মাস্ক বিড়ম্বনা
একের অধিক দুই, আর দুয়ের অধিক যেহেতু বহু, তাই বহু বছর ধরিয়া স্বদেশ ত্যাগ করিয়াছি তাহা বলিলে বিশেষ কোন ত্রুটি হইবে না। তবে বহু যে পাঁচকে ছাপিয়া উঠিতে পারে নাহি তাহা আগাগোড়া সুনিশ্চিত। কেননা খানিক দিন পূর্বে পাসপোর্টখানাতে অনুসন্ধান চালাইয়া এতদূর আবিষ্কার করিলাম যে ইহা এখনও নবায়ন করিবার জন্য নিজেকে উপযুক্ত প্রমাণ করিতে ব্যর্থ হইয়াছে। তবে গাঢ় সবুজ এই ছোট্ট পুস্তকটি এতটুকু উপলব্ধি করিবার সাহস যুগিয়াছে যে, অতি স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বার্লিন দূতাবাসের সহিত সখ্যতা গড়িতে হইবে। তা না হইলে বৈধ পরবাসী হিসেবে নিজেকে পরিচয় করবার ক্ষেত্রে পর্বতপ্রমান লজ্জার সম্মুখিন হইবার শতভাগ নিশ্চয়তা রহিয়াছে। কিন্তু ইতিমধ্যে সমস্তকিছুকে ছাপিয়া করোনা ভাইরাস নামক দমকা হাওয়া ইউরোপের আসমান জমিনকে বিদীর্ণ করিয়াছে। ভেনিস, প্যারিস, ব্রাসেলস,বার্লিন সর্বত্রই যেন অদৃশ্য পবন প্রবাহে থরথর করিয়া কাপিতেছে। এই কম্পন পরিমাপ করিবার মত মানদণ্ড এখন অবধি আবিষ্কার হয় নাই। তবে তাহাকে ছেলেবেলার মাষ্টার মশাইয়ের ষষ্টি হস্তে গুরুগম্ভীর অবয়বে উপস্থিত ব্যক্তি বিশেষের সামনে পাঠ্যক্রমে অপারগতা প্রকাশ করিলে যেইরুপ শাস্তি পাইবার উপক্রম হইয়া থাকে তাহার সহিত তুলনা করিলে একেবারে কম যাইবে না। ইউরোপ, দুইডজন দেশসমুহের সমাহার। আমি আপাতত জার্মান মুল্লুকে আসন গারিয়াছি। সমস্ত ইউরোপের জ্ঞানীগুণী বিজ্ঞানী আর দার্শনিকের সমস্ত হালহাকিকত আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে স্থান হইবেনা তাহা অনুধাবন করিয়া গোড়া হইতে আমার স্নায়ু চাপ মুক্ত রহিয়াছে। তবে করোনা কালীন সময়ে জার্মান মুল্লুকের সংবাদগুলির প্রতি দৃষ্টি দিবার প্রয়াসে নিজের চশমার পাওয়ার খনিকটা বর্ধন করিয়াছি। বেশকিছুকাল ধরিয়া জার্মান সরকার রটনা করিয়াছে যে ফেস মাস্ক বাধ্যতামুলক। অনাদায়ে উচ্চহারে জরিমানা গুনিতে হইবে। আর জরিমানা সংগ্রহে ব্যর্থ হইবার গুঞ্জন শুনিলে অন্যরূপ ব্যবস্থা করিয়া তাহার উসুল উঠাইবে। আমরা যাহারা পরবাসী, পরকে করিয়াছি আপন, তাহাদের নিমিত্তে ইহা বৈদ্যুতিক সর্তকবাণী। তো কি আর করার, কাজ কর্মে সামান্য বেরিবাধ দিয়া সুরক্ষা মাস্ক উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলাম। অনলাইনে, অফলাইনে, এনালগ, ডিজিটাল সর্বত্র অনুসন্ধান করিয়া বেলা শেষে রিক্ত হস্তে নিজ গৃহে উপস্থিত হইলাম।
“জার্মান জনগণ, হালকা পাতলা গড়ন, বুদ্ধিতে তোমাদের খ্যাতি অসাধারন”
আমার পরিচিত জার্মান ভদ্রমহোদয়ের সহিত যোগাযোগ স্থাপন করিয়া ইহা উদঘাটন করিতে পারিলাম যে, তাহারা রাতারাতি মাস্কের গুদামঘর স্থাপন করিয়াছেন। ফেস মাস্ক বাধ্যতামূলকের রটনা যে বাস্তবিক ঘটনায় আবির্ভুত হইবে তাহা প্রায়ই নিশ্চিত হইয়াই পরিবর্গের সকল সদস্য নানাবিধ প্রক্রিয়ায় বিপুল অর্থ লগ্নি করিয়া পারিবারিক গুদামঘর সুনিপন হস্তে সাজাইয়াছেন।
প্রায় জনশূন্য স্টুটগার্টের অন্যতম ব্যস্ততম রোড __ কোনিগস্ট্রাসে
মুখের বুক মানে ফেসবুক আর ফেস মাস্ক, এই দুইয়ের মধ্যে একটা মিল আবিষ্কার করিয়া আকাশকুশুম কল্পনায় বিহ্বল হইয়া ক্ষনিকের জন্য রাজার সিংহাসনের একমাত্র অংশীদার হইয়া গিয়েছিলুম। শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করিয়া ফেসবুকে ঢুঁ মারিলাম। ঢুঁ মারিতেই আকাশকুশুম কল্পনায় প্রভাবশালী রাজা মিলি সেকেন্ডের ব্যবধানে সমস্ত রাজ্য বন্দক রাখিয়া হতদরিদ্র প্রজায় নাম লিপিবদ্ধ করিলাম।
প্রথম পোস্টঃ এক ভদ্রলোক তাহার পঞ্জিভুত ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন “স্টক আনএভেলএবল ইন এমাজন”।
দ্বিতীয় পোস্টঃ এক বিদ্যার্থী পাঁচ ইউরোর শত শতাংশ ব্যবহার ঘটাইয়া মাত্র দুইখানা ফেস মাস্ক সংগ্রহ করিয়া অনলাইন বিশ্বে মহাবীর পরিচয়ে পরিচিতি লাভ করিয়া ধন্য হইয়াছেন। তবে তাহার মহাবীর হইবার নিমিত্তে নানাবিধ অনুনয় বিনয়ের গল্প অত্যন্ত ক্ষুদ্র অক্ষরে রচনা করিয়াছেন। অক্ষরের ক্ষুদ্রতা এমন গহীন দশায় পতিত হইয়াছে যাহাকে উদ্ধার করিয়া সাবলীলভাবে পড়িবার মত উপযুক্ত করিতে আতস কাঁচের সাহায্যার্থে ক্রমাগত তদবির চালাইতে হইবে। মহাবীরের এই কৃর্তী সত্যিই মনঃবৃত্তে এক অসমান্য তৃপ্তি যুগিয়াছে।
তৃতীয় পোষ্টঃ এক জার্মান তরুনী ইতমধ্যেই মাস্কের কারখানার আত্মপ্রকাশ ঘটাইয়াছেন। তবে তাহার কারখানার মালিক, কর্মী ও ক্রেতা কেবলমাত্র একজনই। এই যুগান্তকারী স্থাপতি বস্ত্র সংগ্রহ থেকে শুরু করিয়া ডিজাইনিং, মাপামাপি, কাটাকাটি, অবশেষে তৈরী অবধি মাত্র অর্ধ কুড়ি সময়ের ব্যবধানে চাকচিক্যময় মাস্ক প্রদর্শন করিয়া উহার ট্রায়াল পর্বও সম্পূর্ন করিয়াছেন এবং পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ডজনখানেক উপকার ও অপকারের উপসংহার টানিলেন। আমার অবস্থা বুক ফাটিলেও মুখ ফোটেনা স্বরূপ। যুগান্তকারী স্থপতির অসামান্য নির্মানশৈলী অবলোকন করিয়া নিজস্ব একখানা টি-শার্ট নির্বাচন করিয়া ছুরি কাঁচি সহিত ঝাপাইয়া পড়িবার সংকল্প পাকা করিলাম। কিন্তু নিজের সামর্থ্যের উপর আস্থা হারাইয়া এই পরিকল্পনা হইতে নিজেকে চিরতরে নিঃভৃত করিলাম। কেননা ছুরি, কাঁচির যথার্থ ব্যবহারের প্রমান না মিলিলে দুঃস্প্রাপ্য মাস্কের পরিবর্তে হাসপাতালের অনুসন্ধান চালাইতে হইবে। কেন জানি মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম করোনা ভাইরাস হইলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যেথায় সকল দেশ অংশগ্রহন নিশ্চিত করিয়াছে, ইচ্ছায় নয়তোবা অনিচ্ছায়। যে যুদ্ধের জন্য প্রকাশ্যে কোনরূপ হিংসা বা কলহের প্রয়োজন হয় নাই। কিন্তু সকল দেশ, অঞ্চল, পাড়া-মহল্লা, ছোট বড় সকলেই তাহার ভুক্তভোগী। করোনা ভাইরাস এমন এক অস্ত্র, যাহা স্থান কাল পাত্র সমস্ত কিছুকেই রক্ত চক্ষু দেখাইয়া শক্তিশালী আসনে আসন গড়িয়াছে। এই অদৃশ্য যুদ্ধের সূচনা রচিত হইয়াছে চীনে, আর উপসংহার কোথায় তাহা সম্পর্কে বিশ্বভ্রমান্ডের মহান অধিপতিই উত্তম জ্ঞানের অধিকারী। মনের এই ভাবনার ছন্দে হঠাৎ পতন ঘটিয়াছে মোবাইল ফোনের আচমকা ধ্বনি। মোবাইল ফোনের ভার্চুয়াল দেয়ালে মিষ্টার জামান নামের একজনের নাম আন্দোলিত হইতেছে। মিষ্টার জামান উনাকে আমি জামান আঙ্কেল হিসেবে পরিচয় প্রতিষ্ঠায় ধন্য হইয়াছি। উনি জার্মান মুল্লুকে তিনযুগের অধিক সময়ব্যাপী বসবাস স্থাপন করিয়াছেন। আপাদমস্তক খাঁটি বাঙ্গালী, নম্র, ভদ্র ও বিনয়ী ষাট উর্ধ্বে বয়সের অধিকারী। উনি প্রায় সময়ই বিদ্যুৎ মারফৎ আমার খোঁজখবর রাখিয়া থাকেন। ইহা তাহার স্নেহশীল হৃদয়ের উষ্ম বহিঃপ্রকাশ। তাহার শতমুখী ব্যস্ততার মাঝে আমার প্রতি এইরূপ স্নেহতরী সত্যিই পৃত্রির আসনের ন্যায় সাঁঝের গগনে উজ্জল তারকারাজী।
মোবাইল ফোনের সবুজ বাটন স্পর্শ করিতেই ভাসিয়া আসিল তাহার কণ্ঠ। নানাবিধ সমস্ত কুশলাধির পর্ব খতম করিয়া জানিতে চাহিলেন ফেস মাস্কের রটনা যে বাস্তব ঘটনায় প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে তাহাতে আমার টনক নড়িয়াছে কিনা। আমার টনক যে ষোল আনা নড়িয়াছে তাহা বিবৃত করিলাম এবং উহার সহিত মাস্ক সম্পর্কে আমার যাবতীয় কার্যাবলীর বিস্তারিত বিবরণ দাখিল করিলাম। আমার এই মর্মান্তিক বর্ণনায় হাসিবেন না কাঁদিবেন তাহারই মধ্যকার গোলকধাঁধায় নিপতিত হইয়া কালের অতল গর্ভে কিছুকাল নীরবতা পালন করিলেন। অবশেষে নীরবতার ধর্মঘট ভঙ্গ করিয়া “খাইন প্রব্লেম” (কোনো সমস্যা নাই) বলিয়া আশার বাণীতে আশস্ত করিলেন। উনি স্থান ও কাল ইত্যাদির ফর্দ সাজাইয়া আমাকে মাস্ক সংগ্রহের অবর্ণনীয় সুযোগ দান করিলেন। ফেস মাস্কটা আমার অনিবার্য হইয়া পড়িয়াছিল কেননা প্রায় অর্ধ হালি মাস গৃহের কুঠুরিতে অফিস কার্যাবলী চুলায় দিয়া অফিসে বসিয়া অফিস করিবার জোরালো তাগিদ আসিয়াছে। বছরের গোড়ার দিকে পাঠ চুকাইয়া অসীম করুনাময়ের বিশেষ রহমতে কোনরূপ পাদুকা ক্ষুর ক্ষয় না করিয়াই একখানা কর্ম পাইয়াছিলাম। তাই বিধাতার দরবারে অপরিমেয় কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া জানাইয়া সন্তুষ্ট হইলাম। পনেরো মিনিট হাতে থাকিবে এমন অঙ্ক কষিয়া নিত্যদিন গৃহ হইতে প্রস্থানের সুর বাজাই। যানজটের ঝামেলা নাহি বলিয়া আমার অঙ্কের হিসাব নিত্যদিনই বরাবর মিলিয়া যায় অর্থাৎ পনেরো মিনিট পূর্বেই কর্মস্থলে হাজির। এ যেন পাঠশালার ফাস্টবয় যাহাতে নাহি পরীক্ষার ভয়। আমার অন্যান্য সহকর্মীরা কর্মে যোগদান করিয়া থাকেন বেলা নয়টার পূর্বেই তবে উল্লেখ থাকে যে দুই কিংবা চার মিনিট পূর্বে। ইহা যেন ঘড়ির ত্রিদন্ড মাপিয়া মাপিয়া চলা জীবিত এক যন্ত্রাংশ। ঢাকার সর্প সদৃশ রাস্তাসমূহে আমার কৈশোর ও যৌবনের অনেক স্মৃতিবিজড়িত মুহূর্ত অতিবাহিত করিয়াছি তবে গাণিতিক হিসাব কোনো দিবসেই শতভাগ পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। কোনো দিবসে অতিঅগ্রে গন্তব্যে পৌঁছিয়াছি যাহা ভাবনায় আনিলে নিজের সহিত নিজেই প্রবঞ্চনা করিয়া থাকি। আবার কোনো দিবসে এত পশ্চাতে পৌঁছিয়াছি যেথা কর্তৃক গৃহের উদ্দেশ্যে পূনরায় তড়িৎগতিতে রণ সাজাইয়াছি। জার্মান সরকার ঘোষণা করিয়াছে যে, সমস্ত প্রকার জনবহুল স্থানসমূহে মাস্ক ব্যবহার করিতে হইবে বিশেষভাবে বাজারঘাট, বিপণিবিতান, গণপরিবহন ও ধর্মীয় উপসনালয়গুলিতে। ঘোষণা পড়িয়া এই ভাবিয়া পণ করিলাম যে ইহজীবনে মুখমন্ডল হইতে মাস্কের কোনো নিস্তার নাহি কেননা কোনটি জনবহুল আর কোনটি বিলাসবহুল এই দুইয়ের পার্থক্য নিরুপনে ব্যর্থ হইলে অর্থদণ্ড গুনিতে হইবে। আর যদি অর্থদণ্ড কয়েকবার গুনিতে হয় তাহলে অনাদায়ের শাস্তিকেই পুস্পমাল্যে অভ্যর্থণা জানাইতে হইবে। অনাদায়ে শাস্তি যে আমার ন্যায় শীর্ণকায় স্বাস্থমন্ত্রীর ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি বলিয়া গণ্য হইবে তাহা বুজিতে অসুবিধা হইল না।
অফিসের কার্যাবলী নিত্যদিনের ন্যায় প্রবাহমান ধারায় চলিতেছিল যেমন মিটিং, কোডিং, গল্প, মধ্যাহ্নভোজ ইত্যাদি ইত্যাদি। অকস্মাৎ একদিন আমার এক সহকর্মী মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে মাস্ক সম্পর্কে এক হৃদয় বিদারক বর্ণনা পেশ করিয়া হালকা হইলেন। তাহার এক পরম বন্ধু, যিনি ছাত্র হিসেবে এখন অবধি সরকারি পুস্তকে গাঢ় দোয়াতের কালিতে লিপিবদ্ধ। তাহার সুহৃদ ত্রুটি হেতু তথা মনের সংকল্পের বিরুদ্ধে না গিয়া মাস্ক লটকাইতে সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। আর তাহার এই চমকপ্রদ দৃশ্যে জার্মান পুলিশের নয়ন জুড়িয়েছে। শিকারের গন্ধে ক্ষীণ ক্ষীণ ছন্দে পুলিশবাহিনী একেবারে শিকারের সম্মুখে আত্মপ্রকাশ ঘটাইলেন। শিক্ষার্থী বলিয়া হৃদয়কোণে একখানা প্রদীপ জ্বলছিল কিন্তু জ্বালানির ঘাটতির কারণে তাহা সামান্য ফুঁৎকারে ধপাস করিয়া নিভিয়া গেল। শতমুখী অনুনয় বিনয়কে জলে ডুবাইয়া একশত পঞ্চাশ ইউরো জরিমানা গুনিয়াছে। এই সংবাদ শুনিবা মাত্রই আমি পকেট হইতে ইউরোকে টাকায় রূপান্তর করিবার মেশিন বাহির করিলাম। মেশিনখানা মস্ত বড় এক হিসাব দাড় করাইল যাহা পনেরো হাজার টাকায় রূপ নিয়া আমায় উদ্ধার করিল। হিসাব দেখিয়া চোখ চড়কগাছ বনিয়া গেল। মাস্কের গুরুত্ব যথার্থ বুজিয়াছি, যাহা কিনা আমার মোবাইল ফোনের চাহি দামী। যদিও উহাতে সুতার অস্তিত্ব ব্যতীত অন্য কিছুই আবিষ্কৃত হয় নি। আমি আমার সহকর্মীর মাস্ক বিষয়ে আগ্রহ অনুসন্ধান করিলে সে তাহার মহামূল্যবান ব্যাগ খুলিয়া মাস্কের আতুরঘর দেখাইয়া ধন্য হইল। মনে মনে ভাবিতেলাগিলাম বিধাতা তাহাকে ইঞ্জিনিয়ার না বানাইয়া গার্মেন্ট কোম্পানির সর্বেসর্বা বানাইলেও কম যাইতনা। যাই হোক সংবাদ পরিবেশন উপলক্ষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিয়া প্রস্থান করিলাম ও ভবিষ্যতে সতর্ক হইবার অনুপ্রেরণা যোগাইলাম। পরের দিন প্রভাতে ঘুম ভাঙ্গিতে খানিকক্ষন বিলিম্ব হইল। তাই হন্তদন্ত করিয়া সমস্তকিছু পরিপাটি করতঃ সাহেব বাবু সাজিয়া গৃহ হইতে চম্পট দিলাম। কিন্তু ইতোমধ্যেই বাসের কর্মসূচীর সহিত নিজের কর্মসূচীকে না মিলাইবার দরুন নিত্যদিনের নিত্যসঙ্গী বাস আমাকে টাটা জানাইল। পরবর্তী বাসের সহিত সম্পর্ক গড়িলে অতিরিক্ত কুড়ি মিনিট তোরণ সাজাইয়া অপেক্ষা করিতে হইবে যাহার ফলাফলস্বরূপ বিলম্বে অফিসে উপস্থিত হইতে হইবে অধিকন্তু প্রতিদিনের ফাস্টবয় লাস্টবয় হিসেবে আত্মপ্রকাশ লাভ করিবে। তাই প্ল্যান বি (ট্রেন স্টেশন) বাস্তবায়নের জন্যে মনোযোগী হইলাম। ট্রেনকে সুপারম্যানের ন্যায় আটকাইবার লক্ষে ট্রেন স্টেশনের প্রতি পদদ্বয় অশ্ববেগে চালিত করিলাম যাহা মাত্র সাত মিনিটের পথ। ট্রেনও আসিল আমিও হাজির হইলাম। একে একে প্রত্যেকেই মুখে মাস্ক আটিয়া বিদ্যালয়ের সুশৃঙ্খল ছাত্র-ছাত্রীর ন্যায় ট্রেনে উঠিতেছে আমিও উঠিব কিন্তু কি যেন পশ্চাৎ হইতে আমাকে কষিয়া টানিয়া ধরিল। হায়!! হায়!!, আমিতো মস্ত বড় ভুল করিয়াছি, আমিতো অতীব মূল্যবান দুষ্প্রাপ্য মাস্ক বহন করিতে ব্যর্থ হইয়াছি। তাই দুরন্ত ট্রেনে উড়ন্ত হাওয়ার সন্ধানে ব্যর্থ হইয়া প্রকৃতির নিঃস্তবতায় আপনাকে বিলীন করিয়া দিলাম।
নিরুপায় হইয়া একশো আশি ডিগ্রী কোণে বদন ফিরাইয়া গৃহের প্রতি পাল তুলিলাম। সাত মিনিটের ব্যবধানে গৃহে আগমন করিয়া মাস্কটাকে গৃহ হইতেই মুখমন্ডলের সহিত সজোরে চাপা দিয়া আবার ট্রেন স্টেশনের দিকে মনোযোগ ত্বরান্বিত করিলাম। মিনিট তিনেকের মধ্যে যথাবিধি ট্রেন আসিয়া উপস্থিত হইল আমিও তাহাতে নির্ভয়ে চড়িলাম। তবে মনের সহিত যে একটা শীতল যুদ্ধ চলিতেছে তাহা হারে হারে উপলব্ধি করিলাম। যুদ্ধে একবার বিজয়ী হই আবার পরাজিতও হই। ভুলবশত মাস্ক বহনে অপারগতা, সেই রায়ে বিজয়ী; অপরদিকে অতিপ্রয়োজনীয় বস্তুকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, সেই রায়ে দণ্ডহীন আসামি। মন:দন্ডে দন্ডিত হইয়া খানিকটা বিলম্বে অফিসে প্রবেশ করিলাম আর ভাবিতেলাগিলাম যে, নিত্যদিনের ফাস্টবয়ের ক্রমিক নাম্বার এক ধাক্কায় লাস্টবয়ে পদচ্যুতি ঘটিবার দরুণ সহকর্মীদের ত্রিশূল দৃষ্টি হইতে নিজেকে রক্ষার জন্যে কোন ধাতুর আলখাল্লা পড়িলে উপযুক্ত বলিয়া গণ্য হইবে। কিন্তু প্রবেশ প্রারম্ভেই আমার অক্ষিদ্বয় ছানাবড়া হইয়া উঠিল। সারা অফিস জনশূন্য যেন গোরস্থানের নীরবতা বিরাজ করিতেছে। আমি মুহূর্তের মধ্যেই অন্য কোথাও দৃষ্টি না দিয়া নিজস্ব কক্ষে প্রবেশ করিলাম আর দিনপুঞ্জিতে বজ্রবেগে অত্যন্ত গভীর একাগ্রতার সহিত দৃষ্টি সঞ্চালন করিতেছি এই ভাবিয়া যে, আজকে হয়তবা বিশেষ কোনো ছুটির দিন কিন্তু আমার সেই ভাবনা কড়ায়-গণ্ডায় ভুল প্রমানিত হইল। কেননা ঐ মাসের ঐ দিবস হইতে অগ্র ও পশ্চাৎ উভয়দিকেই সরকারী ছুটির দিবস কমপক্ষে অর্ধ মাসের ব্যবধান। এরমধ্যেই একজন অফিসে প্রবেশ করিয়াছে___
ফ্রাউ ভাগ্নার: গুটেন মরগেন, হোসাইন (সুপ্রভাত হোসাইন)
আমি: গুটেন মরগেন, ফ্রাউ ভাগ্নার (সুপ্রভাত ফ্রাউ ভাগ্নার)
ইনি বিলম্ব করিয়া আসিবার কারণে তাহার অপরাধী চেহারার বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট হইয়া উঠিল। একটু পরেই আরেকজন ___
মুলার: গুটেন মরগেন, হোসাইন (সুপ্রভাত হোসাইন)
আমি: গুটেন মরগেন, মুলার (সুপ্রভাত মুলার)
একে একে সহকর্মীরা মৌমাছির ন্যায় আসিতে লাগিলেন। আমরা সকলেই কফি পানের নিমিত্তে কফি কক্ষে উপস্থিত হইলাম। আর এতদূর আবিষ্কারে সামর্থ্য হইলাম যে, আজকে কেন্দ্রীয় ট্রেন লাইনে ত্রুটির কারণে প্রত্যেকেরই ট্রেনে চড়িতে অসুবিধা ও বিলম্ব হইয়াছে। ফ্রাউ ভাগ্নার সহসা হাকাইয়া উঠিয়া কহিলেন যে, তিনি সর্বপ্রথম অফিসে পদার্পন করিয়াছেন তবে আমি যে অফিসে বহাল তবিয়তে ছিলাম তাহা তিনি আক্ষেপের সহিত রচনা করিলেন। তাই উনার দ্বারা যে অফিসের সর্বাগ্রে জন নীরবতা ভুন্ডুল হয়নি তাহা প্রমাণে সার্থক হইলেন। সকলেই বলিতে লাগিল আমি খুবই সময়ানুবর্তী, নিয়মানুবর্তী, বিলম্ব নামক কোনো শব্দ আমার অভিধানে ঠাঁই নাই, এই সেই কত কি বিশেষণে বিশেষিত হইয়া যেন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির নায়ক হইয়া উঠিলাম। তদবিষয়ে প্রত্যেকের ন্যায় আমিও মুখ খুলিতে উদ্যত হইলাম কিন্তু আমার স্নেহময়ী মাতার একখানা অমর বাণী হৃদয়কোনে বারং বার আন্দোলিত হইতে লাগিল।
“বোবার কোন শত্রু নাই”
উক্তিখানার মর্মাথ উপলব্দি করিয়া একটা চরম সিদ্বান্তে উপনীত হইলাম। অন্ততঃ আজকের দিনের জন্য নিজের টুঁটি খানিকটা চাপিয়া ধরিয়া কয়েক মিনিট বোবা সাজিয়া শান্ত থাকিলাম। অবশেষে আস্তে আস্তে কফির পেয়ালায় চুমুক তুলিয়া ডাংকে ডাংকে (ধন্যবাদ) বলিয়া কাটিয়া পড়িলাম আর নিজস্ব কর্মে নিবিষ্ট হইলাম।
আমিমুল হোসাইন
সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার
স্টুটগার্ট, বিশ্ববিদ্যালয় (প্রক্তান শিক্ষার্থী)
স্টুটগার্ট, জার্মানি।