মুন্সি আব্দুর রউফ
মুন্সি আব্দুর রউফ | |
---|---|
জন্ম | ১মে, ১৯৪৩ সালামতপুর, ফরিদপুর |
মৃত্যু | এপ্রিল ৮, ১৯৭১ বুড়িঘাট, মহালছড়ি |
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
বংশোদ্ভূত | বাঙালি |
নাগরিকত্ব | বাংলাদেশ |
যে জন্য পরিচিত | বীরশ্রেষ্ঠ |
ধর্ম | মুসলিম |
মুন্সি আব্দুর রউফ(১৯৪৩ – এপ্রিল ৮, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠউপাধিতে ভূষিত করা হয়।[১]
পরিচ্ছেদসমূহ
সংক্ষিপ্ত জীবনী[সম্পাদনা]
মুন্সি আব্দুর রউফের জন্ম ৮ই মে ১৯৪৩, ফরিদপুরের বোয়ালমারী থানার সালামতপুর গ্রামে। পিতা মুন্সি মেহেদি হাসান ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ঈমাম। মার নাম মকিদুন্নেসা। আব্দুর রউফকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের স্কুলে। সংসারের চিন্তায় একদিন হঠাৎই বাবা ইন্তেকাল করেন। মা অন্যের ফরমায়েশে কাঁথা সেলাই এবং শিকা তৈরির কাজ করে সংসার চালাতে থাকলেন। অভাবী মা মেয়ের বিয়েতে নতুন শাড়ির বন্দোবস্ত করতে পারলেন না। মেয়েকে পুরোনো কাপড়েই বিদায় দিলেন অচলে কান্না লুকিয়ে। মায়ের দুঃখ বুঝলেন মুন্সি আব্দুর রউফ, বললেন ” আমি বড় হয়ে যখন আয় করবো তখন অনেক নতুন শাড়ি কিনে দেব বুবুকে।” সংসারের অভাব দেখে মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৬৩ সালের ৮ই মে ২০ বছর বয়সে যোগদান করলেন ইপিআর-এ। প্রশিক্ষণ শেষে নিয়োগ পেলেন পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে। তার ইপিআর নম্বর -১৩১৮৭। মায়ের কাছে নিয়মিত চিঠি লিখতেন তিনি। প্রতিমাসে টাকা পাঠাতেন মায়ের কাছে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে ১১ নম্বর উইং এ কর্মরত ছিলেন। সে সময় তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।
যেভাবে শহীদ হলেন[সম্পাদনা]
১৯৭১ সাল। দেশের উত্তাল পরিস্থিতির কারণে সীমান্তে জারী হয়েছে বিশেষ সতর্কতা। সবার ছুটি বন্ধ। মুন্সি আব্দুর রউফ চিঠি লিখেন মায়ের কাছে, দেশের অবস্থা ভালো হলে লম্বা ছুটি নিয়ে দেশে যাবেন। এর মধ্যেই ছোট বোনের বিয়ে ঠিক করতে বললেন। কথা দেন বিয়েতে নতুন শাড়িসহ উপস্থিত থাকবেন অবশ্যই। মাকে দেওয়া তার কথা রাখা হয়নি। মার্চ ১৯৭১, আব্দুর রউফ ইপিআর এর ১১নং উইং চট্টগ্রামে কর্মরত। এমন সময় এলো ২৫ মার্চ কালরাত। পাকিস্তানী সৈন্যরা সারা দেশে চলাল ব্যাপক গণহত্যা। চট্টগ্রাম ইপিআর-এর বাঙ্গালি সদস্যদের পূর্ব সচেতনতা এবং সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে তারা রুখে দাড়ায় শত্রুর বিরুদ্ধে। রাতেই তারা পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। যোগ দেন ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের নেতৃত্বে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর-এর ১৫০ জন সৈনিকের দায়িত্বে দেওয়া হয় রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌ পথে নিরাপত্তাবুহ্য তৈরির। এই দলের এক নম্বর এলএমজি চালক মুন্সি আব্দুর রউফ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নানিয়ারচর উপজেলাধীন বাকছড়ির একটি বাঙ্কারে। ৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২ নং কমান্ডো ব্যাটেলিয়ানের দুই কোম্পানি সৈনিক ৭ টি স্পিড বোট ও ২ টি লঞ্চ সহযোগে রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি নৌপথের আশেপাশে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ করে। লঞ্চগুলোতে ৬ টি ৩” মর্টার সজ্জিত ছিলো। পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান টের পাওয়া মাত্রই তাদের অবস্থানের উপর ৩” মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। তাদের এই অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এই সুযোগে কিছু পাকিস্তানী সৈন্য পাড়ে নেমে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ঘিরে ফেলে। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান পেছনে হটার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু নিরাপদে অবস্থান ত্যাগের জন্য দরকার নিরবিচ্ছিন্ন কাভারিং ফায়ার। মুন্সি আব্দুর রউফ এর এলএমজির কাভারিং ফায়ারে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তার সৈন্যদের নিয়ে পেছনে হটতে থকেন। তার অব্যর্থ গুলিতে স্পিড বোটগুলো ডুবে যায় এবং সেগুলোতে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যরা হতাহত হয়। বাকি সৈন্যরা লঞ্চ দুটিতে করে পালাতে থাকে। পাকিস্তানীরা এলএমজির রেঞ্জের বাইরে গিয়ে ৩” মর্টারের গোলাবর্ষন করতে থাকে। অসীম সাহসী মুন্সি আব্দুর রউফ তখনো গুলি চালানো অব্যাহত রেখেছিলেন। হঠাৎ করে শত্রুর একটি গোলা তার ঠিক উপরে পড়ে। মুহূর্তই ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বাংলার অসীম সাহসী বীর মুন্সি আব্দুর রউফ এর দেহ। পরবর্তীতে সহযোদ্ধারা তার লাশ উদ্ধার করে নানিয়ারচরের চিংড়ি খাল সংলগ্ন টিলার উপরে সমাহিত করে।[2]
মুক্তিযুদ্ধে মুন্সি আব্দুর রউফকে অবদান বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। বাংলাদেশ রাইফেলস ১৯৭৩ সালে সিপাহী মুন্সি আব্দুর রউফকে অনারারি ল্যান্স নায়েক পদে মরোণোত্তর পদোন্নতি প্রদান করে। বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ তার জীবনের বিনিময়ে রক্ষা করে গেছেন তার প্রায় ১৫০ জন সহযোদ্ধার জীবন এবং পাকিস্তানী বাহিনীর বহু সৈন্যকে হতাহত করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ আজীবন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে তার অবদানের কথা।