ভালো।

পেশাগত ভাবে সিনিয়র/জুনিয়ার কে বললাম, কাইন্ডলি রেজুম টা চেক করে দিবেন। তুমি মাস্টার্স করতেসো এখনো এসব জানো না, এই রেজুমটা দিয়ে চাকরি পাবা না। অবশ্য, সেই রেজুম দিয়েই প্রথম চাকরি টা পাই। কে এফ সি থেকে মাংস ভাজা নিয়ে ফিমেল অফিস কলিগসহ বের হচ্ছি, সেখানে হঠাৎ উপস্থিত পরিচিত মানুষ জন বলে উঠলেনঃ ভাই, আপনার তো পুরা সেট; ভাই পি আর তো ম্যানেজ করেই ফেলসেন; ভাই দাওয়াত দিয়েন। যাই হোক, চিন্তা-ধারা দেখে কিছুটা অবাক হতে হলো।একটি গেট-টুগেদারে গেলাম, কুশলাদি বিনিময় শেষে বলে, এখন কি কাজকর্ম করতেসো নাকি, বিজনেস ফিল্ডে আগে থেকে অভিজ্ঞতা না থাকলে এখানে জব পাওয়া যায় না। আমার প্রিভিয়াস এক্সপেরিএন্স থাকায়, বার্লিনে আসার পরেই জব পাইসি। একটা সেমিস্টার তো শেষ করলা, এভাবে থাকবা নাকি, রেস্টুরেন্ট গুলা তে কাজ পাবা, ওয়ারকিং স্টুডেন্ট জব একটু কঠিন। তখন জানালাম, আমিও ওয়ারকিং স্টুডেন্ট জব শুরু করেছি এই মাসে।

এটা শুনার পর উনি কেমন যেন মলিন মুখে কিছু না বলে বিদায় নিলেন। ভেদাভেদ টা কেন যেনো রয়ে গেল। যাই হোক, এটা আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা। আমার চাকুরীর দুষ্টচক্র (অগাস্ট ২০১৯- এপ্রিল ২০২১) ‘বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ড’ এর উপর ভিত্তি করে লেখা, অন্য অনুষদ নিয়ে আমার ধারণা নেইঃ জার্মানিতে আসার পর প্রথম চেনা পরিচিত সকলে বলতে শুনলাম এখানেতো অনেক জব। ম্যাক, কে এফ সি, ডমিনোস, স্টারবাক্স এ এমনিই চাকরি হয়ে যাবে। আরামে দিন কাটাইতে পারবে। আর তোমাকে আমি নিয়ে গেলে, ৫০-১০০ ইউরো বোনাস পাবো। কিন্তু আমার আশে-পাশের কেউই বলে নাই ওয়ারকিং স্টুডেন্ট জব এর ব্যাপারে। সংক্ষিপ্ত ভাবে বলতে গেলে, ম্যাক, কে এফ সি, ডমিনোস এ কাজ করুক, কাজ করার পাশাপাশি ওয়ারকিং স্টুডেন্ট জব গুলো সম্পর্কে ধারণা রাখা এবং অ্যাপ্লাই করা।

সিনারিও ১ঃ২০১৯ সালঃ জুলাই ২০১৯ ওয়ারক পারমিট পাওয়ার পর ধুমসে অ্যাপলিকেশন করে সার্থক ভাবে ১০০+ রিজেকশন পাইসি। কোন ব্যাপার না, এরকম হয়ে থাকে। এরপর ওয়ারকিং স্টুডেন্ট জব এর কল পাইলাম অগাস্ট এর মাঝামাঝি। ইন্টারভিউ দিলাম হইলো না। মন খারাপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা গণনা শুরু করলাম, সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ ব্যাপক রিজেকশনের মধ্যে দুটা ওয়ারকিং স্টুডেন্ট জব এর জন্য ইন্টারভিউ কল পেলাম।

সার্থক ভাবে সুযোগ হয়ে গেল দুটো তেই। একটাতে ঘন্টা প্রতি ১১ ইউরো, অন্যটা তে ১২ ইউরো ছিল। শুরু করেছিলাম ৬ মাসের চুক্তিতে প্রথম ওয়ারকিং স্টুডেন্ট জব। সপ্তাহে ২০ ঘন্টা করে ৮০ ঘন্টা জব করা প্রতি মাসে সম্ভব হতো না ইউনিভার্সিটি ক্লাসের জন্য। তাই সাপ্তাহিক ১৬ বা ১৮ ঘণ্টা কাজ করা সম্ভব হতো।২০২০ সালঃ ফেব্রুয়ারীতে নতুন জব অফার ঘণ্টা প্রতি ১৩.৫০ ইউরো তিন মাসের চুক্তি। সিলেকশন প্রক্রিয়াঃ আমি আমার ক্ষেত্রে ৬টি সার্থক জব ইন্টার্ভিউতে কমপক্ষে ৩ টা ধাপ পার করতে হয়েছে।প্রথম ধাপঃ কোম্পানি এইচআর এর সাথে ১৫-২০ মিনিটের ইন্টার্ভিউ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফোন ইন্টার্ভিউ প্রথমে জার্মান ভাষাতে হয়ে থাকে এবং আমি জার্মান ভাষাতেই দিয়েছিলাম। পরে ফেস টু ফেস ইন্টার্ভিউ জার্মান ও ইংরেজি দুটোতেই নিয়েছিল।দ্বিতীয় ধাপঃ প্রথম ধাপ সার্থকভাবে পার করতে পারলে, কিছু এসাইনমেন্ট বা স্কিল এসেসমেন্ট করে থাকে যেটা ৩-৫ কার্যদিবসে তাদেরকে জমা দিতে হয় অথবা তাদের সামনেই করে দেখাতে হয়, আমার ক্ষেত্রে স্প্রেডশিট এনালায়সিস করে দেখাতে হয়েছিল ২০ মিনিট সময়সীমা এর মধ্যে।

আবার অন্য একটি কোম্পানি এর জন্য মার্কেটিং প্ল্যান/ বি২বি মার্কেটিং এর টাস্ক ছিলো। আর একটি কোম্পানি এর জন্য SPSS/Qualtrics এর মাধ্যমে ডাটা/সারভে রিপোর্ট করে দেখাতে হয়েছিলো।তৃতীয় ধাপঃ দ্বিতীয় ধাপে পাস করে গেলে এরপর ফাইনাল ইন্টার্ভিউ এইচআর ও টীম লিডার এর সাথে হয়ে থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধাপের পরেই জানিয়ে দেন ক্যান্ডিডেট দের জব দেয়া হচ্ছে কিনা।আমার জানা ৮টি কোম্পানিতে ঘন্টাপ্রতি সম্মানী: 1. Penta, 2. Wooga, 3. Frieghthub (10.50€), 4.Pixformance (11€) 5. Udacity 6. Keyword Hero (11.25€) 7. Iman (11.50€) 8. Mercku (13.50€)

সিনারিও ২ঃ এরপর, করোনা বেড়াতে আসবে আসবে ভাব। আরে, বেড়াতে চলে এলো এর কিছুদিনের মধ্যে। এরপর আর যাওয়ার নাম ই নেই। স্থিমিত হয়ে গেল সব। কোম্পানি ফান্ডের অভাবে ছাটাই শুরু করলো, যার মধ্যে আমার মত হাজার খানেক ছাত্র/ছাত্রী আছে, আবার কিছু কোম্পানিই বন্ধ হয়ে গেল। এপ্রিল এর মাঝামাঝি সকালে নতুন জব থেকে জব টারমিনেশন লেটার দেখে মাননীয় স্পীকার বনে গেলাম। পরে চিন্তা করলাম, আরো একটা অপশন তো আছে, সেটাতে জয়েন করবো।

এপ্রিল এর শেষে এসে ইমেইল দিল, রিক্রুটমেন্ট অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত। ৪ মাস পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ার পর আবার চেষ্টা শুরু, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ।

কারণঃ ১। আমার থেকেও অভিজ্ঞ মানুষ আছে। ২। ব্যাচেলর ডিগ্রী শেষ করে ৩-৪ বছরের ওয়ারকিং স্টুডেন্ট জব অভিজ্ঞতা। ৩। করোনা এর জন্য যারা চাকরি হারিয়েছেন, উনাদের অগ্রাধিকার। ৪। নেটিভ গ্র্যাজুয়েট ৫। প্রযুক্তিগত জ্ঞান এর অভাব।ম্যাক, কে এফ সি, ডমিনোস, স্টারবাক্স এ জব এর জন্য প্রায় ৮-১০টা আউটলেটে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, সুন্দর রিপ্লাই পেলাম ‘es tut mir leid’. H&M থেকে জানিয়ে দিল H&M schließt ab 2021 rund 250 Filialen, leider kein neuer job jetzt.

এরপর গেলাম ডিএইচএল/উপিএস এর জব। শুধুমাত্র একদিন ৮ ঘণ্টা কাজ করে পিঠ এবং কোমরের অবস্থা খারাপ হয়ে গেল, আশে পাশে সব দেখি বিশাল দেহী পাঞ্জাবি না হলে অফ্রিকান মানুষ কাজ করতেসে। নিজেরাই ২৫-৩০ কেজি ওজন এর ছোট ফ্রিজ, টেবিল একলা নিয়ে যাচ্ছেন। তখন আমার-ই বলতে হলো ‘es tut mir leid’।

এই পোস্ট লিখতে লিখতে আর একটি রিজেকশন পেয়ে গেলাম। আমি পাচ্ছি না তার মানে এটা না যে অন্য একজন জব পাচ্ছেন না। কেউ হয়তো এখন পেয়ে যাচ্ছে, আর কেউ হয়তো ৩-৬-৯-১২ মাস পরে পেয়ে যাবে।থাক, ব্যাপার না , আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার গণনা শুরু করি, যদি কেউ ডাকে। 😃

সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। সবার জন্য শুভ কামনা।

mm

By Avi

আমি অভি, Hochschule für Technik und Wirtschaft Berlin এ ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিষয়ে মাস্টার্স করছি ।

Leave a Reply