মাত্র ALH স্যার এর কুইজ দিয়ে বের হয়েছি। ২৪ টা ক্লাসে ২৩ টা কুইজ! মাত্র দুটো শেষ হয়েছে, আরও ২১ টাই বাকি, মাথা অতি গরম। বাকি কোর্সগুলার কথা বাদি দিলাম, কিভাবে এই সেমিস্টারে বেঁচে থাকব ভাবতে ভাবতে স্টার টাওয়ার থেকে বের হলাম, কামাল-আতাতুর্ক এভিনিউ দিয়ে হাঁটছি। দুপুর ২:৩০ বাজে, মাথার উপর তপ্ত রোদ, সামনে ব্যাস্ত রাস্তা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে, হাই জাম্প, লং জাম্প করে রিক্সা, গাড়ি, সিএনজি, ডিভাইডার নিংড়িয়ে নিংড়িয়ে রাস্তা পার হচ্ছি। গন্তব্য সাউথ-ইস্ট ব্যাঙ্কের সামনে রাবার গাছের তলায় ঝালমুড়ি মামু। বিশ্বের সর্ব-শ্রেষ্ঠ ঝালমুড়ি ওখানেই পাওয়া যায়। ঝালমুড়ি মামু্র বিশাল সাইজের ডালা, লালসালুর মত লাল কাপড়ে মোড়ানো। মামুর ডালাটা বোটানিক্যাল গার্ডেনের মত, হাতে ভাঁজা লালচে মুড়ি, ইউরিয়া দিয়ে ভাঁজা সাদা ধবধবে মুড়ি, খুদের চাল দিয়ে ভাঁজা ছোট-ছোট, সাদা-কালো শক্ত-শক্ত মুড়ি (কামর দিলে দাঁতে ব্যাথা হয়), ঘুগনি, ছোলা আরও কত কিছু দিয়ে সাজানো। ডালার মাঝখানে ছোট্ট বাটিতে জ্বালান আগর বাতিটা যেন বাগানের ফোয়ারা! কি সুন্দর ঘ্রান, আহা! দূর থেকে দেখলেই ক্ষুধা লেগে যায়, আর কাছে গেলে জিভ দিয়ে লালা ঝরে! আমি রাবার গাছের তলায় গিয়ে লালা ঝরাতে ঝরাতে মামাকে বললাম-
“মামা, ইউরিয়া মুড়ি, ১০ টাকার”।
মামা বললেন-“ঘুগনি না ছোলা?”
আমি বললাম, “ছোলাই দেন, ইফতারি ইফতারি লাগে!”
মামা বললেন-“ঝাল বেশি না কম?”।
আমি বললাম, ”ঝাল দিয়া ফাটায় দেন!”
মামা মাথা ঝাকিয়ে “আইচ্ছা” বলেই কোমরে গামছা বাঁধলেন, এরপর লাল টকটকে বোম্বাই মরিচটা কচকচ কচকচ করে কাটা শুরু করলেন। একটা প্লাস্টিকের গ্লাসে একমুঠো ছোলা, দু চা’চামচ পিঁয়াজ কুচি আর মরিচ ঢেলে কাঠি দিয়ে দুটো নাড়া দিলেন। এরপর দু মুঠো মুড়ি, এলাচ লেবুপাতা কুচি, আচাড়ের তেল, লবন আর কোঁচলে কোঁচলে চার ফোটা লেবুর রস ঢেলে দিলেন। ব্যাস! এর পরেই মামা কসরত শুরু করলেন। ডান হাতে গ্লাসটা ধরে বাম হাতের তালুতে তবলা বাজানোর ছন্দে বারি দিয়ে দিয়ে মুড়ি মাখাচ্ছেন! যেন ঢোল বাজাচ্ছেন! আমিও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে গাইতে থাকলাম, “ছন্দে ছন্দে দুলি আনন্দে, আমি বনফুল!”
মুড়ি মাখানো শেষ হয়েছে, আমিও মাথা দোলানো বন্ধ করলাম। মামা ঠোঙ্গায় মুড়ি ঢাললেন, আমিও নাচতে নাচতে হাত বাড়ালাম। কিন্তু হায়, আমি কিছু বলার সুযোগই পেলামনা, আমার চোখের সামনে ঠোঙ্গাটা আরেক জনের হাতে চালান হয়ে গেলো! আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম! চিলের মত ছো দিয়ে মুড়ি নিয়া ব্যাক্তিতি একজন বিড়ি ম্যান, আমার আগে অর্ডার দিয়ে ড্রেইনের পাশে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল! কি আশ্চর্য! বিড়ি ম্যান বাম হাতে ঠোঙ্গাটা নিলেন, ডান হাতে মুড়ি ঢাললেন, এরপর মুখে চালান করলেন। আমার চোখ দুটোও মুড়িগুলোতে আটকে গেলো। প্রথমে মামার হাত থেকে বিড়ি ম্যানের হাতে, বিড়ি ম্যানের হাত থেকে তার বিড়ি গন্ধ যুক্ত মুখে… বিড়ি ম্যান মুড়ি চাবাচ্ছেন, তার থুতনি উপর নিচ করে, আমার চোখও উপর নিচ করে, বিড়ি ম্যান মুড়ি গিলে, আমিও ঢোক গিলি। ধুর, বিড়ি ফুকছিলি, ফুক, আমার মুড়ি নিলি কেন? মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো, মনে হচ্ছিল বিড়ি ম্যানের ঘেটি ধরে ড্রেইনে ফেলে দেই…যাইহোক, মামা আবার মুড়ি মাখানো শুরু করলেন, কিন্তু আমার তো আর তর শয়না! মনে হচ্ছিল যেন মামার মুড়ির ডালাটাই খেয়ে ফেলি! বহু কষ্টে নিজেকে সামলালাম। অধীর আগ্রহে মুড়ির জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছি, কিন্তু ঝাল মুড়ি আর আসেনা…আমার সময় কাটেনা, এক একটি মুহূর্ত যেন এক একটি যুগ। প্রচণ্ড অস্থিরতায় ওপাশ-এপাশ করছি…
হঠাৎ ঝাকি দিয়ে ঘুম ভেঙ্গে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করলাম। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার, কোথায় আছি বুঝতে পারছিনা! মাথার কাছে হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা খুজে বের করলাম, মবাইলের টর্চ জালিয়ে দেয়াল ঘড়িটা দেখলাম। রাত ২:৩০ টা বাজে! ঘড়ি দেখে হুশ এল, স্বপ্ন দেখছিলাম এবং বর্তমানে আমি একটি “বা*র” দেশে আছি যেখানে ঝাল মুড়ি মামু নাই। কিন্তু আমার তো ঝাল মুড়ি চাই-ই-চাই। বিড়ি ম্যানের উপর রাগটা তখনও কমেনি। একমাত্র মুড়িই পারবে রাগটা কমাতে, আর কোন কিছুই না! নিজেই নিজের সাথে কথা বলতে থাকলাম।
“আচ্ছা, বাসায় কি মুড়ি আছে?”- “হুম, আছে”
“মরিচ,পেঁয়াজ?”-“আছে”
“টমেটো?”-“আছে আছে”
“এলাচ লেবু”-“না, নাই! তাতে কি?”
“হুম…এত রাতে ঝাল মুড়ি মাখালে কি মহা ভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?”-“নাহ! মোটেই না!”
“সো?”- “এখনি তোমাকে মুড়ি খেতে হবে, আই মিন, ঝাল মুড়ি!”
……যে কথা সেই কাজ…রাত দিন বুঝিনা, কাজ কর্ম গোল্লায় যাক। আমি ঝাল মুড়ি খেয়ে তবেই শান্ত হব। মানুষ খেয়েও মোড়ে, না খেয়েও মরে। আমি না হয় খেয়েই মরলাম। ওম শান্তি ওম…।