বার্লিন, পৃথিবীতে এক বিখ্যাত শহরের নাম। বিশ্ববহ্মাণ্ডে দুটি বিরাট যুদ্ধ হয়েছে, কোটি প্রাণের মৃত্যু হয়েছে। এমন দুটি অস্বাভাবিক যুদ্ধেরই কারিগর এই বার্লিন শহর। যুদ্ধ শেষে অতি দ্রুত আবার আগের স্থানে ফিরে গিয়ে রুপ-যৌবনে চিরলাবণ্যলাভ করেছে এই শহর। পৃথিবীতে পুনরায় শক্তিশালী জার্মানি প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হয়েছে এই বার্লিন থেকেই। যুদ্ধের দামামা নেই সেই কবে থেকেই, এই নগর এখন সুন্দর-সৌন্দর্য, অপরুপ-ঐশ্বর্য্য, শিল্প-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সীমাহীন ভোগ-উপভোগের শহর। প্রতিনিয়ত এই শহরে কত কিছু হয়, যা পৃথিবীর আর কোথাও হয় না। শুক্রবার শেষ হলেই সপ্তাহান্তে এই শহরের ৩০০ টির মত ক্লাব তো বটেই, সড়কের আনাচে কানাচে সংখ্যাহীন ছোটখাট পানশালা, অপেরা, ডিস্কোবার হয়ে উঠে নাগরিকদের মনোবিনোদনের কেন্দ্র।

শিরোনাম দেখে যারা লেখাতে ঢুকেছেন এবং আশা করছেন কখন যৌনতা নিয়ে আলাপ শুরু করবো তাঁরা ধৈর্য ধরুন, সবুরে মেওয়া ফলতেও পারে। তার আগে আমরা সংক্ষেপে জেনে নিতে চাই বেলা ডুবে গেলে, রাতের আঁধারে উর্বশী বার্লিনে কী কী হয়, কোথায় কী কী করা যায় ইত্যাদি। বলছিলাম বার্লিনে ক্লাবের সংখ্যা ৩০০ টি’র মতো, রাতের গল্প করতে গেলে এগুলোর কথাই আসবেই। 

গ্রীষ্মে দুপুরের পরপরই জমতে শুরু করে ক্লাবগুলো। মাঝে মাঝে পোশাকে আশাকে থাকে থিম। একবার এক ক্লাবে গিয়েছিলাম যেখানে বেশিরভাগ নারী পুরুষ পঞ্চাশের দশকের পোশাক পরে ঘুরছে, মাঝে আমি এক বলদ বাঙ্গাল ভাঁড় হয়ে বসে রইলাম। আমার পরনে ঢোলাঢালা টি-শার্ট। তবে পোশাকের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি নেই, থিম মেনে পোশাক না পরলেও কেউ জাজ করবে না। এটিই বার্লিনের সৌন্দর্য। মুক্তমনে যা ইচ্ছা করা যায়, পরা যায়। ডান্সক্লাবগুলোতে লোকজন একটু দেরিতে আসে সারা রাত ধরে মদ্যপান আর উদ্যাম নৃত্যগীতে বুঁদ হয়ে থাকতে। এমন কিছু বিখ্যাত ক্লাবের মধ্যে Berghain, Tresor, Matrix, Renate, SchwuZ, Anomalie Art Club, KitKat ইত্যাদি। কিছু কিছু ক্লাব শুধুমাত্র বিষমকামীদের (straight) জন্য, কিছু শুধুমাত্র সমকামীদের (Homosexual) জন্য। উভকামী (Bisexual) আর রুপান্তরকামীদের (Transgender) জন্যেও আলাদা আলাদা ক্লাব রয়েছে। কিন্তু এসব ক্লাবে যে কেউ যেতে পারে, তার জন্যে সুনির্দিষ্ট কোন জেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে না। তবে বিশেষ কিছু ক্লাবের বিশেষ কিছু দিন থাকে, যেখানে কিছু বাধ্যবাধকতা থাকে। যেমন ধরুন ন্যুড ক্লাব, সেখানে গেলে শরীরের কাপড় খুলেই যেতে হবে। অসংখ্য সেক্স ক্লাব রয়েছে, সেখানে গেলে আপনাকে যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েই যেতে হবে। এছাড়া ফেটিশ, জম্বি, যাজকের বেশ ধরেও অনেক স্থানে পার্টি হয়। তবে যেখানে যাই হোক না কেন, বার্লিনের সবস্থানে একটা হৃদয়কাড়া শৈল্পিক ছোঁয়া থাকে। এমনি এমনি তো বার্লিনকে সংস্কৃতি আর সৃষ্টিশীল শিল্পের রাজধানী বলা হয় না!

Berghain ক্লাবের কথা বিশেষভাবে বলতে হবে। এটি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্লাব নির্বাচিত হয়েছে বহুবার। পৃথিবীর বহু দেশ থেকে মানুষ বার্লিনে আসে শুধুমাত্র এই ক্লাবে পার্টি করতে। এটির আকার প্রকাণ্ড যেখানে একসাথে প্রায় হাজার দুয়েক লোক একত্র হতে পারে। এখানে আছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সাউন্ড সিস্টেম আর অসাধারণ ইন্টেরিওর ডিজাইন। সপ্তাহান্তে টানা তিনদিন এখানে পার্টি হয়, একটা বড় অংশ শুক্রবার রাতে ঢুকে সোমবার সকালে বের হয়। এই ক্লাবে ঢোকা স্বর্গে ঢোকার থেকেও কঠিন। ৩ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে দরজা থেকে ফিরিয়ে দেয়া খুবই কমন দৃশ্য। কারণ ব্যাখ্যা করা ছাড়াই ঢুকতে দেবে না- এই মানসিকতা নিয়েই মানুষ ওখানে যায়। 

এই ক্লাবে আমার কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে চাই। আমাদের কলিগ আন্দ্রেয়াস চাকরি ছেড়ে চলে যাবে ২০১৯ এর গ্রীষ্মে। যাবার আগে সবাইকে একবেলা পান করিয়ে যাওয়া এখানে নিয়ম। সিদ্ধান্ত হল সহকর্মীরা সকলে মিলে এই বার্গহাইনে (Berghain) যাবে। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর সবথেকে বেশি কঠিন এই ক্লাবে ঢোকা। ভাগ্যের দেবতা সেদিন সুপ্রসন্ন ছিলেন, আমরা ঢুকতে পেরেছিলাম। সবাই যার যার পানীয় সংগ্রহ করে নাচানাচি আরম্ভ হল সাথে কড়া টেকনো মিউজিক। আমাদের একজনকে দেখলাম কাপড় সব খুলে রেখে শুরুমাত্র অন্তর্বাস পরিধান করে ঝলঝলে ভুঁড়ি দুলিয়ে নাচছে। নারী সহকর্মীরাও ইচ্ছামত পোশাক পরিধান করে লাফালাফি শুরু করে দিল। এর মধ্যেই আমার সাথে পেছনের একজনের হালকা ধাক্কা লাগল। আমি সরি বলতে মাথা ঘোরালাম। এরপর যা দেখলাম একটু হলে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলাম। একজোড়া কপোত কপোতি শতশত মানুষের নাচানাচির মধ্যেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যৌনকর্মে লিপ্ত হয়েছে। গায়ে কোন কাপড় নেই, কেউ ভ্রুক্ষেপও করছে না! 

অধিক পান করলে ঘন ঘন মূত্রবিসর্জন দিতে হয়। চিপা চাপা দিয়ে টয়লেটে গিয়ে যা দেখলাম, বাকি জিন্দেগীতে ভুলবো না। দেখি তিনজন পুরুষ মিলে একজন নারীর মুখে মূত্র বিসর্জন করছে। ওখানে আরো নারী ও পুরুষ বসে থাকে আপনার মুত্রপান করতে। একটা পুরুষের গ্রুপ দেখলাম মুখলেহন (blowjob) করার জন্যে বসে আছে, যার ইচ্ছা হচ্ছে যাচ্ছে ওখানে। আলো আঁধারি পরিবেশ, অসংখ্য টয়লেট, কোনায় কোনায় মানুষ বসে আছে এইসব অফার দিয়ে। অন্য একটা গ্রুপের কাজ হল একটা অভিনব প্রতিযোগিতা। তাঁরা একটা বাটিতে পুরুষের স্পার্ম (বীর্য) সংগ্রহ করে এক ঢোকে গিলে খায়।    

ক্লাবের এসব একটি দিক, আরো অন্য অনেক দিক নিশ্চয়ই রয়েছে। উপরে যে বর্ণনা দিলাম, তাঁর থেকেও খোলামেলা ক্লাব বার্লিনে রয়েছে। তবে বার্গহাইন ক্লাবটি বার্লিনের সাংস্কৃতিক বিবর্তনে ভূমিকা রেখে চলেছে। তাই ২০১৬ সালে বার্লিনের একটি আদালত সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বিবেচনায় ক্লাবের ট্যাক্স ১৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৭ শতাংশ করার নিদেশ প্রদান করে।

লেখার নিয়ম হল একসময় থামতে হবে। লেখার এ পর্যায়ে এসে তথ্য আর তত্ত্বের প্রণয় ঘটিয়ে, কিছু জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে লেখা শেষ করাই যায়। বলাই যায়, ব্যক্তির শরীরে অধিকার একমাত্র সেই ব্যক্তিরই, সেই শরীর নিয়ে সে কি করবে এটি একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার, সেটি মানবাধিকারের সমান, অথবা যৌনতা এমন একটি বিষয় তা যত নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হবে, তত বিকৃত যৌনচিন্তা নিয়ে মানুষ বেড়ে উঠবে– এই টাইপ কিছু জ্ঞান দিয়ে লেখা শেষ করতে পারতাম। কিন্তু যে বাঙ্গালি জাতি বিশ্বাস করে তাঁরা সবাই কলাগাছ ফেটে জন্ম নিয়েছে, অথবা আকাশ থেকে পড়েছে ঈসা নবীর মত, তাঁদের যৌনতার ইতিহাস কেমন ছিল গত দুইশ বছরে সেই বাঙ্গালির যৌনতা নিয়ে পরবর্তী কিস্তি লেখার প্রত্যাশা রেখে আজকের পর্বের সমাপ্তি টানলাম এখানেই।

৩০ বৈশাখ ১৪২৮
ধন্যবাদান্তে
জাহিদ কবীর হিমন, বার্লিন থেকে
সম্পাদক, জার্মান প্রবাসে

আরো পড়তে ক্লিক করুন-
বার্লিনের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ ১- কোরিয়ান খাবার-উৎসব
বার্লিনের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ ২- মধুরেণ সমাপয়েৎ
বার্লিনের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ ৩- বার্লিন-ড্রেসডেন যুদ
বার্লিনের নীলাকাশে ঝকঝকে রোদ ৪- পিকনিক আর সঙ্গীতসন্ধ্যা

mm

By Jahid Kabir Himon

এডিটর (Editor): জার্মান প্রবাসে মাস্টার্স in Internet Technologies And Information Systems Leibniz University Hannover বর্তমানে বার্লিনের একটি কোম্পানিতে রোবটিক্স প্রোসেস অটোমেশনে (RPA) কাজ করছি

Leave a Reply