যারা ইতিমধ্যেই জার্মানী আসার জন্যে গ্রীন সিগন্যাল পেয়েছেন বা পাবেন তাদের আগাম শুভেচ্ছা জানাই। কিছু প্রশ্ন ঘুরে ফিরে চলে আসে কি কি জিনিষ পত্র সাথে নিয়ে আসবেন। আমরা প্রতিবারই একই ভুল করি; এমন অপ্রয়োজনীয় জিনিষ পত্র কিনে ব্যাগ বোঝাই করে নিয়ে আসি যে সেগুলা কেনার দরকারই ছিলোনা। অনেকে আবার হিসাব দেখান যে দেশে থেকে অল্প দামে কিনে আনবে তাই এগুলো দরকার। যাইহোক এক এক করে দেখে নেই কি কি আনতে হবে আর কি কি আনা লাগবে নাঃ
১) আমরা যারাই প্রথম শীত প্রধান দেশে আসি তারা ঘটা করে তুষারপাতে পরার জন্যে জুতা কিনে আনি যার দাম ১৫০০-৪০০০টাকার মধ্যে। এই জুতা এইখানে এসে আপনি পরতেই পারবেন না কারণ সেটা এই দেশের টেম্পার্ড মেইনটেইন করেনা। তাহলে আপনি অপচয় করলেন কমপক্ষে ১৫ থেকে ৪০ ইউরো যা দিয়ে ভাল মানের জুতা কিনতে পাওয়া যায়; যেটা দেখতেও সুন্দর এবং টেকশই। তাই আমার উপদেশ মোটামুটি হালকা মানের জুতা কিনে নিয়ে আসুন। এইখানে আপনি কিনে নিতে পারবেন।
২) জুতার মত সেইম ভুলটা করি জ্যাকেট কিনতে যেয়ে। শীত প্রধান দেশে আসা লাগবে মানেই বঙ্গবাজারে যেয়ে বিশাল মোটা ‘কম্বল’ কিনে আনি। এইটা এখানে এসে না যায় পরা বা না যায় ঘরে রাখা। অথচ আপনি এখানে থেকে খুব সহযে সুন্দর ব্র্যান্ডের জ্যাকেট কিনতে পারবেন যেটা দেখতে সুন্দর এবং আবহাওয়া উপযোগী; দাম কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও একই।
৩) সাথে করে হাফ শার্ট, ফুল শার্ট, ফর্মাল প্যান্ট নিয়ে আসতে পারেন বেশি করে। এগুলো এইখানে দাম বেশি পরবে। বিশেষ করে প্যান্টের দাম অনেক। মাঝেমাঝে কপাল ভাল থাকলে শার্ট পেতে পারেন ‘বিলিগার’ বা ‘আঙ্গিবোট’ অর্থাৎ ‘বিশেষ ছাড়ে’ মেয়েদের পোষাকের ব্যাপারে কোন ধারণা নেই সুতরাং দুঃখিত। তবে মোটামুটি একই। আর বেশি করে জিন্স প্যান্ট কিনে নিয়ে আসুন। এইখান থেকে কিনতে পারবেন তবে তা ঝুলে মিলবে না।
৪) আন্ডারওয়্যার সাথে নিয়ে আসবেন বেশি করে। মোজা কিনতে বলব না কারণ এইখানে কম দামেই একসাথে ৪জোড়া বা তার বেশি মোজা কিনতে পাওয়া যায়।
৫) অনেকেই বস্তা ভর্তি করে ঔষুধ কিনে নিয়ে আসেন। এটা একটা মারাত্বক ভুল। কারণ প্রতিটা দেশ তাদের আবহাওয়া উপযোগী করে ঔষুধ তৈরি করে যা অন্য তাপমাত্রা বা আবহাওয়ায় তার গুণগত মান হারিয়ে ফেলে। ফলে আপনি ঔষুধ ভেবে যা খাবেন তা হয়ে যাবে বিষ।
৬) গুড়া মশলা যেমন গুড়া হলুদ, তেজপাতা, গরম মশল্লা আর যারা শুকনা মরিচের গুড়া পছন্দ করেন তারা এগুলো সাথে নিয়ে আসবেন বেশি করে। এখানে আদা, রসুন বা দুইটার পেষ্ট পাওয়া যায় অল্প দামে।
৭) যারা ইন্টারনেটে বই পড়ার অভ্যাস নেই তারা অবশ্যই মনে করে গল্পের বই সাথে নিয়ে আসবেন নাহলে বেজায় মিস করবেন মন খারাপের সময়।
৮) যারা কম্পিউটার কিনেন নাই তাদের উপদেশ দেব এখানে এসে কিনুন কারণ হলো এখান থেকে কিনলে উইন্ডোজ পাবেন অরিজিন্যাল। দেশ থেকে কিনলে দুইটা সমস্যায় পরবেন; ক) উইন্ডোজ ইনষ্টল দিতে হবে নতুন করে; কারণ এর নাম জার্মানী। বারবার ওয়ার্নিং দিতে দিতে কোন একদিন পুলিশ কেসে ফেসে যেতে পারেন বা আপনার পিসি অফ হয়ে যেতে পারে। খ) দেশের প্লাগ আর এখানকার প্লাগ এক নয়; এরা রাউন্ড প্লাগ ইউজ করে( ষ্টুটগার্টে) সুতরাং এখানে আসলে কম্পিউটারে কানেকশন দিতে যেয়ে বেজায় ঝামেলায় পরবেন। সুতরাং যারা ইতিমধ্যেই কিনে ফেলেছেন তারা রাউন্ড প্লাগ কিনে আনুন সাথে। আর উইন্ডোজের ব্যাপারে যতটুকু জানি এটা ইউনিভার্সিটি থেকেই অথেনটিক ভার্সন সাপ্লাই করে বিনামুল্যে; আমরা অন্তত পেয়েছি। কারো একসাথে থাকার পরিকল্পনা থাকলে রোটর কিনে নিয়ে আসবেন তাহলে একই সংযোগ থেকে একাধিক পিসিতে ইন্টারনেট ব্যাবহার করতে পারবেন।
৯) খাতা কলম কিনে ব্যাগ ভারি করবেন না; এগুলো এখান থেকেই অল্প দামে অনেক বেশি কিনতে পাওয়া যায়।
১০) জায়নামাজ, নামাজ পরার টুপি, পাঞ্জাবী, পায়জামা, এবং যার যার ধর্মীয় গ্রন্থ সাথে নিয়ে আসতে পারেন। উপকারে দেবে। অবশ্য আজকাল ইন্টার নেটেই ধর্মীয় গ্রন্থ পাওয়া যায়।
১১) অনেকে একটা মারাত্বক ভুল করেন তাহলো, জামা কাপরে বা জুতায় বেশি টাকা খরচ করলেও লাগেজের বেলাতে কার্পণ্য করেন। মনে রাখবেন, ভাল এবং টেকশই লাগেজ( অবশ্যই চাকাওয়ালা; কারণ দীর্ঘ জার্নির পরে লাগেজ উচু করে টানতে যেয়ে জীবন শেষ হয়ে যাবে। আর এদেশে কুলি নেই সুতরাং সাবধান) কিনে আনবেন। আমি অনেক কেই দেখেছি লাগেজের হ্যান্ডেল ভেঙ্গে বা কম দামী হবার কারণে চাকা খুলে যেয়ে বিশাল বিড়ম্বনায় পরতে।
এবারে কিছু মন শক্ত করা বাণীঃ
১) মায়ের আদরের দুলাল বা দুলালী আপনি; এখানে আসলেই একটা ধাক্কা খাবেন। না না ভয়ের কিছু নেই, আসলে এখানে আপনাকে সব কাজ নিজ হাতে করতে হবে সেটা বাজার করা থেকে শুরু করে ল্যাট্রিন পরিস্কার করা। এরা সব কাজ নিজ হাতে করে শুধুমাত্র আমরাই নাক সিটকাই। তবে শৃংখলার স্বার্থে এগুলো করতেই হবে নাহলে দরজায় নোটিশ লটকে থাকবে; যেটার মাত্রা বেশি হলে বিপদে পরে যাবেন।
২) আসার আগেই অথবা এসেই নিজ দায়িত্বে জেনে নিন কোন পলিথিনে কোন ধরনের ময়লা ফেলবেন। এরা আমাদের মত সব ছুড়ে ফেলে না সব জায়গায়। এদের বিন বা গার্বেজ নির্দিষ্ট করা আছে; কোনটায় কাঁচের বোতল, পলিথিন বা তরকারী বা ফলের উচ্ছিষ্ট ফেলাবেন। আপনি নিজে জানতে চাইলে তারা স্বানন্দে সাহায্য করবে; লজ্জিত হবার কিচ্ছু নেই।
৩) রান্না করেই কিচেন এবং চুলা পরিস্কার করে ফেলুল; দেশের মত ভেবে রাখবেন না দুপুরের থালা বাসন বিকেলের ঘুমের পরে ধোয়া মোছা করবেন। এইক্ষেত্রেও নোটিশ ঝুলে থাকবে দরজায়। রান্নাঘরে বা এপার্ট্মেন্টের নোটিশগুলো ভাল করে পড়ে ইন্সট্রাকশন খেয়াল করুন এতে আপনারই ভাল হবে।
৪) আবেগ কে দেশে রেখে আসুন। এখানে কাজের চাপে, পড়ার চাপে পাগল হয়ে গেলেও করার কিছু নেই। এমনও হতে পারে সারাদিন ক্লাস করে রাতে কাজ করে রুমে ফিরলেন। কাজের স্থান যদি খারাপ হয় তাহলে বকাও খেতে পারেন সেক্ষেত্রে লুকিয়ে কাঁদতে হবে বাথরুমে। এগুলো ঘটবে তাই বললাম; নিরুৎসাহিত করার জন্যে নয়।
সবশেষে, ফেসবুকেই আজকাল সব দেখা যায়; তারপরেও বিষণ্ণ বেলাতে এক পলক মা কে দেখার জন্যে একটা ছবি বাধাই করে নিয়ে আসতে পারলে ভাল হয়; অথবা পারিবারিক ছবি। আবেগের ঠেলায় গলায় কাঁন্না আটকে গেলে ছিটকিনি এটে ছবি দেখে কাঁদা যায়; মন্দ না ব্যাপারটা!!!
জার্মানীতে নতুন স্বপ্ন নিয়ে পা দিতে যাওয়া সব ভাইবোন দের আমার আন্তরিক শুভেচ্ছ রইলো। ভাল থাকবেন সবাই। আপনাদের স্বপ্ন পুর্ন হোক।
লিখছেনঃ Shah Waez