আমার বুয়েটের এডভাইজারের সাথে দেখা করলাম- তিনি বললেন, বি সি এস দাও। বললাম এই তো সামনেই দেব। বি সি এস দিলাম , প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষার ফলাফলের যখন অপেক্ষা করছি তখন বাবা একদিন বললেন তুমি বিদেশে কেন শিক্ষা নিচ্ছ না-আমার এই আশা টা কি পূরণ হবে না?
অস্ট্রেলিয়া আসলাম মাস্টার্স করতে , প্রথম সেমিস্টারের টাকা বাবার কাছ থেকে নিয়ে আসলাম ৫০০০ ডলার । এই আমার বাবার কাছ থেকে শেষ টাকা নেওয়া । বাকী ১৫০০০ ডলার , থাকা খাওয়া খরচ সব নিজে উপার্জন করলাম । সি জি পি এ কম , মেধাহীন কেউ নিশ্চয় স্কলারশিপ ফান্ড পাবে না কিংবা টিচার্স এসিস্ট্যান্ট হবে না। এই উপার্জনের জন্য অস্ট্রেলিয়ান এক রেস্টুরেন্টে কাজ শুরু করলাম।
রেস্টুরেন্টে কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম, আমি কতটা শারীরিক পরিশ্রম করতে সক্ষম। ৪০ পাউন্ড মাসেল এর ভারী ড্রাম গুলো নিমিষেই নামিয়ে ফেলতাম। গরম জলে কাজ করতে করতে এত অভ্যস্ত হয়েছিলাম যেঝে ফুটন্ত পানিতে হাত ডুবালে ও টের পেতাম না মাঝে মাঝে। একদিন ১৪ ঘন্টা কাজ করে বের হয়ে দেখি ঐ দিনের শেষ রাতের নির্ধারিত বাস আসবে না। পরের বাস ভোরবেলা ।দূরত্ব ৭ মাইলের মত । অপেক্ষা করব, কিন্তু পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা । ট্যাক্সি নেব, ২০ ডলার চলে যাবে। ২০ ডলার অনেক টাকা। তাই হাঁটা ধরলাম। ৭ মেইল হেঁটে যখন বাসায় পৌছালাম রাত ৩ টা । আমার ফ্ল্যাট-মেট ভুলে হয়ত ভাত অবশিষ্ট রাখেনি। ভাত বসালাম সাথে আলু সিদ্ধ । ৪ টা বাজে খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানায় শুয়ে মনে পরলো পরের দিন ১১ টায় একটা এসাইন্টমেন্ট জমা দিতে হবে। এলার্মটা ৭ টায় দিলাম । পরেরদিন এসাইন্টমেন্ট জমা দেবার সময় শিক্ষিকা কে সাথে বোনাস একটা হাসি উপহার দিলাম। না এইরকম কষ্ট কখনো করব- ভাবিনি । আমি কখনো জল ও খেতে চাইলে মা দৌড়ে এসে রান্নাঘর থেকে জল নিয়ে আসতো। মা বাবার বড় আদর করা বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার টার হাত এখন প্রায়ই পুড়ে যায় , পিঠে-কাঁধে ব্যাথা করে।
এর মাঝে একদিন শুনলাম আমি বি সি এ স লিখিত পরীক্ষায় ও উত্তীর্ণ। মৌখিক পরীক্ষার চিঠি পাঠানো হয়েছে ঢাকা বাসায়। বাবা আমাকে বললেন –আসিস না, তুই পারবি না এদের সাথে মিশতে, পারবি না অসৎ হতে । আমি গেলাম না।
আমি বাবার কাছ থেকে পুরো টাকাটাই নিতে পারতাম। কিন্তু নেই নি। আমি নিজের ইচ্ছেতেই সংগ্রামটা কে বেছে নিয়েছিলাম। যেদিন ৩ তা ডিস্টিঙ্কশন নিয়ে পাশ করা মাস্টর্স এর রেজাল্ট টা আমার রেস্টুরেন্ট এর মালিক কে দেখাই , বার টুলে বসে থাকা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে উঠে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো। এখানেই সুন্দর ইতি হতে পারতো কিন্তু হয়নি- অস্ট্রেলিয়ায় সেই সাদা কলারের চাকুরী আর পাওয়া হলো না। এক পর্যায়ে আমেরিকান নাগরিক বউ এর হাত ধরে আমেরিকা। আমেরিকায় কখনো কেরাণী কখনো দপ্তরী কখনো সফটওয়্যার বিশেষজ্ঞ এবং অবশেষে রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার।
আমার আর্জেন্টিয়ান বস ইন্টারভিউ তে জিজ্ঞাসা করেছিলেন,
তোমার ব্যাক গ্রাউন্ডে ইঞ্জিনিয়ারীং কাজ খুব কম। আমেরিকায় তো একেবারেই নেই –ই। কেন তোমায় নেব?
বলেছিলাম, জীবনের ৬ বছর ব্যাচেলার , ২ বছর মাস্টার্স যা পড়তে ব্যয় করলাম –তার উপর ভিত্তি করে প্রথম কাজ করার সুয়োগ পাওয়া হচ্ছে জীবন বাজী রাখা। তুমি অনেক অভিজ্ঞ মানুষ রাখতে পারো , কিন্তু জীবন বাজী রেখে আমার মত কাজ করবে না। কিন্তু আমি করব কারণ এটি আমার এত এত বছর পর প্রথম সুযোগ।
আমাকে ৩৪ জন ইঞ্জিনিয়ার এর মাঝ থেকে আমাকে নেয়। বলা বাহুল্য , আমি ছিলাম সর্ব কনিষ্ঠ।
জীবনে জয় –পরাজয় নিয়ে কখনো ভাবিনি। জীবন টা ছিল- রোদ এলে মাঠ, বৃষ্টি এলে ভিজে যাওয়া। কিছু সময় জয় পেয়েছি, বেশীরভাগ –ই পরাজয়ের কাহিনী। তবে নক্ষত্র বীথির নব্য হতে যাওয়া তারকার মাঝে যেই অত্যন্ত অল্প সংখ্যক এর সাথে আমার জীবন কিছুটা মিলবে তাদের জন্য বলবো ‘ হেরে যাও যদি- নক্ষত্রবীথি চ্যুত হও যদি- তারা ভরা আকাশটা দেখো আর ভেবো তুমি অসীমের সাথে মিতালী পেতেছো- আধার আলোকের উর্ধে সেই তুমি’
আর যাদের এমনটা ভাবার অবকাশ নেই, সেই সকল শিক্ষক, বন্ধু কে বলছি…বাসার উঠোনে উর্বর মাটিতে খুড়োখুড়ি করে সাজানো ফুলের বাগান তো সবাই ই পারেন হয়ত, একটি বার মরুর ধূসর উষর বুকে একটা গোলাপ এ ফুটিয়ে দেখার চেষ্টা করুন না!
সি জি পি এ ৩ এর নীচে হওয়ায় সেশেন্যাল ভাইবা না নিতে চাওয়া বুয়েটের সেই স্যার কে জানাতে চাই- মাত্র কিছু বছরেই আমার ২ টা ড্রয়িং নিউইয়র্ক শহরের সরকারী ডিজাইনের তালিকায়।
অগোছালো আর একটি বর্ধিত হয়ে যাওয়ায় দুঃখিত। সবার জন্য শুভ কামনা রইলো।
ধীমান
পুরকৌশল ৯৭
বুয়েট, ঢাকা
ভাই,লেখা টা কয়েকবার পড়লাম।খুব খুব খুব সুন্দর লিখেন। লেখা গুলা এক মুহুর্তের জন্য হলেও অনুপ্রেরণা দেয়