কাল সকাল ১১ টায় বল্টুর ইন্টারভিউ। সদ্য কেনা স্যুট বুট পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বারবার দেখছে সে। আর গুনগুন করে গাইছে, “রুপে আমার আগুন জ্বলে, যৌবন ভরা অঙ্গে!”
দরজায় খটখট শব্দে বল্টুর সংগীতে বিঘ্ন ঘটল। “কাম ইন” বলে আবার গাইতে শুরু করল সে। ঘরে ঢুকে বল্টুর দীর্ঘ দিনের বন্ধু পল্টু জিজ্ঞেস করল, “কি রে তোর ইন্টারভিউ এর প্রস্তুতি কেমন?”
“সেরাম ব্যাটা! দেখতো, এরকম বস পোশাকে আমাকে কেমন লাগছে?”
“একেবারে আমির খানের মত” হাস্বোজ্জল পল্টুর প্রত্যুতর।
নিজের প্রশংসা শুনে আনন্দে আটখানা হয়ে গেল বল্টু। একটু আগে কেনা দামি পারফিউমের প্যাকেটটা পল্টুর দিকে বাড়িয়ে দিল সে। “গন্ধটা অনেক রাজকীয় না রে, পল্টূ? গায়ে একটু মেখে সত্যি করে বলনা, দোস্ত।”
বন্ধুর এমন আচরণে অভ্যস্ত পল্টু খানিকটা সেন্ট হাতের তালুতে নিয়ে শুকে দেখল। গদগদ কন্ঠে বলল, “অনেক সুন্দর গন্ধ রে, বল্টু। তবে কালকের জন্য একটু প্রস্তুতি নিলে ভাল হতো না?”
“তুই তো জানিস দোস্ত, দেশে ব্যাচেলর পাশ করার আগেই চাকরি পাইছিলাম। ইন্টারভিউ এ কেউ আমাকে আটকাতে পারেনি। একসাথে দুইটা চাকরি পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! দেখিস, কালকেও আমি ফাটিয়ে দেব।” বল্টুর কথায় আত্মবিশ্বাসের জোয়ার।
তর্কে না গিয়ে মুচকি হেসে পল্টু বলল, “তোর জন্য অনেক শুভ কামনা রইল, দোস্ত।”
পরের দিন সকালে দুইঘন্টার রেল যাত্রা শেষে ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রধান ট্রেন স্টেশনে পৌছাল বল্টু। সেখান থেকে বাসে চেপে ২০ মিনিট দুরত্বের স্টপেজে নামল সে। হিসাব অনুযায়ী পায়ে হেটে সেই অফিসে যেতে ১০ মিনিট লাগবে। হাতে রয়েছে ১ ঘন্টা। পকেট থেকে স্মার্টফোন বের করে জিপিএস চালু করল বল্টু। গুগল ম্যাপের দেখানো পথ অনুসরণ করতে লাগল সে। মিনিট দশেক হাটার পরে একটা গলির শেষ প্রান্তে নিজেকে আবিষ্কার করল বল্টু। বুঝতে বাকি রইল না- জিপিএস তাকে ভুল ঠিকানায় এনেছে। টেনশনে ঘামতে শুরু করল সে। আইসিই ট্রেনে সাধারণত ফোনচার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ওর ট্রেনে সেটা ছিল না। তাই ব্যাটারির চার্জলেভেল নিচের দিকে, হয়ত আধাঘন্টা পরেই ফোন বন্ধ হয়ে যাবে। নিজের প্রতি বিরক্ত লাগা শুরু করল ওর। আলসেমি না করে বাসা থেকে একটা ম্যাপ প্রিন্ট করে আনলেই এমন ঝামেলায় পড়তে হতোনা! পুর্বের জায়গায় ফিরে এসে কয়েকজন পথচারীর সাহায্য চাইল্ সে। কিন্তু সবাই সেই ঠিকানা বাতলে দিতে ব্যর্থ হল। উপা্য় না দেখে সেই কোম্পানীতে ফোন করল সে।
একজন মহিলা ফোন ধরতেই বল্টু তাকে রাস্তা চিনিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। জার্মান ভাষায় ভাল দক্ষতা না থাকায় মহিলার কথা তেমন বোধগম্য হল না ওর। ভদ্রতার খাতিরে সবজান্তার ভাব ধরে ফোন রেখে দিল সে। সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে আবারও জিপিএস চালু করল বল্টু। অবাক হয়ে লক্ষ্য করল- গুপল ম্যাপ এবার সম্পুর্ণ উল্টাদিকের পথ নির্দেশ করছে। গুগলকে ভগবান মেনে ঘর্মাক্ত শরীরে হাটতে লাগল বল্টু। কিছুক্ষণ পরে রাস্তার বামপাশের একটা বিল্ডিং এর গায়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা “অমুক কোম্পানি” তে চোখ আটকে গেল ওর। আরে! এতক্ষণ ধরে সে এই ঠিকানাই খুজছিল!। কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেল সে। রিসিপশনে গিয়ে এইচআর ম্যানেজারের সাথে এপয়েন্টমেন্টের কথা জানাল বল্টু। সুন্দরী রিসিপশনিষ্ট ফোনে তার বসের সাথে কথা বলে হাসিমুখে বলল, “আপনি দয়া করে একটু অপেক্ষা করুন। কিছুক্ষণ পরে বস এসে আপনাকে ইন্টারভিউ কক্ষে নিয়ে যাবেন।”
হাতে এখনো দশ মিনিট সময় রয়েছে। ওয়াশরুমে গিয়ে চোখমুখ ধুয়ে ফেলল বল্টু। ব্যাগ থেকে দামি সেন্ট বের করে পুরো শরীরে মাখল সে। এখন খানিকটা ভাল লাগছে তার।
এইচ আর ম্যানেজার এসে তাকে উপরের একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন। একজন এইচআর এবং দুজন টেকনিক্যাল ম্যানেজার তার ইন্টারভিউ নেবেন। সবার সাথে হ্যান্ডশেক করে চেয়ারে বসে পড়ল সে। তাদের কথোপকথনের কিছু চুম্বক অংশ নিচে দেওয়া হল।
এইচ আর: আপনি কেন জার্মানিতে এসেছেন?
বল্টু: আমি আসলে জিআরই দিয়ে আমেরিকা যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের ইউনি থেকে স্কলারশীপ পাওয়ার এখানে চলে আসি।
এইচ আর: আই সি! মাস্টার্স করে জার্মানিতেই কেন চাকরি খুঁজছেন?
বল্টু: আমেরিকায় গিয়ে পিএইচডি করতে ইচ্ছা ছিল। পরে ভেবে দেখলাম, আরেকটা নতুন দেশে যাওয়ার দরকারটা কি! এখানেই তো বেশ ভাল আছি।
এইচ আর: ওকে। আপনার কি দেশে ফিরে যাবার পরিকল্পনা আছে?
বল্টু: আপাতত নেই, সময় আসলে দেখা যাবে।
এইচ আর: যথার্থ বলেছেন। আপনি টিম ওয়ার্ক নাকি লিডারশীপে বিশ্বাস করেন?
বল্টু: দেখুন, আমি টিমওয়ার্কে বিশ্বাস করি তবে লিডারশিপটাকে বেশী উপভোগ করি। ছোটবেলা থেকেই বন্ধুদের দলের লিডার ছিলাম। এমনকি, দেশে চাকরির সময় আমার আন্ডারে বেশ কয়েকজন গ্রাজুয়েট কাজ করত।
এইচ আর: সাউন্ডস গুড! আপনি পাঁচ বছর পরে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
বল্টু: অবশ্যই একটা কোম্পানির কোন বড় পদে। তবে কোন কোম্পানি সেটা এখনও ভেবে দেখি নি।
টেকনিক্যাল: আচ্ছা, আপনার সাথে কখনো কারো কনফ্লিক্ট হয়েছে?
বল্টু: আরে না। আমি প্রচন্ড বন্ধুবৎসল মানুষ। অন্যের সাথে ঝামেলা হওয়ার কোন কারণই নেই।
এইচ আর: বাই দা ওয়ে, আপনার জার্মান দক্ষতা ভালই মনে হচ্ছে। দেশ থেকেই জার্মান শিখেছিলেন?
বল্টু: ঐ যে বললাম, হুট করে এখানে এসেছি। সুতরাং, আগে থেকে শেখার প্রশ্নই ওঠে না।
এইচ আর: কত বেতন পেতে চান?
বল্টু: আমার এক বন্ধু একই চাকরি করে বছরে ৫০ হাজার ইউরো বেতন পায়। আমিও একই পরিমাণ আয় করার যোগ্যতা রাখি।
টেকনিক্যাল: আপনার কোন প্রশ্ন থাকলে নির্দ্বিধায় করতে পারেন।
বল্টু: আমি শুধু একটা বিষয় জানতে চাই। সেটা হচ্ছে, এই এলাকায় বাসা ভাড়া কেমন?
এইচ আর: আমি তো এই এলাকায় থাকি না। তবে খুব বেশী হওয়ার কথা নয়। আপনার বেতনে চলে যাবে!
ইন্টারভিউ থেকে ফিরে পল্টুকে সব খুলে বলল সে। বল্টুর কথা শেষ না হতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল পল্টু। বিব্রত ও হতভম্ব বন্ধুর দিকে তাকিয়ে কোন রকমে নিজেকে সামলে নিল সে। ক্ষণিক পরে ল্যাপটপ অন করে বল্টুর চোখের সামনে মেলে ধরল একটি ওয়েবসাইট, যার ভেতরে বড় বড় হরফে লেখা, “Most Common Interview Questions!!”
একটু পরে পল্টু বলল, “সত্যি বলতে কি, তোর ইন্টারভিউ একদম বাজে হয়েছে, দোস্ত। চিন্তা করে ডিপ্লোম্যাটিকেলি প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হত। পরেরবার থেকে ইন্টারনেট ঘেটে ভালভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে যাস, দোস্ত।”
বলাবাহুল্য, বল্টু চাকরিটা পায় নি।
মোরাল: অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস ও প্রস্তুতি ছাড়া ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া লোকের অবস্থা বল্টুর মত হতে পারে।