লিখেছেনঃ Magistrates, All Airports of Bangladesh
আপনার লাগেজ মিসিং। দু’এক মাস ঘুরাফেরার পর আপনার লাগেজ ট্যাগটির হেডিং পড়ে শুনিয়ে দেয়া হল, “লিমিটেড রিলিজ ট্যাগ (LRT)” কিংবা “লিমিটেড রিলিজ লাইয়েবিলিটি'”। বলে দিল, এর অর্থ… রিলিজ দ্য এয়ারলাইন ফ্রম লাইয়েবিলিটি। সো, নো কম্পেনসেশন! কীইবা করার আছে! এটাইতো আইন, নাকি??
সম্প্রতি মাত্রারিক্ত হারে বেড়েছে এই প্রবণতা। আজকেও একাধিক যাত্রির কাছে শুনেছি। কয়েকদিন আগে এ সংশ্লিষ্ট এক বিশেষজ্ঞকে(!) বলতে শুনেছি… বোর্ডিং গেইটে হ্যান্ড ব্যাগেজ সঙ্গত কারণে কেবিনে এলাউ না করা গেলে এবং তা লিমিটেড রিলিজ চেকড ব্যাগেজ হিসেবে বুকিং-এ নিলে, যদি ব্যাগ হারানো যায়, নো লাইয়েবিলিটি!!
এসব (অ)নিয়ম শুধু যে অজ্ঞতার কারণে হয় তা না, সুচতুর বাণিজ্যিকতায় রূপ নিয়েছে।
যদি ইংরেজি বুঝতে ভুল না করি… #Limited_Release_Liability বলতে ‘Releasing the carrier from #all sorts of liability’ নাহ! তাহলে “Limited” শব্দের অর্থ দাঁড়ায় “Unlimited”। হাঁস দিবার কইয়া বাঁশ না দেই! কেজি-স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাটা যদি বলতে পারে #Limited_Release_Liability বলতে ‘Releasing the carrier from #limited sorts of liability’… আমারতো মনে হয় আমাদের বড় বড় সার্টিফিকেট ড্রেনে ফেলে আবার কেজি থেকেই শুরু করা উচিত।
ক্ষেত্রভেদে এই লাইয়েবিলিটিরও যৌক্তিক ও আইনসম্মত ভেদ আছে। লিমিটেড রিলিজ ট্যাগ (LRT)-এ প্যাসেঞ্জার হিসেবে স্বাক্ষর করার আগে ট্যাগের উপর লিখিত বিষয়গুলো বুঝেশুনে নিন…
১. Pre-existing or Received Damage: ধরুন, আগে থেকেই আপনার ব্যাগেজের ঠ্যাং ভাঙ্গা। কর্তৃপক্ষ এই ভাঙ্গা ঠ্যাং-এর লাইয়েবিলিটি নেবে কেন? আবার ঠ্যাং ভাঙ্গা লাগেজ বুকিং দিয়ে রিসিভ করতে গিয়ে দেখলেন হাতও ভাঙ্গা! ভাঙ্গা হাতের ক্ষতিপূরণ ছেড়ে দেবেন??
২. Fragile & Unsuitably Packed: ভঙ্গুর বস্তুর ক্ষেত্রে বস্তু ভাঙ্গা গেলে এবং উল্টাপাল্টা প্যাকিং-এর ক্ষেত্রে হ্যান্ডেলিংকালে লাগেজের কোনরূপ ক্ষতি সাধিত হলে কতৃপক্ষ দায়ী নয়।
৩. Perishable: পচনশীল দ্রব্য পঁচে গলে নষ্ট হলে দোষ আপনার কপালের…
৪. Inadequate Packaging: কিপ্টুসের ধন বক্কিলায় খায়! অ-মানসম্মত প্যাকেজিং-এর কারণে ড্যামেজ হলে বা ভেতরের কোন বস্তু খোয়া গেলে… আল্লাহর রাস্তায় দান সদগাহ হিসেবে গণ্য করাই ভালো! 🙂
৫. Late chek-in: জ্যামে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে শেষ মুহূর্তে এসে ব্যাগেজ বুকিং দিলেন। আপনি না-হয় এক দৌড়ে বোর্ডিং এ চলে গেলেন। কিন্তু লাগেজতো দৌড়ায় না… কনভেয়ার বেল্টে নিজ গতিতে যেতে যেতে ততক্ষণে ফ্লাইট চলে গেলে, ব্যাগ মিস? না.. ব্যাগ পৌঁছাতে দেরী হতে পারে। ফলে..ব্যাগেজ ডি-লে সংক্রান্ত নিয়মকানুনের আওতায় কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়া যাবে না। সবুরে মেওয়া ফলে.. সবুর সবুর…
৬. Not Admissible in Cabin: ওভার-ওয়েট, ডি-শেপ্ড, সিকিউরিটি হ্যাজার্ড বা অন্য কোন যৌক্তিক কারণে আপনার হ্যান্ড ব্যাগেজ বা কোন বস্তু যদি কেবিনে এলাও না করা হয়… বাধ্য হয়ে আপনাকে তা বোডিং গেইটে বুকিং-এ দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু লাইয়েবিলিটি উপরের ৫নং এর মতই। সময়াভাবে ব্যাগটি লোড নাও হতে পারে… সো, সবুরে মেওয়া ফলানো ছাড়া উপায় নেই! 🙂
মুখ বেজার করার কোনওও কারণ নাই। LRT-এর ক্ষেত্রে এতক্ষণ আমরা যা বুঝলাম- আপনার ব্যাগেজ ভাঙ্গতে পারে, ক্ষতি হতে পারে, পঁচতে পারে, ভেতরের কোন বস্তু খোয়া যেতে পারে বা পেতে বিধিসম্মত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে। যৌক্তিক প্রয়োজনের তাগিদে আপনি এসবের এক বা একাধিক ক্ষতি মেনে নিয়েই ট্যাগে স্বাক্ষর করছেন এবং কর্তৃপক্ষকে এ ধরণের লিমিটেড লাইয়েবিলিটি থেকে রিলিজ করেছেন। কিন্তু যদি আলটিমেটলি ব্যাগেজই হারানো যায়, ছালামালা শেষ?
বোকা নাকি?? কোথাও কি বলা আছে যে, লস্ট ক্ষতিপূরণ পাবেন না? অবশ্যই পাবেন। ঐ লাইয়েবিলিটি হতে রিলিজ দিয়ে আপনি স্বাক্ষর করেন নাই। হা হা.. ওরকম হলেতো, সেই আবার ফিরে চলো গোড়ায় যাই.. যাহা লিমিটেড তাহাই আনলিমিটেড!! কেউ যদি ওরকমটা বলে ধরে নিতে হবে, হয় তার অজ্ঞতা.. না-হয় স্রেফ প্রতারণা!
এখনও এক আইটেম বাদ আছে… দুষ্টু চক্রের দুষ্টুমি! শুধু আমাদের দেশটার বদনাম করেন ভাই.. শুনলে কানে হাত দিতে ইচ্ছে হয়। পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত এমন বহু দেশ আছে যেখানে এ চক্রের পরিধি অনেক বেশি। যতগন্ডগোলের মুল ঐ ৬ নম্বরের ‘নট এডমিসিবল ইন কেবিন’। ধরুন, আপনার হ্যান্ড ব্যাগের ওয়েট, শেইপ, সাইজ সবই ঠিক আছে। যেই ফাইনাল চেকিং এর জন্য স্ক্যানারে ঢুকালেন, ব্যাস..হয়ে গেল নট_এডমিসবল_ইন_কেবিন! সময় নাই.. LRT বুকিং মাস্ট! ডেস্টিনেশনে পৌঁছে দেখলেন, ব্যাগের মুল্যবান জিনিষটি নাই। ব্যাগটাই যদি মুল্যবান হয়… তো আর কথাই নাই… গায়েব! উপায়??
@ সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রে হ্যান্ড ব্যাগ তথা ক্যারি-অন ব্যাগের জন্য টিকেটের ক্লাস অনুযায়ী প্রযোজ্য ওয়েট, শেইপ, সাইজ (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা) আগে থেকে জেনে নিয়ে ব্যাগ প্রস্তুত করে নিন। জেনারেলি, হ্যান্ডব্যাগ ওয়েটের ক্ষেত্রে “7KG Rule” কথিত আছে। তবুও ক্লাস ও এয়ারলাইন্স ভেদে এটা কমবেশ হতে পারে।
@ নিয়মের ভেতর থাকা সত্ত্বেও যদি ‘নট এডমিসিবল’ বলে LRT-তে বুকিং দিতে চায়, দুষ্টুমি প্রতিরোধে চ্যালেঞ্জ করুন। কাজ হতে পারে..
@ কাজ না হলে কী করবেন? স্ক্যানিং ম্যাশিন যেই পছন্দের জিনিষটার জন্য আপনার ব্যাগ নন-এডমিসিবল ঘোষণা করল, ওইটা বের করে সঙ্গে নিয়ে নেন। দেখবেন.. ব্যাগও এডমিসিবল হয়ে গেছে! 🙂
@ একেবারে রিস্ক ফ্রি থাকার জন্য ২ টাকার একটা পলিথিন সঙ্গে নিয়ে নিবেন। এ ধরণের পরিস্থিতির উদ্ভব হলে মুল্যবান জিনিষগুলো বের করে থলেতে নিয়ে নিন..। লাবড়া-ডাবড়া বাকী জিনিষ দিয়ে দুষ্টুদের সমস্যা ফেলে দিন। হারিয়ে গেলে কেজি মাপে ক্ষতিপূরণতো পাচ্ছেনই।।
লাগেজ না আসলে করণীয়
১. আগমণী তারিখেই এয়ারলাইন্স অফিস কিংবা লস্ট-এন্ড-ফাউন্ড ডেস্কে কমপ্লেইন করে PIR (Property Irregularity Report) রশিদ বুঝে নিতে হবে। এয়ারলাইন্স নিজে অথবা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং এজেন্ট (বাংলাদেশ বিমান) এর মাধ্যমে পিআইআর ইস্যু নিশ্চিত করবেন এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে নিজস্ব নিয়মে ইন্টেরিম রিলিফ বা আইআর প্রদান করবেন।
…পিআইআর ইস্যুর মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড ব্যাগেজ ট্রেসারে মিসিং লাগেজের ইমপুট প্রদান করা হয় এবং ট্রেস করা গেলে ডেস্টিনেশনে প্রেরণ করা হয়।
২. সাত দিনের মধ্যে লাগেজ না আসলে অথবা এয়ারলাইন্স বা লস্ট-এন্ড-ফাউন্ড ডেস্ক থেকে যাত্রির সাথে যোগাযোগ করা না হলে এয়ারপোর্টস্থ এয়ারলাইন্স অফিসে গিয়ে লাগেজের মালামালের ফিরিস্তি (ইনভেন্টরি) নির্দিষ্ট ফরমে স্বাক্ষর করে জমা দিতে হবে।
…অনেক সময় লাগেজের ট্যাগ ছিঁড়ে যায়। স্ক্যানিং করে মালামালের সাদৃশ্য থেকে লাগেজ চিহ্নিত করার জন্য ইনভেন্টরি নেয়া হয়।
৩. সাতদিনের মধ্যে লাগেজ না আসলে এয়ারলাইন্স ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের জন্য উর্ধ্বতন অফিসে অগ্রায়ন করবেন, যাতে পরবর্তী ১৪ দিনের মধ্যে ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়।
…এয়ারলাইন্স পরবর্তী ১৪ দিন একই সাথে ট্রেসিং এবং ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের কাজ চলমান রাখবে।
৪. একুশ দিনের মধ্যে লাগেজ না আসলে লাগেজ মিসিং বলে গণ্য হবে এবং এয়ারলাইন্স যাত্রিকে ক্ষতিপূরণ বুঝিয়ে দিবে। পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে লাগেজ আসলে যাত্রি লাগেজও পাবেন, ক্ষতিপূরণ ফেরত চাওয়া যাবে না। অন্যদিকে ২১ দিনের মধ্যে লাগেজ আসলে যাত্রি শুধু লাগেজ পাবেন, ক্ষতিপূরণ পাবেন না।
…বুকিং এর সময় মুল্যমান ঘোষণাপূর্বক চার্জ দিয়ে বীমাকৃত লাগেজের ক্ষেত্রে ঘোষিত মুল্যমানেই ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়। অঘোষিত লাগেজের ক্ষেত্রে ওজন ২০ কেজির মধ্যে হলে সবটুকুর জন্য এবং ওজন ২০ কেজির উপরে হলে কমপক্ষে ২০ কেজির জন্য প্রতি কেজি ২০ ইউএস ডলার হারে ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়।
(এয়ারক্রাফ্টে স্থান সংকুলান না হওয়া, ট্যাগ ছিঁড়ে যাওয়া বা মিস-হ্যান্ডলিং এর কারণে লাগেজ নির্ধারিত ফ্লাইটে না এসে পরবর্তী যেকোন সময় আসতে পারে। এমনকি নাও আসতে পারে। এটা মেনেই যাত্রিরা আকাশপথে ভ্রমণ করেন। লাগেজ না আসার অর্থ লাগেজ চুরি বা গায়েব নয়। মনে রাখতে হবে, এতে যাত্রির যেমন ক্ষতি… তেমনি এয়ারলাইন্সেরও ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়)
[…] […]
[…] […]
[…] […]
[…] […]