লিখেছেন: মাকসুদুল হক
আমরা আমাদের অনার্স বা মাস্টার্স কমপ্লিট করার পর আমাদের থিসিসটি কিভাবে বা কোথায় পাবলিশ করব এই বিষয়টি নিয়ে খুব দ্বিধা-বিভক্তিতে থাকি। আমি যে বিষয়টা নিয়ে কিছু কথা আজকে বলব সেটা হলো কিভাবে পেপার সাবমিট করার জন্য সঠিক জার্নালটি সিলেক্ট করতে হবে এবং সাবমিট করতে হবে।
আমি আমার ৩ বছরের রিসার্চ জীবনে একটি ব্যাপার অনেকবারই লক্ষ্য করেছি যে, ভুল সিলেকশনের কারনে অনেক উন্নতমানের রিসার্চ আর্টিকেল লোকাল জার্নালে পাবলিশ করা হয়েছে, এমনকি এমনও দেখেছি যেই আর্টিকেল ইমপ্যাক্ট ৪ এর জার্নালে পাবলিশ করা যায় সেটা পাবলিশ করা হয়েছে ইমপ্যাক্ট ১ এর জার্নালে। সাধারণত একটি পেপার সাবমিট করা থেকে শুরু করে একসেপ্ট হওয়া পর্যন্ত ৪-৬ মাস সময় লাগে (র্যাপিড পাবলিকেশন্স ব্যাপারটি আলাদা)। একটি রিসার্চ পেপার লিখা থেকে শুরু করে করে পাবলিকেশন পর্যন্ত যাওয়া অনেক পরিশ্রমের কাজ। সুতরাং সঠিক এবং উপযুক্ত জার্নাল নির্বাচন পেপার লিখার মতই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
আমি পর্যায়ক্রমিকভাবে প্রতিটি ধাপ লিখার চেষ্টা করছি-
১। #জার্নাল সিলেকশনের কাজটি ২ ভাবে করা যায়। পেপার লিখে শেষ করার পর অথবা পেপার লিখা শুরু করার পূর্বে। আমারা সাধারনত লিখা শেষ করার পরেই এটা করে থাকি। তবে আমি শেষের দিকে যে কয়টি পেপার করেছি, জার্নাল আগেই সিলেক্ট করে নিয়েছি। এটা করার কিছু সুবিধা আছে। প্রতিটা জার্নালের ‘অথার গাইডলাইন্স’ বলে একটি সেকশন থাকে। পেপার সাবমিট করার পূর্বে গাইডলাইনস ভালো করে পড়ে নেয়ার অনুরোধ করা হয়। সেখানে বলা থাকে এই জার্নালে একটি পেপার পাবলিশ করতে চাইলে সর্বোচ্চ কতগুলি টেবিল এবং ফিগার দেয়া যাবে, টেবিল এবং ফিগার এর মান কেমন হতে হবে, পুরো পেপারটি কত শব্দের মধ্যে শেষ করতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথমেই যদি এই বিষয়গুলি জানা থাকে তাহলে লিখতে অনেক সুবিধা হয়।
এবার আসা যাক সঠিক জার্নাল্টি আমরা খুজে বের করব কিভাবে? প্রথমে যেটা করতে হবে, যে বিষয়টির উপর কাজ সেটা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শব্দ (keywords) নির্বাচন করতে হবে। বর্তমানে প্রতিটি রিসার্চ লাইনের অনলাইন ডাটাবেজ আছে। যেমন ধরুন বায়োলজিকাল সাইন্সের জন্য আছে ‘পাবমেড (Pubmed)’. আপনি আপনার keywords গুলি দিয়ে এই ডাটাবেজগুলিতে সার্চ করলে কাছাকাছি বা সম্পর্কিত অনেকগুলি রিসার্চ পেপার পাবেন। সেই আর্টিকেলগুলিতে গিয়ে আপনি একটু ধারনা নিয়ে নিতে পারেন যে আপনার কাজের মান কিরকম এবং কোন ধরেনের জার্নাল এ ধরনের পেপার এক্সেপ্ট করে এবং তাদের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর কত। এ ধরনের কয়েকটি জার্নাল আপনি শুরুতেই লিস্ট করে নিতে পারেন। এধরনের কিছু রিলেটেড পেপার পড়লে আপনার চিন্তাভাবনারও কিছু পরিবর্তন আসতে পারে, হয়ত দেখা যাবে আপনি আপনার পেপারটিকে আরো কয়েকভাবে প্রেজেন্ট করার আইডিয়া পেয়ে গেছেন। খেয়াল করতে হবে জার্নাল্টির পেজ চার্জ কত। অনেক জার্নালেই পেজ চার্জ উল্লেখ থাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত পড়ে শেষ করলে দেখা যায়, ডেভলপিং কান্ট্রি থেকে সাবমিট করলে কোনো টাকা দিতে হয়না। লক্ষ্য রাখতে হবে জার্নাল্টি ভূয়া নাতো!! ভাল করে যাচাই করে নিবেন।
২। #কয়েকটি জার্নাল সিলেক্ট করার পর প্রতিটি জার্নাল এর হোম পেজ এ গিয়ে ‘Scope of the Journal’ ভাল করে পরে নিতে হবে। এই বিষয়টি নিয়ে আমরা খুবি খামখেয়ালি করি। আপনি যেই জার্নালটি পছন্দ করেছেন সেটার নির্দেশনার সাথে আপনার কাজের মিল না থাকলে ৭ দিনের মধ্যে রিজেক্টেড হয়ে যাবে। আমি একটি এডিটরিয়াল ভিডিওতে একজন চীফ এডিটরের সাক্ষাৎকারে দেখেছিলাম, ৫০% পেপার রিজেক্টেড হয়ে যায় শুধুমাত্র মনোযোগ দিয়ে নির্দেশনা না পড়ার কারনে।
৩। ‘Scope of the Journal’ পড়ার পর দেখা যাবে আপনার লিস্টটি ২-৩ টি জার্নালে নেমে এসেছে। এখন আপনি আপনার অন্যান্য অথারদের সাথে এবং সুপারভাইজারের সাথে কথা বলে একটি জার্নাল পছন্দ করে নিতে পারেন। একটি ব্যাপার সবসময় মনে রাখতে হবে, আপনার পেপার এর মান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা থাকা জরুরী। কেউ যদি ২ ইম্প্যাক্ট এর উপযোগী কোন পেপার ৬ ইম্প্যাক্ট এর কোন জার্নালে সাবমিট করে তাহলে সেটা সময়ের অপচয় ছাড়া কিছুইনা। পেপার রিজেক্ট হয়ে ফেরত আসতেও কমপক্ষে ১ মাসের বেশি সময় লাগে। অতঃপর আবার পুরো পেপারটিকে নতুন একটি জার্নালের জন্য ফরম্যাট করা যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।
৪। #ধরে নিলাম আপনার পেপার রেডি, এখন সাবমিট করতে হবে। যেই জার্নাল্টি সিলেক্ট করেছেন, সেটার হোমপেজে যাবেন, রেজিস্ট্রেশন করবেন, লগইন করবেন, পেপার সাবমিট করবেন। সকল অথার এর ইমেইল ঠিকানা দিতে হবে, জার্নাল এডিটর শুধুমাত্র কারেস্পনডিং অথার এর সাথেই সমস্ত যোগাযোগ করবে। পেপার সাবমিশনের পুরো ব্যাপারটি অনেকটা পিসিতে সফটওয়্যার ইন্সটল করার মত। একটির পর একটি অপশন আসবে আপনি এগিয়ে যাবেন। ফিগার আপলোডের ক্ষেত্রে প্রতিটি জার্নাল এর নিজস্ব নির্দেশনা থাকে, সেটা মেনেই আপলোড করতে হবে।
৫। #সাবমিশনের একেবারে শেষপর্যায়ে আপনাকে পুরো পেপারটির একটি PDF ফাইল দেয়া হবে। সেটার প্রিন্ট নিয়ে ভাল করে চেক করে দেখতে হবে কোনো বানান ভুল আছে কিনা, এবং জার্নাল নির্দেশনা সঠিকভাবে মানা হয়েছে কিনা। সতর্ক থাকা জরুরী কেননা এটাই আপনার পরিবর্তন করার শেষ সুযোগ। এরপর কোনো পরিবর্তন করতে হলে পেপার withdraw করে তারপর পরিবর্তন করতে হবে।
৬। #সাবমিশন শেষ হয়ে গেলে কারেস্পনডিং অথার এর ইমেইল এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে পেপার এর স্ট্যাটাস চেক করা যাবে। সাধারনত সাবমিশনের পর রিভিউয়ার পর্যন্ত যেতে ৭ দিন সময় লাগে। Peer Reviewed জার্নালে একটি পেপার কমপক্ষে ২ জন রিভিউয়ারের কাছে পাঠানো হয়। যদি ২ জন রিভিউয়ার একমত হয়, তবেই কেবল পেপারটি পাব্লিকেশনের জন্য সিলেক্টেড হয়।
৭। #রিভিউয়ার আপনাকে মেজর বা মাইনর পরিবর্তনের জন্য সাজেস্ট করতে পারে। রিভিউয়ার এর প্রশ্নের উত্তর অত্যন্ত বিনয়ের সাথে দিতে হবে, তা আপনার সাথে তার মতের মিল হোক আর না হোকে। যদি মতের মিল না হয় তাহলে খুবি বিনয়ের সাথে আপনার যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে। আপনার কথা সঠিক না, আপনি আমার লিখা বুঝেন নাই, এসব কথা ভুলেও বলা যাবেনা। মনে রাখবেন চীফ এডিটর ফাইনাল ডিসিশন নিবে রিভিউয়ার এর রিমার্কস দেখে। রিভিউয়ার রিপোর্ট রেডি হয়ে গেলে পুনরায় আগের নিয়মে সাবমিট করতে হবে। চেঞ্জগুলিসহ এডিটর পুনরায় পেপারটি রিভিউয়ারদের কাছে পাঠাবে। রিভিউয়াররা সন্তুষ্ট হলে এডিটর কনগ্রাচ্যুলেশন জানিয়ে কারেস্পনডিং অথার কে ইমেইল করবে।
আমি চেষ্টা করেছি আমার অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে। কোনো ভুল ত্রুটি থাকলে বা নতুন কিছু সংযোজন করার থাকলে অভিজ্ঞরা এডিট করে দিবেন।
হ্যাপী পাব্লিশিং!