আমাদের দেশে কেবল ঠিক মত ময়লা বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। যেমন নদীগুলোকে বাঁচানো যেত, জলাবদ্ধতার অনেকটা সমাধান করা যেত আর একটু সুন্দরভাবে শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা যেত। ইদানিং বাংলাদেশে একটা ব্যপার খুব চোখে পরে ছোট্ট মায়ের কোলের শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক সব বয়সীদের ক্যন্সার থেকে শুরু করে নানা রকম জটিল রোগ। প্রায় ঘরে প্রতিবন্ধি আর দিন দিন মানুষের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে, কমসহ্য শক্তি ফলে বেড়ে যাচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা।

ছোট বড় সবার গ্যস্ট্রিক, মাথা ব্যথা, সর্দি কাশি লেগেই রয়েছে। পৃথিবীর সব দেশ উন্নত হচ্ছে মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে সেখানে বাংলাদেশে কেন এত এত জটিল রোগ বেড়েই চলেছে? কেউ কি ভেবে দেখেছেন কেন এত এত রোগ ব্যাধির পেছনে আসল কারণগুলো কি?

আমি বাংলাদেশে যখন থেকে ঢাকায় থাকা শুরু করেছি নিয়মিত প্রচন্ড গ্যাস, মাথা ব্যথা আর সর্দিকাশি লেগেই থাকতো। কিন্তু এখানে গতবছর পুরো শীতে যখন বরফ পড়েছে ঠাণ্ডা লাগেনি কিন্তু কেন? কারণ ঢাকায় বাতাসে ধুলোবালিতে নানা রকম রোগ জীবাণু ভেসে বেড়ায়। এরকম খোলা ডাস্টবিন সব রকম জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে দেয় আর এর উপর বৃষ্টি পড়লে রোগ জীবাণু মিলে মিশে একাকার। আর কোথাও কোন গাছ নেই ধুসর রাজধানীতে অক্সিজেন সংকট। নদীর পানিগুলো দূষিত হতে হতে সেখানে টেস্ট করলে পানি নেই সব এ নানা রকম রাসায়নিক কেমিকেল এর মিশ্রন যেটা ধীরে ধীরে নিচে গিয়ে ভুগর্ভস্থ পানিও দূষিত করছে। নদীতে যে মাছগুলো বেড়ে উঠছে তাও বিষাক্ত। কলকারখানা আর খোলা ডাস্টবিনের রোগ জীবানু আর বিষাক্ত কেমিকেল মাটিতে মিশে মাটিকেও বিষাক্ত করছে। সে মাটিতে যে ফসল জন্মাছে তাও বিষাক্ত। আমাদের দেশে কৃষি পুরোপুরি রাসায়নিক সার এর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে দেশে এত মানুষের জন্য খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে মাটিতে এত এত রাসায়নিক সার দেওয়া হয় যে মাটিতে যে ন্যূনতম জৈব উপাদান থাকার কথা তা এখন নেই মাটিতে। আর তাই গোলাপ বা রজনীগন্ধা থেকে কোন গন্ধ পাওয়া যায়না। শাহবাগের ফুলের দোকানের সামনে হেঁটে গেলে কেবল পেট্রোল বা পাশের ডাস্টবিনের গন্ধই নাকে ঝাপটা দেয়। ধনিয়া পাতা বা টমেটো থেকেও সেই গন্ধ খুজে পাওয়া যায়না যেটা আমি জার্মানিতে এসে পেয়েছিলাম এর খুব অবাক হয়েছিলাম আরে এত সেই টমেটো আমাদের বাড়িতে আমরা লাগিয়ে তুলে এনে খেলে সেই ঘ্রাণ ! জমিতে অনেক বেশী বেশী চাষাবাদ হতেই পারে যদি মাটি ফসল উৎপাদনে সক্ষম হয়।

এই বর্জ্য অব্যবস্থাপনার প্রভাব যে কত বেশী তা দেশের মানুষ কি আদৌ অনুধাবন করেছে?

সিটি কর্পোরেশন বা ১৮ কোটি মানুষ সবাই যদি মাঠে নেমে পরিষ্কার করে বা ময়লা ঝুড়িতে রাখে তাহলে কি সমাধান হবে???

এর পরে ঝুড়ি থেকে রাস্তায় বড় খোলা ডাস্টবিন তার পরে কোথায় যায় ভেবেছেন?

সেই তো আবার সেই খাল বিল সাভার মাতুয়াইল খোলা মাঠ এর পরে ধীরে ধীরে লোকালয়। এর পরে ধীরে ধীরে এত বিশাল বর্জ্য নদী গুলো আর নিচু জলাশয় দখল শেষে মানব বসতি দখল করে নিচ্ছে গ্রাস করে নিচ্ছে সব লোকালয় দানবের মত।।এত বেশী জনসংখ্যা সেই সাথে জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলছে আবর্জনা। সাভার থেকে ঈদে যাতায়াতের জ্যামে নাকাল নগরবাসী দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয় পরিবেশ দূষণে। আমরা নাকে রুমাল চেপে সরে গেলে ভাবি বেঁচে গেলাম কিন্তু এখন মাইলের পওর মাইল এই দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত বাতাস তাহলে কি শ্বাস করা ছেড়ে দেয়া যাবে? না তাহলে আমরা শ্বাস প্রশ্বাসের সাথে ফুসফুস থেকে রক্তে মিশিয়ে দিচ্ছি বিষাক্ত সব গ্যাস।

ঢাকায় সব বাড়ি থেকে কম বেশী টাকাও নেওয়া হয় এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপানার জন্য। অনেক লোক জড়িত কিন্তু ঠিকভাবে কিছুই হচ্ছেনা । দেশে খুব লেখালেখি হচ্ছে ইদানিং, কেউ কেউ ভাবছে উদ্যোগ কেউ কেউ উদ্যোগ নিচ্ছে যেন সবাই সচেতন হয় কিন্তু সবাই যার যার বাড়ির বর্জ্য ঠিক মত যদি ঝুড়িতে ফেলে বা সবাই যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা না ফেলে ডাস্টবিনে ফেলে আসে তাহলে হয়ে যাবে সমাধান??
সমস্যা যত বড় সমাধান খুব সহজ। পচনশীল ময়লা আলাদা করে জমিতে দিয়ে দেওয়া ফেলে মাটি উর্বর হবে আর পচনশীল গুলো আলাদা আলাদা করে পুনরায় ব্যবহার করা ।

যতক্ষন না দেশে এই খোলা আকাশের নিচের খোলা ডাস্টবিন গুলো বদলে সেখানে আলাদাভাবে নতুন ঢাকনা লাগানো আধুনিক ডাস্টবিন আসবে পচনশীল অপচনশীল বর্জ্য আলাদা হবে একে রিসাইকেল করে রিইউজ করা সম্ভব না। উন্নত দেশগুলো এখন পুরোপুরি বায়ো বা জৈব সার দিয়ে কৃষিজমিতে চাষাবাদ করে।এশিয়ার চীন, জাপান অনেক আগে শুরু করলেও ভারতেও এখন অনেক গবেষণা হচ্ছে আর অনেক অনেক প্রতিষ্ঠান অরগানিক খাদ্য প্রস্তুত করছে। আমাদের দেশে এই ১৭ কোটি মানুষের এত এত বর্জ্য রিসাইকেল না করলে দেশ ময়লা আবজর্নার নিচে তলিয়ে যাবে পুরোপুরি। কারণ শুধু রাজধানী ঢাকা শহরে প্রতিদিন সাড়ে ৪ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। বছরে ১৬৪২৫০০হাজার টন । এছাড়া আছে কোরবানির ঈদের মহা বর্জ্যযজ্ঞ।

এক সময় বড় বড় ব্যাগে করে চাল, ডাল, মাছ, মাংস একসাথে বাজার করে বাড়ি এনে রান্না শেষে উচ্ছিষ্ট গুলো উঠোনে পুতে ফেলা হত। কিন্তু এখন সে জায়গা গুলোতে এসেছে আধুনিক প্যাকেট ছোট ছোট ৫০ গ্রাম, ১০০ গ্রাম এর ডাল চানাচুর, ৩টি বা ৫টি বিস্কূট একত্রে একটা প্যাকেট। ৩মিলি ৫মিলি এর ছোট মিনিপ্যাক শাম্পু। কোকের কাচের বোতল বা পানির অনেক বার ব্যবহার করা যায় বদলে প্লাস্টিকের পানির বোতল। মাল্টিন্যশনাল কোম্পানি গুলো এসব ছোট ছোট সুন্দর প্যাকেটে পণ্য বাজারজাত করছে আবার ক্রেতা বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে হ্যমিলনের বাশিওয়ালার মত ম্নত্রমুগ্ধ হয়ে কিনে আনছে এনেই এক টাকার ক্যান্ডি বা মিনিপ্যাক শ্যাম্পুতে মডেল এর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে ঘরের জানালা, বাসে বা ট্রেনের জানালা, রিকাশায় বসে, নদীতে সমুদ্রে এমনকি সেন্ট মার্টিন্স এ পানির ইচের জলাভুমি ও বাদ নেই। যে যেখানে পারে ফেলে দিয়ে হাত মুছে নিচেছ। কিন্তু এই পলিথিন আর প্লাস্টিক মাটিতে পচতে এত সময় লাগে যে ততদিনে দেশের আনাচে কানাচে সব দখল হয়ে যাবে। এর পরে আছে পুরনো ইলেকট্রনিক্সের বর্জ্য। জার্মানিতে বড় বড় পুরনো গাড়ি জমতে জমেতে সব দখল হয়ে যাচ্ছিল। এখন এদের গাড়ি গুলোর ১০০ ভাগ কলকব্জা রিসাইকেল করে আবার ব্যবহার করা যায়।

এখন আধুনিক পৃথিবীর গবেষণা কম পরিবেশ দূষণ আর সুন্দর পরিবেশ। বড় বড় দালান কোঠা দামী আসবাব, চকচকে ঝকঝকে দামি শপিংমলে দেশে যে অর্থ ব্যয় হয় তা নেহাত কম নয়। ঢাকায় বাড়িগুলোর প্লানিং সুন্দর দৃষ্টিনন্দন নিয়ে যত টাকা ব্যয় হয় পরিবেশ বান্ধব কিনা তা নিয়ে কি যথেষ্ট পরিকল্পনা হয়েছে?

বিশুদ্ধ বাতাসের অভাবে জন্ম নিচ্ছে ও বেড়ে উঠছে নতুন প্রজন্ম। শুধু রাজধানী নয় গ্রাম, নগর, রেলষ্টেশন, বাস ষ্টেশন সব দখল করে নিয়েছে এই বর্জ্য। এর আগ্রাসী থাবা একে একে সব নিচু আর পতিত জমি জলাশয় দখলে শেষে দখলে চলে যাচেছ সব সুন্দর বাড়িরগুলোর পাশের ছোট্ট ব্যবধান টুকু, বাগানের খোলা জায়গা। ঢাকা ইউনিভার্সিটি, টিএসসি, জিয়া উদ্যান, সংসদ ভবনের সামনের আড্ডা দেবার জায়গা যেখানে তাকাই শুধুই এদের দখলদারিত্ব। কেউ কি চোখ বন্ধ করে ভেবে বলতে পারে নগরের কোথায় বসে এখন একটু প্রকৃতি দেখা যায় আর ভাল করে শ্বাস নেওয়া যায়?
এর দায় কি কেবল সরকার বা সিটি কর্পরেশনের?

রাশা বিনতে মহিউদ্দীন
স্টুডেন্ট অফ মাস্টারস ইন ইনভাইরনমেন্ট প্রটেকশন এন্ড এগ্রকালচারাল ফুড প্রডাকশন
ইউনি হোয়েনহেইম
স্টুটগার্ট জার্মানি

mm

By Rasha Binte Mohiuddin

স্টুডেন্ট অফ মাস্টারস ইন ইনভাইরনমেন্ট প্রটেকশন এন্ড এগ্রকালচারাল ফুড প্রডাকশন, ইউনি হোয়েনহেইম (স্টুটগার্ট জার্মানি)

Leave a Reply