(জার্মান প্রবাসে ম্যাগাজিনের হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংখ্যায় প্রকাশিত)
বাড়ির প্রধান দরজায় অবিরত খটখট আওয়াজ শুনে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে প্রদীপ। জিরো বাল্বের আলোতে আতঙ্কিত নয়নে দেয়ালে বাঁধা ঘড়ির দিকে তাকায় সে। ঘণ্টার কাঁটা দশটার ঘরে জ্বলজ্বল করছে। আগের দিনে ডাকাতেরা এভাবে দরজায় ধাক্কা দিত। পরিবারের সবার হাতপা বেঁধে দামি জিনিসপত্র লুট করত, ঘরে সুন্দরী মেয়ে থাকলে কোন রক্ষা নেই। মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে পরিবারের সবাই মেয়েটির উপর পাশবিক নির্যাতনের কথা গোপন করত। তবে সীমান্তবর্তী এলাকায় মাদক ব্যবসা জমজমাট হওয়ায় আজকাল ডাকাতি অনেক কমে গেছে।তাহলে উগ্র মুসলমানরা আক্রমণ করতে আসেনি তো? মুহুর্তেই বুকের স্পন্দন কয়েকগুণ বেড়ে গেল ওর। ওদিকে প্রদীপের বউ বিছানায় বসে ৫ বছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে আঁচলের মধ্যে লুকিয়ে থরথর করে কাপছে আর ঘনঘন বলছে, “ভগবান তুমি রক্ষা কর”।
মনে মনে ঈশ্বরকে স্মরণরত প্রদীপ পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করল । ডাকাত বা প্রতিবেশী মুসলমানের দল হলে এতক্ষন দরজা টিকে থাকার কথা নয়। তার মনের মরুভুমিতে যেন এক ফোটা বৃষ্টি বর্ষিত হল। ঘর থেকে বের হয়ে পটানের চৌকিতে ঘুমন্ত অর্ধ-বধির বাবাকে জাগানোর চেষ্টা করল। “বাবা, জলদি ওঠ, কারা যেন দরজায় টোকা দিচ্ছে, কোন রোগীর আত্মীয় হবে হয়ত”। নিজেকে আশ্বস্ত করার তীব্র প্রচেষ্টা তার। যদিও বাবা কিছুই টের পান নি।
৭০ বছরের বৃদ্ধ গ্রাম্য ডাক্তার নিমাই চন্দ্র ছেলেকে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। হঠাত করে বিদ্যুৎ চলে গেল। বিদ্ঘুটে অন্ধকার প্রদীপের মনে বাসাবাঁধা ভয়কে একধাপে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিল। দৌড়ে গেল বাবার বিছানার পাশের চেয়ারের উপরে রাখা টর্চলাইট নিতে। দরজা খুলতেই দুজন মানুষ হুড়মুড় করে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ল। “কাকা, আব্বার অবস্থা খুবই খারাপ। দাদাকে বলেন- তাড়াতাড়ি আমাদের সঙ্গে যেতে” কাঁদকাঁদ গলায় অনুরোধ করল মতিন।
গ্রামের মুসলমান পাড়ার মাতব্বর ফজলু মন্ডলের সবচেয়ে ছোট ছেলে মতিন। গ্রামের সমস্ত জমিজমা দেখাশোনা করে সে। ছয় দশক ধরে নিমাই চন্দ্রের সাথে ফজলু মন্ডলের গলাগলায় বন্ধুত্ব। মাতব্বর পরিবারের চিকিৎসার ভার ছিল নিমাই চন্দ্রের উপর। ইদানিং বার্ধক্যের কারণে চলাচলে বেশ অক্ষম হওয়ায় প্রদীপের উপরই তাদের অগাধ ভরসা। অন্যসময় হলে প্রদীপ নিজেই ছুটে যেত। কিন্তু গত কয়েকদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তা্র মনকে কোনভাবেই সায় দিচ্ছে না।
গতকালই অনেক বড় বিপদ ঘটতে পারত। সরকারের উপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত জনগণকে উসকে দিতে সন্ধ্যার দিকে একটা মহল গুজব ছড়ায় যে, সারাদেশে শিশুদেরকে খাওয়ানো ভিটামিন বি ক্যাপস্যুলে প্রাণঘাতী বিষ রয়েছে। ইতিমধ্যে দশজন শিশু মারা গেছে, অসংখ্য শিশু হাসপাতালে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। পরবর্তী প্রজন্মকে ধ্বংস করতে সরকার ভারত থেকে এসব ক্যাপস্যুল আমদানি করেছে। হালকা বমি অথবা নেতিয়ে যাওয়া বাচ্চাকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ঝড়ের বেগে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো জেলায়। বিদ্যুৎ না থাকায় টিভির মাধ্যমে সত্যতা যাচাই করা সম্ভব ছিলনা। দায়িত্ববোধ থেকে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে প্রদীপ। ৫ কিলোমিটার বাইসাইকেল চালিয়ে সদরে এসে ইন্টারনেট ক্যাফের মালিক ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু সজলকে অনুরোধ করে বিভিন্ন পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর খুজে দেখতে।
প্রথমআলোর প্রচ্ছদে চোখ পড়ল তাদের। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন, “অভিভাবকদের ভয় পাওয়ার কিছু নাই। প্রচন্ড গরমের কারণে কিছু বাচ্চা অসুস্থ হয়েছিল, স্যালাইন দেওয়ার পরে তারা এখন সম্পুর্ণ সুস্থ। আপনারা দয়া করে কোন গুজবে কান দেবেন না”।
কালক্ষেপণ না করে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয় সে। পথিমধ্যে চোখে পড়ে অসংখ্য ভ্যানগাড়ি আর মোটরসাইকেল। সন্তান হারানোর আশঙ্কায় পাগলপ্রায় বাবা-মা উপজেলা হাসপাতালের দিকে দলবেঁধে ছুটছেন। জনারণ্য গ্রামের মোড়ে সাইকেল থামিয়ে চেম্বার থেকে সমস্ত ওরস্যালাইনের প্যাকেট বের করে বিনা পয়সায় বিতরণ শুরু করে সে। একইসাথে ক্যাপসুল নিয়ে ভুয়া খবর সম্পর্কে গ্রামবাসিকে অবহিত করে। এক দাদা তার নাতিকে কোলে করে দৌড়ে এসে প্রদীপের হাত ধরে বলল, “আমার নাতির শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাকে যে করেই হোক বাচাও বাবা”।
“চিন্তার কিছু নাই চাচা। এত ছোট বাচ্চাকে গভীর ঘুম থেকে জাগানোর জন্যই ওকে অসুস্থ মনে হচ্ছে। নেন, এই প্যাকেটের স্যালাইন খাওয়ান, আপনার নাতি ভাল হয়ে যাবে”।
কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত গ্রামবাসীকে সদরের দিক থেকে আসা একজন মোটরসাইকেল আরোহী প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসের জানাল যে, কিছুক্ষণ আগে উপজেলা হাসপাতালে দুইটা শিশু মারা গেছে। আশেপাশের এক কিলোমিটার জুড়ে আতংকিত অভিভাবকদের গাড়ির চাপে জ্যাম সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাওয়ায় গেট বন্ধ করে হাসপাতালের চারপাশে বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। একথা শোনা মাত্রই সেখানে উপস্থিত কয়েকজন যুবক ক্ষোভে ফেটে পড়ল। সরকারের সমর্থক গোষ্ঠীর প্রতি বিষোদাগার শুরু করল। একজন শুভাকাংখী এসে পরামর্শ দিল, “দাদা তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যান। নইলে যেকোন অঘটন ঘটতে পারে”।
পরিস্থির আঁচ করে দ্রুত বাড়িতে ফিরে আসে সে। পরেরদিন টিভিতে সংবাদ আসল- দেশের কোথাও কোন শিশু মারা যায় নাই!
“দাদা আর দেরি করবেন না”। মতিনের কথায় চিন্তার তার কেটে যায় প্রদীপের।
বাবার দিকে তাকিয়ে, “যাব বাবা?
“আপনি কোন চিন্তা করবেন না দাদা, আমরা আপনাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাব। কারো বাপের সাধ্যি নেই আপনার ক্ষতি করার”।
বাবার অনুমতি নিয়ে ঘুমন্ত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে সে।
“কাকা, কাকিমা আদাব”। ঘরে ঢুকেই মন্ডল আর তার স্ত্রীকে প্রণাম করল প্রদীপ।
আদাবের জবাব দিয়ে প্রদীপের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলেন ফজলু মন্ডল। এহেন বিপদে প্রদীপ ছুটে আসবে সবসময় এই আত্মবিশ্বাস ছিল তার।
স্থেথিস্কোপ দিয়ে রক্তচাপ পরীক্ষা শেষে সঙ্গে আনা কিছু ওষুধ খাইয়ে দিল মাতব্বরকে। কিছুক্ষণ পরে আগের চেয়ে ভাল অনুভব করতে লাগলেন ফজলু মন্ডল।
“তোমার বাবা কেমন আছেন”? প্রদীপকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
“খুব একটা ভাল না কাকা। বয়স হয়েছে তার উপর সারাক্ষন আতঙ্কের কারণে বাবা আগের চেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছেন” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল প্রদীপ।
“ওর জায়গায় হলে আমি হয়ত এতদিনে ওপারে চলে যেতাম” বন্ধুর প্রতি মায়া লাগল মণ্ডলের।
“এভাবে চলতে থাকলে বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না কাকা” গলায় দলা পাকানো কান্না অনেক কষ্টে আটকে রাখল সে।
প্রদীপের হাত ধরে, “তোমাদেরকে কোথাও যেতে হবে না বাবা। এই বুড়া চাচার উপর ভরসা রাখো”। প্রদীপকে সান্তনা দিলেন তিনি।
“তোর দাদাকে বাড়িতে পৌছে দিয়ে আয়, বাপ” মতিনকে নির্দেশ দিলেন ফজলু মণ্ডল ।
ওরা চলে যাওয়ার পর বন্ধুর পরিবারের কথা ভেবে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। আগের মত দাপট নেই তার। সমাজের বয়স্ক লোকজন ছাড়া তাকে তেমন কেউ গ্রাহ্য করে না। দুই মাইল দুরের সীমান্ত থেকে আসা মাদকে এলাকা সয়লাব। পাড়ার প্রায় সব দোকানে প্রকাশ্যে ফেন্সিডিলের বেচাকেনা হয়। যুবসমাজ ধংসকারী মাদকের ব্যবসা করে তারই জমিতে হালচাষ করে খাওয়া কিষাণের ছেলেরা আজ দামি ব্রান্ডের নতুন মোটর সাইকেল নিয়ে ঘোরে। তাকে দেখলেও আদবের তোয়াক্কা না করে না দেখার ভান করে চলে যায়। পরিবারের বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা করতে ইতিমধ্যে তার বড় ও মেঝো ছেলে গ্রামের ধানি জমি বিক্রি করে সদরে বাড়ি বানিয়ে সেখানে বসবাস করছে। তারা বাবা-মাকে সঙ্গে রাখতে জোরাজুরি করলেও নাড়ি পোঁতানো জায়গা থেকে আলাদা থাকতে চাননি তিনি।
সমাজের এমন অবক্ষয়ের মধ্যে শুরু হয়েছে আস্তিক-নাস্তিক ও রাজাকার-মুক্তিযোদ্ধা বিতর্ক। গতসপ্তাহেই সাইদীর ফাসির রায় নিয়ে পুরো জেলায় তুলকালাম কান্ড শুরু হয়। সাইদীকে চাঁদে দেখা গেছে এমন গুজবে কান দিয়ে তার মুক্তির জন্য জামাতের সমর্থক থেকে শুরু করে এলাকার কিশোররা পর্যন্ত স্থানীয় থানা ঘিরে ফেলে। দিনভর পুলিশ-বিজিবির সাথে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিতে পাশের গ্রামের একজন মধ্যবয়স্ক লোক মারা যায়। তারই দুসম্পর্কের ভাতিজা শহিদ গুলিবদ্ধ হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।উত্তেজিত লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে পাড়ার মোড়ের প্রদীপের ডিসপেনসারি থেকে শুরু করে সরকারের সমর্থকদের বাড়িতে গিয়ে হামলা করার পরিকল্পনা করে। কিন্তু ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বুদ্ধিমত্তায় ও স্থানীয় নেতারা পরিস্থিতি আঁচ করে আগেই গ্রাম ছেড়ে শহরে আশ্রয় নেওয়ায় তাদের সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এমনকি পুরনো শত্রুতার প্রতিশোধ নিতে বা পরিস্থিতির ফায়দা লুটতে পাশের গ্রামের মাদক ব্যবসায়ীরা ধর্মের নামে অনেক উস্কানি দেয় কিন্তু খোদার রহমতে তারা বিফল হয়। তিন চার দিন পরে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে শান্ত হয়। বাবার মুখে শোনা ৪৭ সালের ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। জীবনের ভয়ে অনেক হিন্দু পরিবার ভারতে চলে গেলেও নিমাইয়ের বাবা সহ বেশ কিছু লোক এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্রয়োজনে মারা যাবেন কিন্তু জন্মভিটাকে অন্যের হাতে ছেড়ে না দেওয়ার পণ করেন তারা।
ফজলু মন্ডল বিছানায় শুয়ে গ্রামে সদ্য সংযোগ দেওয়া ডিশ লাইনের বদৌলতে অনেক পুরনো ১৭ ইঞ্চি সাদাকালো টিভিতে দিনরাত বিভিন্ন চ্যানেলের সংবাদ শুনেও বুঝে উঠতে পারছেন না কারা দোষী আর কা্রা নির্দোষ। তবে একটা বিষয়ে তিনি নিশ্চিত, নিমাইয়ের মত হিন্দুরা অন্যের স্বার্থের বলি হচ্ছে। মনে পড়ে, কয়েকবছর আগে রমজান এবং দুর্গাপুজা একসাথে হওয়ায় তিনি, নিমাই চন্দ্র সহ কয়েকজন হিন্দু-মুসলিম মুরব্বিরা একমত হয়েছিলেন যে, শুধুমা্ত্র সেহরি আর ইফতার-তারাবির সময় পুজার ঢাক-ঢোলের বাজনা বন্ধ থাকবে। তাছাড়া যুগযুগ ধরে হিন্দু বাড়ির বাতাশা ছাড়া কোন মসজিদের মিলাদ সম্পন্ন হয় না। তাই ৬৬ বছর ধরে শান্তিতে বসবাসকারী প্রতিবেশীকে অন্যায়ভাবে দেশছাড়া হতে হবে ভেবে তার মাথার মধ্যে তোলপাড় শুরু হয়। রক্তের মধ্যে যেন তারুণ্যের জোয়ার আসে। অন্তিম লড়াই করার অদম্য জেদ চেপে বসে।
মতিন ফিরে এলে তাকে পাঠান স্থানীয় মসজিদের ইমামকে ডেকে আনতে। পাড়ার লোকেরা বৃদ্ধ ইমামকে পীরের মত শ্রদ্ধা করে আর ইমাম সাহেব মন্ডলের কথা ফেলতে পারেন না।
নিজের পেরেশানির কথা ইমামের কাছে ব্যক্ত করলে ইমামও মত দেন যে, এলাকার নির্দোষ হিন্দুদের রক্ষা করা প্রতিটি মুসলমানের ইমানি দায়িত্ব। কালকের জুম্মার নামাজে এ বিষয়ে খুতবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। সকালে ফোন করে দুই ছেলেকে জুম্মার নামাজের আগে বাড়িতে আসার আদেশ দেন মন্ডল। দুই ছেলের কাধে ভর করে দীর্ঘদিন পরে মসজিদের উদ্যেশে রওয়ানা দেন তিনি। মনের ভিতরে অনুভব করতে থাকেন বন্ধুত্ব ও ঈমানি দায়িত্ব পালনের স্বর্গীয় আনন্দ।