আব্বু-আম্মু দুজনেই ঘুরে-বেড়াতে খুব পছন্দ করেন, ফলে জীনগত ভাবেই আমার মধ্যে ঘুরেবেড়ানোর নেশাটা পূর্ণরূপে বিদ্যমান। দেশে যখন ছিলাম বাস্তবিক অর্থেই টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া চষে বেড়িয়েছি। সেটা যেমন হয়েছে পরিবারের সঙ্গে, তেমনি হয়েছে অসম্ভব ভালো কিছু বন্ধুদের সঙ্গে।
২০১৫ সালের এপ্রিলে মাস্টার্স করার জন্যে যখন জার্মানি এর জারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে এসেছি তখনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি এই দুই বছরে ইউরোপের যতটুকু পারা যায় চষে ফেলতে হবে। ভার্সিটি এর একদিনের এক্সকারসনগুলো এবং বন্ধুরা মিলে চারমাসে জার্মানি এর ৪ টা শহর, ফ্রান্সের ছোটো ৩ টা শহর আর লুক্সেমবার্গে একটা মিনি ট্রিপ দিয়ে ওয়ার্মাপটা হয়ে গেলেও বড় কোন ট্রিপ দেওয়া হয়নি, প্ল্যান ছিল সামার ব্রেকে শুরু করার। ব্যাপারটা আগুনে ঘি পড়ার মত আরও উস্কে যায় যখন আমি আসার তিন মাস পরেই আমার সব থেকে কাছের বন্ধুদের একজন হাসনাইন জার্মানিতে চলে আসে। এক্সাম শেষ, সামার ব্রেক শুরু হয়ে গেছে। প্রজেক্টের কাজ করতে করতে হটাত একরাতে মাথায় চাপল ঠিক যা করার আজকেই করতে হবে। সব থেকে কাছে প্যারিস, কিন্তু ইরাসমুসের বন্ধু ঈয্যু প্যারিস দেখাবার দায়িত্ব নিয়েছে, তাই সে প্যারিস না থাকায় প্যারিস বাদ। বন্ধু হাসনাইন কে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম, ইতালি নাকি স্পেন? সে পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিলো আগের মতই ম্যানেজার হিসাবে সে খরচের ব্যাপার গুলো দেখবে, এবং বরাবরের মতই ট্যুর প্লানের কাজ আমাকেই করতে হবে, তাই সিদ্ধান্তটাও আমাকেই নিতে হবে। চিন্তা করে দেখলাম চাচাতো বোন পরিবার নিয়ে যেহেতু ভেনিসের কাছেই থাকে তাহলে ইতালিই যাই। যেই ভাবা সেই কাজ। প্রোজেক্টের কাজের ফাকে ফাকে গুগলে অনুসন্ধান করা শুরু করলাম।
খরচ কমাতে প্রথমে চিন্তা করেছিলাম বাসে যাবো, পরে দেখলাম ফ্রাঙ্কফুর্ট হান এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র ১৫ ইউরো দিয়ে রায়ান এয়ারে করে ভেনিস যাওয়া যাবে। সিদ্ধান্ত হল আমি ৪ দিন আগে যেয়ে মিলান ঘুরে, আমার বোনের সঙ্গে দেখা করে ভেনিস চলে আসবো, হাসনাইন ৪র্থ দিনে আমার সঙ্গে যোগ দেবে। এরপরে আমরা একসঙ্গে ভেনিস, ফ্লোরেন্স ও রোম ঘুরবো। যেহেতু রায়ান এয়ারের অফারের টিকেট শেষ হয়ে যাচ্ছিল এবং ইউরোপের বড় বড় শহর গুলোকে সংযুক্ত করা মেগাবাসের টিকেট একটু আগে কাটলে ১ ইউরোতেও ৫০০ কিমি দূরত্বের টিকেটও পাওয়া যায় তাই টিকেট গুলো আগেই কেটে ফেললাম।
অবশেষে আসলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন, ১ সেপ্টাম্বার রাতে ট্রেনে করে হানে গেলাম। কিন্তু বিধিবাম, শুরুতেই ঝামেলা। রেসিডেন্স পার্মিট সঙ্গে থাকলেও পাসপোর্ট বাসায় রেখে এসেছি। তাই প্লেনে আর ওঠা হল না। পরের দিন মানে ৩রা সেপ্টেম্বর সকাল ৬ টায় মিলানের বাসে উঠলাম, যেটা কার্লশ্যুয়ে, ফ্রাইবুর্গ, জুরিখ হয়ে রাত ১২ টায় মিলান যেয়ে পৌঁছল। সেখান থেকে আরেক বাস রাত ১ টায় রওনা হয়ে ভোর ৫ টায় পাদুভা। বোনের স্বামী বাবলু ভাই বারবার করে বলে দিয়েছিলো আমি যেন তার বাসার ট্রেনে ওঠার আগে অবশ্যই তাকে ফোন দেই যেন সে আমাকে স্টেশন থেকে নিয়ে যেতে পারে। ৫ঃ৪৫ এ যখন পাদুভা থেকে ট্রেন ছাড়ল তখন তার ঘুম ভাঙ্গাতে ইচ্ছে করেনি এমনকি ৬ঃ৩০ এ যখন লনিগোতে ট্রেন আমাকে নামিয়ে দিলো তখনো না। ভরসা স্কাউটের জিপিএস ম্যাপস অ্যান্ড ন্যাভিগেশন। পুরো ইতালিয়ের অফলাইন ম্যাপ ডাউন লোড করে নিয়ে গেছি, তাই ইন্টারনেট ছাড়াই যেকোনো ঠিকানা খুঁজে বের করে দিতে পারে, সঙ্গে দিকনির্দেশনা প্রদান তো আছেই। স্টেশন থেকে বের হওয়ার পরেই মনে পড়লো আরেক ইরাসমুস বন্ধু কৃথকী বলেছিল আমার ইউরোপ ভ্রমনের সময় আমি যেন অন্তত একবার কাউচসার্ফিং থেকে কারো বাসায় কাউচ শেয়ার করি, আর অন্ত্যত একবার যেন হিচ হাইকিং (বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গাড়িতে লিফট নেওয়া) করি।
স্টেশন থেকে বের হয়ে চিন্তা করলাম আজকেই সুযোগ হিচ হাইকিং এর। কিন্তু সঙ্কোচতার কারণে ৪/৫ টা গাড়ী পাড় হয়ে গেলো, কিন্তু বৃদ্ধাঙ্গুলি আর প্রদর্শন করা হল না। পেছন থেকে আবারো গাড়ী আসার শব্দ। সকল জড়তা ঝেড়ে ফেলে ইশারা করলাম, কিন্তু হায়, গাড়িটি না দাড়িয়ে হুশ করে আমার সামনে দিয়ে চলে গেলে একটা বাকের আড়ালে। হতাশ হলাম না, বুঝতে পারলাম আরও কিছু চেষ্টা চালাতে হবে। ৩০ সেকেন্ড পরে উলটো দিক থেকে একটা গাড়ী এসে পাশের ঘাসের মধ্যে সাইড করে রাখল। আরে আজব, চালক দেখি আমাকে ইশারা করছে গাড়ী তে ওঠার জন্যে, ভালো করে খেয়াল করে দেখি এটা সেই গাড়ী যেটাকে ইশারা করার পরে চলে গিয়েছিলো। আমি বেজায় খুশি, প্রথম চেষ্টাতেই হিচ হাইকিং এ সফল। কিন্তু গাড়ি তে ওঠার পরেই বুঝতে পারলাম চালক মশাই একবিন্দু ইংরেজি পারেননা আর আমি পারিনা ইতালিয়ান। তবে তাকে ম্যাপে পিন করা অ্যাড্রেস এবং রাউট দেখাতে খুব একটা কষ্ট হল না, এরপর দুইজন দুই ভাষায় গল্প করতে করতে ১০ মিনিটের মাথায় আমি বোনের বাসার নিচে।
বাবলু ভাইকে যখন ফোন দিয়ে জানালাম আমি বাসার নিচে, সে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা খেল। ধাক্কা সামলে নিচে এসে বাসায় নিয়ে গেলেন। বাসায় যাওয়ার পরে সবার মুখ দেখে প্রথমেই যেটা বুঝতে পারলাম আমার যাওয়াতে সবাই অত্যন্ত খুশি হয়েছে। এরপরে শুরু হল চির চারিত বাঙ্গালী আপ্যায়ন। খুব একটা খেতে না পারার কারণে তাদের কে খুশি করাটা আমার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। সকালের দিকটাতে ঘুরে দেখলাম লনিগো, এরপরে দুপুরে লনিগোর বাংলাদেশী কমিউনাল মসজিদে জুম্মার নামাজ পরলাম।
বিকালে সবাই মিলে বের হলাম ভেরনার উদ্দেশ্যে। উলেক্ষ্য ভেরোনা বিখ্যাত এর শৈল্পিক ঐতিহ্য, একটি রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার ও শেক্সপিয়ারের ৩টি নাটকের পটভূমিকা ভেরোনা কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠায়। নাটক ৩ টির মধ্যে অবশ্যই বিশেষ ভাবে উলেক্ষ্য করতে হয় রোমিও ও জুলিয়েটের কথা। মজার ব্যাপার এই শহরে আপনি এখনো টিকেট কেটে জুলিয়েটের বাসা ঘুরে দেখতে পারেন। অবাক হচ্ছেন যে জুলিয়েটের বাসা কোথা থেকে আসলো। আমি নিজেও অবাক হয়েছিলাম। পরে যানতে পারি সেখানে পনেরোশো শতকের একটি বাসাকে জুলিয়েটের বাসা ঘোষণা করা হয়েছে যেটার সঙ্গে গল্পের জুলিয়েটের বাসার অনেক মিল রয়েছে। এমনকি জুলিয়েটের সেই বিখ্যাত ব্যাল্কনিটাও অবাস্থানগতভাবে প্রায় একি রকম। সত্যিটা জানা থাকলেও পনরোশো শতকের একটা বাসা ঘুরে দেখা, আসবাব, তৈজসপত্র এসব দেখার মধ্যেও যথেষ্ট রোমাঞ্চ আছে। জুলিয়েটের বাসা দেখা শেষ করে কিছুক্ষণ হেটে বেড়ালাম শহরের মধ্যে দিয়ে। খুব অবাক হয়ে দেখতে থাকলাম পনরোশো শতকের স্থাপত্য যেগুলোতে এখনো মানুষ বসবাস করে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে আসলে অনেক কিছুই সম্ভব। সেখানে আমাদের দেশে আমরা লালবাগের কেল্লার দেওয়াল ভেঙ্গে পার্কিং বানাই।
যাইহোক হাটতে হাটতে চলে আসলাম অ্যাম্ফিথিয়েটার/অ্যারেনা এর সামনে। যেটা এখনো মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে আর ঘোষণা করে যাচ্ছে হাজার বছর আগেকার রোমান শৌর্যবীর্যের কথা। যারা অ্যাম্ফিথিয়েটা/অ্যারেনা এর নামের সঙ্গে পরিচিত নন তাদের কে বলে রাখি এটা অনেকটা আজকের দিনের স্টেডিয়ামের মত। অনেকেই হয়ত দেখেছেন গ্ল্যাডিয়েটরেরা একটা মাঠের মত যায়গায় একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করছে আর চারপাশে হাজার হাজার দর্শক উল্লাস করছে, সেটাই মূলত অ্যাম্ফিথিয়েটার। অ্যাম্ফিথিয়েটার ঘুরে দেখে ভেরোনাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলাম ভিসেঞ্জাএর দিকে। পাহাড়ের ওপর থেকে রাতের ভিসেঞ্জা উপভোগ করলাম বেশ কিছুক্ষণ এবং অবশেষে রাত ১২টায় ঘরে ফেরা।
পরদিন টা কেটে গেলো শপিং আর লনিগো ঘুরে। তার পরেরদিন মানে ৬ই সেপ্টেম্বর সকালে বোন, ভাগ্নি, বোনের শ্বশুরের থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর বাবলু ভাই গেলাম লনিগো এর প্রখ্যাত রেস্টুরেন্টে ইতালিয়ের ঐতিহ্যবাহী সকালের নাস্তা ব্রিওশ আর ক্যাপাচিনো কফি খেতে। নাস্তা করে বাবলু ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে ভেনিসের দিকে যাত্রার মাধ্যমে শেষ হল আমার লনিগো ও ভেরোনা ভ্রমণ।
পরবর্তী উপপর্বঃ ভেনিস/ভ্যানেৎছিয়া
[…] পূর্ববর্তী উপপর্বঃ ভেরোনা ও লনিগো […]